|
ফলো করুন |
|
|---|---|
অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশি একমাত্র নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ। তিনি ক্ষুদ্রঋণ ধারণার প্রবর্তক-গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা। এ প্রতিষ্ঠানটি যৌথভাবে ২০০৬ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করে। ইউনূস বিশ্ব খাদ্য পুরস্কারসহ আরও জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন।
শেখ হাসিনার শাসনামলে গত দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে কোণঠাসা ছিলেন ড. ইউনূস। ২০১১ সালে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ৬০ বছর বাধ্যতামূলক অবসরের বয়স উল্লেখ করে ড. ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদ থেকে বরখাস্ত করে। তিনি এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আইনি চ্যালেঞ্জ শুরু করেছিলেন। তবে বাংলাদেশের আদালত পরবর্তীকালে তার অপসারণ বহাল রাখে।
শ্রম আইনের একাধিক মামলায় তাকে আদালতে হাজিরা দিতে হচ্ছিল। ড. ইউনূস এসব মামলাকে হয়রানিমূলক উল্লেখ করে প্রতিবাদ জানিয়ে আসছিলেন; কিন্তু শান্তিতে নোবেলজয়ী এ অর্থনীতিবিদকে শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। একই সঙ্গে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সব সময়ই তাকে হয়রানিমূলক মামলা থেকে মুক্তি দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে এসেছে।
পরে ৫ আগস্ট, ২০২৪-এ ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে যেতে বাধ্য হন এবং দেশত্যাগ করেন। ৬ আগস্ট রাতে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দীনের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধান ও ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের বৈঠকে ড. ইউনূসকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান করার প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। ফলে ৮ আগস্ট বঙ্গভবনে প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে শপথ নেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
এরপর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হয়ে একের পর এক চমক দেখিয়ে যাচ্ছেন তিনি। জুলাই অভ্যুত্থানের মতো এত বড় একটি ঘটনার পর সারাদেশে যেখানে বিশাল বিশৃঙ্খলা থাকার কথা-সেখানে সরকার দারুণভাবে সব পরিস্থিতি সামলে নিয়েছে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণসহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ইস্যুতে ড. ইউনূস একটার পর একটা সফলতা অর্জন করে চলেছেন। মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে চীন ও ভারত কূটনীতিতেও দারুণ চমক দেখিয়েছেন।
এবার ঈদুল ফিতরের উৎসব আরও রঙিন হয়ে ধরা দিয়েছে দেশবাসীর কাছে। এ পদশে চিরায়ত চিত্র-সড়ক, রেল ও নৌপথে নাড়ির টানে ঘরে ফেরা যানবাহনের যাত্রীদের ভোগান্তি। এবার সেই দুর্দশার চিত্র উধাও। ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়িফেরা মানুষের প্রধান রুটগুলোতে কোথাও উল্লেখযোগ্য ভোগান্তি দেখা যায়নি।
এর পাশাপাশি প্রবাসী আয় টানতেও গত কয়েক মাসে প্রবাসীদের দারুণভাবে প্রভাবিত করেছে এ সরকার। মার্চ মাসের রেমিট্যান্সের দিকে তাকালে এটার একটা ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তিন বিলিয়ন ডলার মানে প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকার বেশি রেমিট্যান্স এসেছে এ মাসে। ধুঁকতে থাকা নাজুক ব্যাংকগুলোকেও সরকার দাঁড় করিয়ে দিয়েছে বুক উঁচু করে।
