ইরান কীভাবে দেওয়ালহীন প্রাসাদে পরিণত হলো
ইশফাক ফারহান সিয়াম
প্রকাশ: ১৬ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ইরানে সম্প্রতি ইসরাইলি আক্রমণে নিহত হওয়াদের মধ্যে বেশ কয়েকজন পরমাণু বিজ্ঞানীর সঙ্গে ইরানি সামরিক বাহিনী ও বিপ্লবী গার্ডের প্রধানও রয়েছেন। হামলার ধরন এবং নিহতদের এই তালিকা একটি শক্ত বার্তা দেয়। তা হলো-ইরানি গোয়েন্দা বাহিনীর অবস্থা যাচ্ছেতাই। ইরানের প্রেক্ষাপটে এ দুজনকেই রাষ্ট্রের তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বলা যেতে পারে। সর্বোচ্চ নেতা ও প্রেসিডেন্টের পরেই তাদের নিরাপত্তা সবচেয়ে কঠিনভাবে দেওয়া হয়। কিন্তু দুজনই একই সঙ্গে ইরানের মাটিতেই নিহত হলেন। তাও যদি হামলা একেবারে হঠাৎ করে হতো, একটা কথা ছিল। কয়েকদিন ধরেই তামাম দুনিয়া জানে, ইরানে একটা হামলা হতে পারে। ফলে নিশ্চিতভাবেই এ দুজনের সর্বোচ্চ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কিন্তু এরকম একটি সময়েও ইরান না তাদের অবস্থান ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ থেকে লুকাতে পেরেছে, না তাদের হামলা থেকে বাঁচাতে পেরেছে।
কয়েক মাস আগে আমরা ইরানের ভয়াবহ গোয়েন্দা ব্যর্থতা দেখেছি। ইরানের প্রেসিডেন্টের জানাজায় অংশ নিতে এসে খুন হন ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসের প্রধান ইসমাইল হানিয়া। এটি সবাই জানে, ৭ অক্টোবরের পর থেকেই ইসরাইলি হিটলিস্টে হানিয়া এক নম্বরে ছিলেন। তাই ইরানও হানিয়ার জন্য সর্বোচ্চ সম্ভব নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে; কিন্তু হানিয়া তার জন্য নির্ধারিত হাই সিকিউরড বাংলোয় নিজের বেডরুমেই খুন হন। মোসাদ এজেন্টরা নাকি হানিয়ার বিছানার নিচেই বোমা স্থাপন করে রেখেছিল। মানে, ওই হাই সিকিউরিটি বাংলোর কোন রুমে হানিয়া থাকছেন, মোসাদ শুধু জানত তাই নয়, বরং সেই রুমে সব তথ্য পাওয়ার সুবিধাও তাদের ছিল।
ইরানের সবচেয়ে বড় প্রক্সি হিজবুল্লাহরও প্রায় একই রকম দশা। ইসরাইলের সঙ্গে সংঘাতের মধ্যেই হঠাৎ একদিন হিজবুল্লাহ সদস্যদের অনেকগুলো পেজার একসঙ্গে বিস্ফোরিত হয়। মোসাদ এতগুলো পেজারে যে বিস্ফোরক স্থাপন করে রেখেছিল, তা হিজবুল্লাহর মতো বিশাল বাহিনীও টের পায়নি।
আরেকটি হচ্ছে তাদের প্রধান হাসান নাসরুল্লাহর হত্যা। গাজায় যখন হামাসপ্রধান ইয়াহিয়া সিনওয়ারকে হত্যা করা হয়, তখন ইসরাইল ভেবেছিল, কোনো এক সাধারণ হামাস যোদ্ধাকে তারা মেরেছে। সিনওয়ারের অবস্থান সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণাই ছিল না।
অন্যদিকে হাসান নাসরুল্লাহর অবস্থান কেবল শনাক্ত করা নয়, বেশ কিছুদিন ধরে তাকে অনুসরণ করছিল মোসাদ গোয়েন্দারা। তিনি কোন টানেলে থাকতেন, সেটিও ইসরাইল জানত। তাকে হত্যার দিন ইসরাইল তার গাড়িকে অনেক দূর থেকে অনুসরণ করে যখন নিশ্চিত হয় যে, তিনি টানেলে প্রবেশ করেছেন, তখনই বাঙ্কার ব্লাস্টার বোমা ফেলে পুরো টানেল গুঁড়িয়ে দেয়। নিহত হন নাসরুল্লাহ।
এত কিছু বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে, ৭ অক্টোবরের পরে ইরানি গোয়েন্দা ব্যবস্থা কীভাবে বারবার উলঙ্গ হয়েছে, তার একটি চিত্র তুলে ধরা। অথচ ইরানের চিরশত্রু যেখানে ইসরাইল; যাদের গোয়েন্দা সংস্থা পুরো দুনিয়ায় সবচেয়ে চৌকশ; সেখানে ইরানের টিকে থাকার জন্য তো একটি শক্তিশালী গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক থাকা আবশ্যক। সেটা ছিলও ইরানের। এর আগে ইসরাইলের হাতে ইরানি বেশ কয়েকজন পারমাণু বিজ্ঞানী নিহত হয়েছেন সত্য; কিন্তু কখনোই এত সিনিয়র মিলিটারি জেনারেলরা নিহত হননি। ইরানের সবচেয়ে বড় প্রক্সি হিজবুল্লাহও গোয়েন্দাবৃত্তির দিক থেকে কখনো এত বাজেভাবে ধরাশয়ী হয়নি।
