Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

ট্রিটি অব টর্ডেসিলাস : পোপের অনুমোদনে উপনিবেশের যাত্রা

Icon

সাইফুল খান

প্রকাশ: ২১ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ট্রিটি অব টর্ডেসিলাস : পোপের অনুমোদনে উপনিবেশের যাত্রা

ইতিহাসের কোনো কোনো চুক্তি কাগজে লেখা থাকে, কিন্তু বাস্তব রচিত হয় রক্ত আর আগুনে। ‘ট্রিটি অব টর্ডেসিলাস ১৪৯৪’ সেই ধরনের এক ঐতিহাসিক চুক্তি। সারা দুনিয়াকে দুই ভাগে ভাগ করে দেওয়া হয় ইউরোপের দুই সাম্রাজ্যের মধ্যে। এ চুক্তির মাধ্যমে মানবজাতির একটি বড় অংশকে দাসত্ব, দখল ও লুণ্ঠনের ভাগ্যবরণে বাধ্য করেছিল।

এ চুক্তিকে অনেক গবেষক ‘ইউরোপিয়ান উপনিবেশিকবাদের ভূরাজনৈতিক ভিত্তি’ মনে করেন। এটি ছিল এক পবিত্রতাসম্পন্ন ধ্বংসযজ্ঞের সূচনা। যেখানে পোপ, রাজা, নাবিক ও বন্দুক একসঙ্গে বিশ্বমানচিত্র আঁকতে বসেছিল। ইউরোপের প্রথম উপনিবেশ ছিল আফ্রিকা মহাদেশের দেশ মরক্কোর সিউটা বন্দর। ১৪১৫ সালে পর্তুগাল এটি দখল করে। তবে উপনিবেশ আনুষ্ঠানিক বৈধতা পায় ধর্মীয়ভাবে পোপের অনুমোদনে ১৪৯৪ সালে।

চুক্তির প্রেক্ষাপট : পোপের আশীর্বাদে ভূমি দখলের বৈধতা

পোপ আলেকজান্ডার ষষ্ঠের মধ্যস্থতায় স্পেন ও পর্তুগালের মধ্যে ১৪৯৪ সালে এ চুক্তি হয়। চুক্তিতে বলা হয়-আফ্রিকার পশ্চিম থেকে আমেরিকা পর্যন্ত এক কাল্পনিক রেখার পূর্বের সব ভূমি থাকবে পর্তুগালের এবং পশ্চিমের সব ভূমি স্পেনের! এ রেখা কোনো আদিবাসী, স্থানীয়, জাতি, সভ্যতা বা সংস্কৃতির অস্তিত্ব স্বীকার করেনি। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ওয়াল্টার মিগনোলো বলেন, টর্ডেসিলাস কেবল একটি চুক্তি ছিল না, এটি ছিল জ্ঞানগত সহিংসতাকে বৈধতা দেওয়ার মুহূর্ত। যেখানে ইউরোপ ঠিক করে দেয়, কে মানুষ হিসাবে গণ্য হবে, আর কে হবে না। চুক্তির ফলে স্থানীয় জনগোষ্ঠী হয়ে পড়ে অদৃশ্য। তাদের ভূমি, সংস্কৃতি, বিশ্বাস ও শরীর-সব হয়ে ওঠে প্রয়োজনের বস্তু বিশেষ।

ট্রিটি থেকে উপনিবেশ : দখলের প্রতিযোগিতার সূচনা

এ চুক্তির পরই শুরু হয় দুনিয়া দখলের ইউরোপীয় প্রতিযোগিতা। স্পেন ও পর্তুগাল দখল করে লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা ও এশিয়া। পরে ব্রিটেন, ফ্রান্স, হল্যান্ড ও বেলজিয়াম প্রবেশ করে সেই খেলায়। একেকটি ইউরোপীয় রাষ্ট্র হয়ে ওঠে একেকটি ‘লুণ্ঠনের সাম্রাজ্য।’

