গাজা জ্বলছে : চাই জোরালো প্রতিবাদ
নিক ডিয়ারডেন, শায়িস্তা আজিজ
প্রকাশ: ২৮ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী সম্প্রতি ঘোষণা করেছেন, ‘গাজায় কোনো মানবিক সাহায্য প্রবেশ করবে না’, যা স্পষ্টভাবে তার সরকারের ইচ্ছা প্রকাশ করছে যে, তারা আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন করে ফিলিস্তিনের নিরস্ত্র এবং অবরুদ্ধ নাগরিক জনগোষ্ঠীর ওপর নানা শাস্তি চালিয়ে যাবে। তিনি আরও বলেছেন, হামাসকে চাপে রাখার কৌশল হিসাবে এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেছেন, ‘বর্তমানে গাজায় কোনো মানবিক সাহায্য প্রবেশের অনুমতি দেওয়ার পরিকল্পনা নেই।’ অ্যামনেস্টি এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতো বহু এনজিও ও আন্তর্জাতিক সংস্থা দীর্ঘদিন ধরে গাজার মানবিক সাহায্যকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহারের ঘটনাকে গণহত্যার অংশ হিসাবে চিহ্নিত করেছে। ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর সাম্প্রতিক এ মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায়, তারা আবারও দেশটির সরকারের গণহত্যামূলক নীতির তীব্র নিন্দা জানিয়েছে এবং ইসরাইলের পশ্চিমা মিত্রদের আন্তর্জাতিক আইন কার্যকর করার জন্য পদক্ষেপ নিতে আহ্বান জানিয়েছে।
এ ধরনের নিন্দা ও কর্মসূচির আহ্বানে কাঙ্ক্ষিত সুফল মিলছে না। ১৮ মাস অব্যাহত ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর পর ইসরাইল এখনো বোমাবর্ষণ করছে, গুলি চালাচ্ছে, ফিলিস্তিনিদের স্থানচ্যুত করছে এবং তাদের ক্ষুধার্ত রেখে দিচ্ছে; একইসঙ্গে ঘোষণা করছে, আগামীতেও এ ধরনের অপরাধ অব্যাহত থাকবে। দেশটি এখনো পশ্চিমা মিত্রদের পূর্ণ রাজনৈতিক, সামরিক ও কূটনৈতিক সমর্থন নিয়ে এ কাজ করে যাচ্ছে। এ কারণেই আমরা বিশ্বাস করি, ব্রিটিশ এনজিওগুলোর এখন কৌশল পরিবর্তনের সময় এসেছে। গত ১৮ মাস ধরে, যুক্তরাজ্যের মানবাধিকার ও ত্রাণ ক্ষেত্রের অনেকেই আমাদের সরকারকে বারবার অনুরোধ করেছে, যাতে তারা অন্তত আন্তর্জাতিক আইনের মৌলিক নীতিগুলো তার মিত্র ইসরাইলের ওপর বাস্তবায়ন করে।
আমরা প্রচার চালিয়েছি, আমরা সমর্থন চেয়েছি, আমরা অংশগ্রহণ করেছি এবং আমরা বোঝানোর চেষ্টা করেছি। আমরা প্রমাণ দেখিয়েছি, আইনের দিকে ইঙ্গিত করেছি এবং আমাদের নেতাদের সঠিক কাজ করতে বলেছিলাম।
আমাদের আবেদন বৃথা গেছে। আমাদের কথা শোনেনি কেউ।
এখনো কিয়ের স্টারমারের সরকার ইসরাইলি সরকারের সঙ্গে বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে, এমনকি তাদের কাছে অস্ত্রও বিক্রি করছে, যদিও তারা গাজা এবং অন্যান্য দখলকৃত ফিলিস্তিনি অঞ্চলে ইসরাইল যে স্পষ্ট অপরাধগুলো প্রতিদিন করে তা সম্পর্কে অবগত। তারা এখনো ইসরাইলকে প্রধান মিত্র হিসাবে বিবেচনা করে, যদিও তারা জানে, আন্তর্জাতিক বিচার আদালত গাজায় ইসরাইলের ‘যুদ্ধের’ বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ পর্যালোচনা করছে এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে বিভিন্ন যুদ্ধ অপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে।
সম্প্রতি লন্ডনে ব্রিটেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে ইসরাইলের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আলোচনা হয়েছে। জানা যায়, লন্ডনে এটা ছিল ইসরাইলের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সফর। কোনো দেশ যার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আইনে সবচেয়ে নির্মম অপরাধের অভিযোগ রয়েছে, তেমন দেশের উচ্চ পর্যায়ের মন্ত্রীর সঙ্গে ব্রিটেনের উচ্চপদস্থ ব্যক্তির প্রকাশ্য বা গোপন বৈঠক করা অনুচিত। যেহেতু ইসরাইল শরণার্থী তাঁবুতে বোমা ফেলে, সাংবাদিক ও চিকিৎসকদের হত্যা করে এবং অবরোধের মধ্যে থাকা জনগোষ্ঠীর কাছে সাহায্য পৌঁছানো বন্ধ করে রেখেছে সেহেতু ইসরাইলের নেতাদের সঙ্গে ‘গাজা ও মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য জরুরি বিষয়’ নিয়ে আলোচনা করাও উচিত নয়, কোনো রাজনীতিকই যা ঘটছে তা না জানার কথা দাবি করতে পারেন না। হাজার হাজার ফিলিস্তিনি হতাহত হয়েছে। অনেকেই মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে এবং উদ্বাস্তু হয়েছে। হাসপাতাল, ক্লিনিক, শরণার্থী শিবির, স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয়, আবাসিক এলাকা, পানি ও খাদ্য সরবরাহের স্থান ধ্বংস হয়েছে। শত শত সাহায্যকর্মী-স্থানীয় ও বিদেশি, ব্রিটিশসহ-ফিলিস্তিনিদের সাহায্য করায় টার্গেটে পরিণত হয়েছে। সাধারণ ব্রিটিশ জনগণ ইসরাইলের কাজ দেখে আতঙ্কিত এবং তারা এ অবস্থার অবসান চান।
আমরা আর ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে এমনভাবে যোগাযোগ চালিয়ে যেতে পারব না, যেন আমরা শুধু নীতিগত মতবিরোধে আছি। এটি এমন কোনো সাধারণ ঘটনা নয়, যেখানে আমাদের সরকার কোনো সংঘাত বা সংকটে পর্যাপ্ত মনোযোগ না দেওয়ার কারণে বিভিন্ন অগ্রাধিকার বা দ্বন্দ্বপূর্ণ স্বার্থের কারণে বিরোধিতা করছে। এটি এমন কোনো মতবিরোধ নয়, যা আমরা সংলাপ ও বিতর্কের মাধ্যমে কাটিয়ে উঠতে পারব। বর্তমান ব্রিটেনের নেতারা শুধু প্রতিদিন আমাদের স্ক্রিনে সরাসরি সম্প্রচারিত সবচেয়ে নৃশংস যুদ্ধাপরাধগুলোই উপেক্ষা করছেন না, বরং মানবাধিকার খাতে আশঙ্কা ও আকুতি সত্ত্বেও কূটনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিকভাবে এ অপরাধীদের সমর্থন করতেও জোর দিচ্ছেন। আমাদের বিশ্বাস, এ বিষয়ে এনজিওগুলো প্রকৃত পরিবর্তন আনতে পারে শুধু সরকারের সঙ্গে সব ধরনের সংযোগ বন্ধ করে। ব্রিটিশ সরকার হয়তো আমাদের প্রচারাভিযান ও রিপোর্টে মনোযোগ দিচ্ছে না, কিন্তু তারা অবশেষে রাস্তায় ক্রমবর্ধমান প্রতিবাদ ব্রিটিশ ও আন্তর্জাতিক আদালতে তাদের ইসরাইলি মিত্রদের বিরুদ্ধে নেওয়া আইনি সিদ্ধান্তের প্রতি মনোযোগ দেবে।
সামনে এগোনোর পথ আছে। আমাদের জোরালোভাবে বলতে হবে, গাজায় যা ঘটছে তা হলো গণহত্যা। আমাদের উচিত এ অপরাধের নামকরণ করা, সরকারের এ অপরাধে সম্পৃক্ততার বিষয়টি তুলে ধরা। আমরা জানি, আমাদের কার্যক্রম জোরপূর্বক দখলকৃত ফিলিস্তিনে গণহত্যা বন্ধ করতে পারবে না, তবুও সেগুলো পার্থক্য গড়ে তুলতে সক্ষম। আমাদের উচিত, সেই ব্যক্তিদের ওপর চাপ বাড়ানো, যাদের ক্ষমতা আছে এ হত্যাকাণ্ড বন্ধ করার, যা অত্যন্ত প্রয়োজন। আমরা ব্রিটেনে সাহায্য ও মানবাধিকার খাতের সদস্যরা, এখন যে কর্ম গ্রহণ করব, তা শুধু গাজার মানুষের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমাদের সরকার, আমাদের শীর্ষস্থানীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং আমাদের সমাজ যে রকমভাবে গাজায় গণহত্যার মোকাবিলা করবে, তা ভবিষ্যতে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক সংকট ও জরুরি পরিস্থিতির মোকাবিলায় একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে। আজ আমাদের সবার উচিত ন্যায়ের জন্য লড়াই করা এবং আমাদের সরকারকে দেখানো যে গণহত্যার মুখে উদাসীনতার নীতি গ্রহণযোগ্য নয়। এতে আমরাও দোষী হয়ে যাব। আমাদের এ মুহূর্তে প্রতিক্রিয়া ইতিহাস বিচার করবে।
(প্রবন্ধের মতামত লেখকদের ব্যক্তিগত এবং তা আল জাজিরার সম্পাদকীয় অবস্থান প্রতিফলিত করে না।)
নিক ডিয়ারডেন : গ্লোবাল জাস্টিস নাউ-এর পরিচালক
শায়িস্তা আজিজ : সাংবাদিক, লেখক
(আলজাজিরা থেকে ভাষান্তরিত)