ইসরাইল আর হিজবুল্লাহ ২০০৬ সালে বড় ধরনের যুদ্ধ করে। সেই যুদ্ধে ইসরাইলের চেয়ে বরং হিজবুল্লাহর গোয়েন্দা সংস্থাই বেশি চমক দেখিয়েছিল। ইসরাইল অনেক চেষ্টা করেও নাসরুল্লাহর কেশাগ্র স্পর্শ করতে পারেনি তখন। বরং হিজবুল্লাহই এক ইসরাইলি যুদ্ধজাহাজ ধ্বংস করে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। তাহলে কী এমন হলো এই কয়েক বছরে, যার ফলে ইরান ও হিজবুল্লাহর গোয়েন্দা সংস্থা এরকম নাজুক অবস্থায় পড়ে গেল? আমি এখানে এর বাস্তব বা কৌশলগত অবস্থাটি তুলে ধরছি।
গত দশকের শুরুর দিকে আরব বসন্তের যে ঢেউ শুরু হয়, তা আরও অনেক দেশের মতো তা এসে লাগে সিরিয়া ও ইয়েমেনে। এ দুটি দেশই ইরানের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ইরানের আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের জন্য কৌশলগতভাবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য ছিল সিরিয়ার আসাদ সরকারকে টিকিয়ে রাখা। অন্যদিকে ইয়েমেনের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ইরানের সামনে সুযোগ আসে শিয়া গোষ্ঠীগুলোকে ক্ষমতাবান করা, যাতে সে তার আরেক শত্রু সৌদি আরবকে শক্তভাবে চ্যালেঞ্জ করতে পারে একেবারে সৌদির সীমান্ত থেকে। কিন্তু দুটির একটি কাজও সহজ ছিল না।
সিরিয়ার বিদ্রোহীরা একপর্যায়ে আসাদ সরকারকে ফেলে দেওয়ার একেবারে কাছাকাছি চলে যায়। আলেপ্পোসহ সিরিয়ার বেশির ভাগ শহর বিদ্রোহীদের হাতে চলে আসে। ফলে ইরান একেবারে বেপরোয়া হয়ে যায় আসাদকে টিকিয়ে রাখার জন্য। তার সবচেয়ে শক্তিশালী প্রক্সি ফোর্স হিজবুল্লাহকে আসাদের পক্ষে যুদ্ধ করতে পাঠায়। অবশেষে আসাদ সরকারকে টিকিয়ে রাখতে সমর্থ হয় ইরান। অন্যদিকে ইয়েমেনে ইরান-সমর্থিত হুথিরা যখন ব্যাপকভাবে জয়ী হওয়া শুরু করে, তখন সৌদি বলয়ের আরব রাষ্ট্রগুলো চিন্তিত হয়ে পড়ে। সৌদি ও আরব আমিরাতের বিমানবাহিনী একদিকে ইয়েমেনের শিয়া নিয়ন্ত্রিত এলাকায় লাগাতার বোমা হামলা করে, অন্যদিকে হুথিবিরোধী গ্রুপগুলোকে অস্ত্র ও রসদ সববরহ করা হয়। ফলে ইয়েমেনে তার প্রভাব টিকিয়ে রাখতে ইরানও ব্যাপকভাবে হুথিদের পৃষ্ঠপোষকতা করতে থাকে।
এ দুই দেশে ইরানের যুদ্ধ বেশ কয়েক বছর ধরে চলে। পুরোটা সময়ই ইরান তার বেশির ভাগ সামরিক বাহিনী-সম্পদ-গোয়েন্দা সংস্থা ও মনোযোগ সেখানে ব্যয় করে। স্বাভাবিকভাবেই তার সবচেয়ে বড় শত্রু ইসরাইলের প্রতি মনোযোগ ব্যাপকভাবে কমে যায়। আমার ধারণা, ইসরাইল এ সুযোগেরই সদ্ব্যবহার করে। ইরানের সরে যাওয়া মনোযোগের সুযোগ নিয়ে মোসাদ উভয়ের (ইরান ও হিজবুল্লাহ) ভেতরেই ব্যাপকভাবে অনুপ্রবেশ করে। আর মনোযোগ অন্যদিকে থাকায় ইরানিরা পৃথিবীর সবচেয়ে চৌকশ গোয়েন্দা সংস্থার এই অনুপ্রবেশ যথাযথভাবে ধরতে পারেনি। আস্তে আস্তে মোসাদ গোয়েন্দারা বহু হাই সিকিউরড জায়গায় পৌঁছে যায়। ফলে আজ ইরান ও হিজবুল্লাহ গোয়েন্দা ক্ষেত্রে এরকম দুরবস্থায় পড়েছে।
ইসরাইল অনেক আগে থেকেই এসব জায়গায় কাজ করছে বলে আমার বিশ্বাস। তারা শুধু উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষা করছিল। এমনটাও হতে পারে, মোসাদ এখনো তার খেল দেখানো শেষ করেনি। ইরানের সঙ্গে যদি ইসরাইলের সত্যিকার যুদ্ধ লেগে যায়, তাহলে হয়তো এর চেয়েও ভয়াবহ ব্যর্থতা দেখা যেতে পারে ইরানের পক্ষ থেকে।
ইশফাক ফারহান সিয়াম : গবেষক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জর্জটাউন ইউনিভার্সিটি