ইউরোপের ‘সভ্যতা’র পায়ের নিচে দুনিয়ার মানবাধিকার

চুক্তি-পরবর্তী ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলো বিশ্বজুড়ে যে নিপীড়ন, দাসব্যবসা, সম্পদ লুট, ভাষা নিধন চালিয়েছে, তার সবই হয়েছিল ওই পাটাতনের ওপরে দাঁড়িয়ে। আফ্রিকার চলেছিল কাটা হাত, কাটা কান; বেলজিয়ামের রাজা দ্বিতীয় লিওপোল্ডের অত্যাচার। আমেরিকায় হয় আদিবাসী গণহত্যা। এশিয়ায় চলে ‘ভাগ করে শাসন করা’, ‘অর্থনৈতিক শোষণ,’ ‘মিশনারি সহিংসতা।’ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ফ্রাঞ্চ ফ্যানন। তিনি বলেন, উপনিবেশবাদ কেবল একটি জাতিকে শৃঙ্খলে আবদ্ধ করেই সন্তুষ্ট নয়...এটি শোষিত জাতির অতীতে ফিরে যায়, তা বিকৃত করে, বিকলাঙ্গ করে এবং ধ্বংস করে দেয়।

কিছু ভালো কাজ : স্বার্থের প্রয়োজনে ‘উন্নয়ন’

ইউরোপীয় সাম্রাজ্যগুলো তাদের উপনিবেশে রেললাইন, টেলিগ্রাফ, প্রশাসন, স্কুল গড়েছিল। কিন্তু সেগুলোর উদ্দেশ্য ছিল নিজের অর্থনীতি ও শাসনব্যবস্থার সুবিধা নিশ্চিত করা। ভারতের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেন, ব্রিটিশরা রেলপথ নির্মাণ করেছিল সৈন্য ও কাঁচামাল স্থানান্তরের জন্য, ভারতকে ঐক্যবদ্ধ বা উপকৃত করার জন্য নয়। তাই ‘উন্নয়ন’ যা উপনিবেশিক শাসনে এসেছিল, তা অংশবিশেষ জনগণের জন্য ‘ঘটনাক্রমিক কল্যাণ।’। আসল লক্ষ্য ছিল শাসকের প্রয়োজন মেটানো।

উপনিবেশের উত্তরাধিকার : রাষ্ট্র তৈরি হলেও মুক্তি মেলেনি

আজকে অনেক উপনিবেশ দেশ স্বাধীন হয়েছে কিন্তু তাদের রাষ্ট্রব্যবস্থা, ভাষা, প্রশাসন, শিক্ষা এবং ‘মাস্টার-সাবজেক্ট’ সম্পর্কের ধরন আজও বহন করে টর্ডেসিলাসের রেখা।

তাই এনগুগিওয়া থিওনগো বলেন, ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার হলো সেই মানসিক মানচিত্র, যা আমরা এখনো ব্যবহার করি বিশ্বকে এবং নিজেকেও সংজ্ঞায়িত করার জন্য। শেষ কথা : ট্রিটি অব টর্ডেসিলাস ইতিহাসে কেবল দুই রাষ্ট্রের মধ্যে ভূখণ্ড ভাগের দলিল নয়। এটি ছিল বিশ্বমানবতার বিরুদ্ধে ইউরোপীয় অসভ্যতার ঘোষিত যুদ্ধের প্রথম প্রহর। এটি সেই রাক্ষুসে হাত, যা মানবতার বুক থেকে তার ভূখণ্ড ছিনিয়ে নেয় পোপের আশীর্বাদে। আজও সেই মানসিকতা বিশ্বায়নের ছদ্মবেশে বহন করছে আধুনিক সাম্রাজ্যবাদ। ট্রিটি অব টর্ডেসিলাস শেষ হয়নি। এটি শুধু রূপ বদলেছে : ক্রুসেডার থেকে করপোরেশনে, তলোয়ার থেকে শেয়ারবাজারে।

সাইফুল খান : ইতিহাস, রাজনীতি ও আন্তর্জাতিকবিষয়ক বিশ্লেষক

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম