আসামির কাঠগড়ায় শিল্পীদের ভিড়
বিনোদনজগতের ঝলমলে রঙিন আলোর বাইরে তারকাদের অচেনা একটি চেহারাও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশের আদালত প্রাঙ্গণে ক্রমশ দৃশ্যমান হচ্ছে। যেসব মুখ পর্দা, রেড কার্পেট, স্টুডিও সেট কিংবা সিনেমার প্রিমিয়ারে দেখা যায়, তাদেরই অনেকে কখনো অভিযোগের দায়ে, কখনোবা প্রতিপক্ষের করা মামলায়, আবার কখনো রাজনৈতিক কারণে দাঁড়াচ্ছেন আদালতের কাঠগড়ায়। বিচারের জন্য আদালতে তারকার উপস্থিতি তাই এখন আর বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং শোবিজ অঙ্গনের বাস্তবতা ও অদৃশ্য চাপের এক প্রতিচ্ছবি। বিস্তারিত রয়েছে এ প্রতিবেদনে।
রিয়েল তন্ময়
প্রকাশ: ১৮ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
একটা সময় বাস্তবে বিনোদন জগতের শিল্পীদের দেখা পাওয়া ছিল স্বপ্নের মতো। সময়ের পরিবর্তনে তা এতটাই সহজলভ্য হয়েছে যে, শিল্পীরা এখন হাতের নাগালে। চাইলেই শুধু দেখা নয়, একটু ছুঁয়ে দেওয়ার ইচ্ছেটাও পূরণ হয়ে যায় ভক্তদের। ইন্টারনেটের সহজলভ্যতায় এখন মুহূর্তেই তারকাশিল্পীদের সব আপডেট জানতে পারেন ভক্তরা। এমনকি শিল্পীরা নিজে থেকেই ভক্তদের সঙ্গে দেখা করার সময় কিংবা তারিখও জানিয়ে দেন। শুধু তাই নয়, এখন শিল্পীরা অভিনয়ের বাইরে শো’রুম উদ্বোধন করতেও ব্যস্ত থাকেন। যত ফিতা কাটবেন, ততই টাকা। শিল্পীর দায়বোধ ও দায়িত্বজ্ঞানের বাইরে গিয়ে টাকাই যেন এখন সবকিছু। তাই তো শাবানা, ববিতারা আজ শুধুই উদাহরণ হিসাবে ইতিহাসের পাতায় রয়ে গেছেন। তাদের পরে কিছুটা শিল্পীসত্তা নিয়ে ইন্ডাস্ট্রি থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন নব্বই দশকের শাবনূর, মৌসুমী, পূর্ণিমাসহ ওইসময়ের একাধিক শিল্পী।
সাম্প্রতিক সময় যেন শিল্পাঙ্গনে বিরাজ করছে এক অস্থিরতা। একদিকে ভালো কাজের অভাবে ইন্ডাস্ট্রি ধুঁকছে, অন্যদিকে শিল্পীরা জড়াচ্ছেন বিতর্কে। হামলা, মামলার শিকার হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন আদালত প্রাঙ্গণে। কাটছে কারাগারে রাত। যা শিল্পীর সম্মানহানির পাশাপাশি ইন্ডাস্ট্রিকেও ফেলে দিচ্ছে হুমকির মুখে। সাম্প্রতিক সময়ে তারকাদের বিরুদ্ধে চুক্তি ভঙ্গ, পারিশ্রমিক নিয়ে বিরোধ, সিনেমা মুক্তির অধিকার, কনটেন্ট মালিকানা, রাজনৈতিক কারণ কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায় মানহানির মতো বিষয়ে নানা মামলা হচ্ছে। অন্যদিকে ব্যক্তিগত সম্পর্ক, বিবাহবিচ্ছেদ, সম্পত্তি বা এমনকি পারিবারিক নিরাপত্তা নিয়েও তারকারা আইনি জটিলতায় পড়ছেন। দাঁড়াচ্ছেন আসামির কাঠগড়ায়। এসব থেকে প্রতিকারের জন্য তাদের ছুটতে হচ্ছে আদালত প্রাঙ্গণে। শোবিজের ভেতরকার চাপ, পেশাগত অনিশ্চয়তা এবং ডিজিটাল যুগে বাড়তি নজরদারি, সব মিলিয়ে এ প্রবণতা আরও প্রকট হয়ে উঠছে।
অনেকে বলেন, সোশ্যাল মিডিয়ার বিস্ফোরণ তারকাদের ব্যক্তিগত জীবনকে এমনভাবে উন্মুক্ত করে দিয়েছে, ছোটখাটো বিষয়ও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে। সেখানে কটূক্তি, চরিত্রহনন কিংবা গুজব ছড়ানোর ঘটনাও বাড়ছে। অনেক তারকা অভিযোগ করছেন, গুজব থামাতে কিংবা নিজের মর্যাদা রক্ষায় আইনের আশ্রয় নেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একাধিক জনপ্রিয় শিল্পী তাদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরাসরি জানিয়েও দিয়েছেন, বিনা কারণে অপবাদ বা ভুয়া তথ্য ছড়ালে মামলা করতে তারা বাধ্য হবেন। অপরদিকে নির্মাতা ও প্রযোজকদের সঙ্গে অন্যায় চুক্তি, অসম্পূর্ণ পেমেন্ট বা কাজ আটকে যাওয়ার মতো জটিলতাও তারকাদের আদালত পর্যন্ত টেনে নিয়ে যায়।