ব্যাংক খাত থেকে গত ১৭ বছরে বিভিন্নভাবে বড় ধরনের অর্থ পাচার হয়ে গেছে। মূলত সাত-আটটি ব্যাংক থেকেই এ অর্থ বের হয়ে গেছে। ফলে এসব ব্যাংক তারল্য সংকটে পড়েছিল। সংকট মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক আগের মতো টাকা ছাপিয়ে এসব ব্যাংককে দেয়নি। টাকা ছাপিয়ে দিলে তাতে করে দুই লাখ কোটি টাকা ছাপাতে হতো। এতে মূল্যস্ফীতি, ডলারের দাম সবকিছু ঊর্ধ্বমুখী হয়ে যেত। এর বদলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তারল্য সংকটে পড়া ব্যাংকগুলোকে সীমিত আকারে টাকা দিয়েছে। এসব ব্যাংক অন্য ব্যাংক থেকে টাকা আমানত হিসাবে পেয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক দিয়েছে টাকার নিশ্চয়তা। এভাবেই ব্যাংক খাতের বড় রকমের ঝুঁকি কাটিয়ে তুলেছে ইউনূস সরকার।
ইউনূস সরকারের ছয় মাসের অন্যতম বড় সাফল্য আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বাংলাদেশের অবস্থান আরও সুদৃঢ় হয়েছে এবং মানবাধিকার ইস্যুতে সরকার তার নীতি তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও চীনের সঙ্গে কৌশলগত অংশীদারত্ব নিয়ে আলোচনা চলছে; যা ভবিষ্যতে বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনার নতুন সিদ্ধান্ত এসেছে। ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গাকে প্রথম ধাপে ফিরিয়ে নিতে সম্মতি দিয়েছে মিয়ানমার সরকার। কূটনীতিকদের মতে, বিশ্ব রাজনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান আরও দৃঢ় করতে ইউনূস সরকার কৌশলী ভূমিকা রাখছে; যা ভবিষ্যতের জন্য ইতিবাচক ইঙ্গিত বহন করছে। বিশেষ করে ভারতকে পাশ কাটিয়ে তিনি চীনে যাওয়ার পর চীনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে চীনা বিনিয়োগ নিয়ে যে চমক দেখিয়েছেন-তাতে ভারত সরকারের মাথা খারাপ হওয়ার দশা। সে কারণেই সর্বশেষ গত ৪ এপ্রিল ব্যাংককে বিমসটেক সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ড. ইউনূসের সঙ্গে ৪০ মিনিট দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করে ইতিবাচক মনোভাব ব্যক্ত করেছেন। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব জানিয়েছেন, ইউনূস-মোদি বৈঠকে হাসিনাকে ফেরানোর দাবিতেও মোদিকে নমনীয় দেখা গেছে। তার আচরণে মনে হয়েছে, তিনি স্বৈরাচারী হাসিনাকে ফেরত পাঠাবেন। আগামীতে তার বিচার এ দেশের মাটিতেই হবে। এটাকে বলা হচ্ছে বাংলাদেশের কূটনৈতিক বিজয়, যে বিজয়ের নায়ক ড. ইউনূস নিজেই। আমেরিকার অতিরিক্ত শুল্কারোপের বিষয়েও ড. ইউনূসের কৌশল একটা পজিটিভ ফলাফল বয়ে আনবে বলে অনেকেরই ধারণা। ইতোমধ্যে তিনি এ সংক্রান্ত বিষয় আলোচনার জন্য জরুরি মিটিং করেছেন। অনেকের মতে, ড. ইউনূস চাইলে আলোচনার মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব।
বিশ্লেষকদের মতে, ড. ইউনূস ধীরে ধীরে স্টেটসম্যান হওয়ার দিকে এগোচ্ছেন। তার চলার গতি ধীর এবং মাপা। তবে তার গন্তব্য এক প্রকার নিশ্চিত। ড. ইউনূস এমন এক অবস্থায় আছেন-তার আর পাওয়ার বা চাওয়ার কিছু নেই। দুনিয়ার তাবৎ সম্মানের যা যা পাওয়া সম্ভব-সবই তিনি ইতোমধ্যেই অর্জন করে ফেলেছেন, দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, যা অতীতের কোনো সরকারই পারেনি।
রাজু আলীম : কবি, সাংবাদিক