সিনেমা ও নাটক নির্মাণে স্বচ্ছ চুক্তিপত্রের অভাব দীর্ঘদিনের সমস্যা। শুটিং শিডিউল ভঙ্গের অভিযোগ নিয়ে শিল্পীদের বিরুদ্ধে যেমন মামলা হয়, তেমনি অসম্পূর্ণ পারিশ্রমিক বা চুক্তির অপব্যবহার নিয়ে শিল্পীরাও আইনি লড়াই শুরু করেন। তারকার জনপ্রিয়তা যত বিস্তৃত, তাদের ওপর দায়-দাবি কিংবা প্রত্যাশাও তত বড়। এ অদৃশ্য চাপ আদালত পর্যন্ত গড়ায় অনেক সময়। যেসব ঘটনা সাধারণ মানুষের জীবনে নীরবে ঘটে, তারকার ক্ষেত্রে সেগুলো আলোচনার ঝড় তোলে। ফলে তাদের ব্যক্তিগত মামলা জনসম্মুখে চলে আসে এবং সামাজিক চাপ আরও বেড়ে যায়।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আদালত প্রাঙ্গণে তারকাদের উপস্থিতি বাড়ার পেছনে একটি ইতিবাচক দিকও আছে, মানুষ এখন বুঝতে পারছেন, আইন সবার জন্য সমান। তারকারা আইনি প্রতিকার চাইছেন মানেই শোবিজ অঙ্গনে আইনের প্রয়োগ ও অধিকার বিষয়ে সচেতনতা তৈরি হচ্ছে। একইসঙ্গে অযথা গুজব, অনলাইন হয়রানি বা পেশাগত প্রতারণার বিরুদ্ধে শিল্পীরা আগের চেয়ে সাহসীভাবে দাঁড়াচ্ছেন।
সম্প্রতি কিছু ঘটনায় দেখা যায়, মামলার আসামি হয়ে আদালত প্রাঙ্গণে ছুটছেন শিল্পীরা। গণমাধ্যমেও সে খবর প্রকাশ হচ্ছে। এতেও বাড়ছে শিল্পী-সাংবাদিকদের মধ্যে বিরোধ। কাজের খবর প্রকাশে শিল্পীরা যতটা খুশি হচ্ছেন, ঠিক ততটাই বিরক্ত হচ্ছেন তাদের অপকর্মের খবর প্রকাশ করায়। ‘ভিত্তিহীন নিউজ’ দাবি করে সরাসরি সাংবাদিকদের অভিযুক্ত করছেন তারকারা। যা মোটেও পেশাদারত্বের লক্ষণ নয়। বর্তমানের অধিকাংশ শিল্পীর মধ্যেই এ ধরনের আচরণ লক্ষ্য করা গেছে। সিনিয়রদের মতে, একসময়ের শিল্পীরা শুধু ভালো অভিনয় করতেন না, তারা ভালো মানুষ ছিলেন। তাদের মধ্যে ভদ্রতার পরিচয় পাওয়া যেত। সাংবাদিকবান্ধব শিল্পীর সংখ্যাই বেশি ছিল। তাই নাটক-সিনেমায় সুষ্ঠু ও সুন্দর একটি পরিবেশ ছিল। যা এখনকার অধিকাংশ শিল্পীর মধ্যেই নেই। তারা সাংবাদিকবান্ধব হয়ে উঠতে পারছে না। শিল্প টিকিয়ে রাখতে শিল্পীর পাশাপাশি সাংবাদিকদের ভূমিকাও অপরিসীম, এটা অনেক তারকা আজ অহংকারের কারণে মেনে নিতে পারছে না। পান থেকে চুন খসলেই তারা আজ সাংবাদিকদের হেয় করে কথা বলে তাদের শিল্পী পরিচয়কেই খাটো করছে।
এদিকে সম্প্রতি আদালত প্রাঙ্গণে ছুটতে দেখা গেছে টিভি নাটকের জনপ্রিয় নায়িকা মেহজাবীন চৌধুরীকে। ব্যবসায় অংশীদার করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ২৭ লাখ টাকা ‘আত্মসাৎ করা ও হত্যার হুমকি দেওয়ার’ অভিযোগে অভিনেত্রী এবং তার ভাই আলিসান চৌধুরীর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়। এ খবর গণমাধ্যমে প্রকাশের পর অভিনেত্রী আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন নেন। এদিকে নাটকের আরেক জনপ্রিয় অভিনেত্রী তানজিন তিশার বিরুদ্ধেও উঠেছে শাড়ি প্রতারণার অভিযোগ! গত ৫ নভেম্বর এ অভিনেত্রীর বিরুদ্ধে প্রতারণা ও বিশ্বাসভঙ্গের অভিযোগ এনে একটি মামলা দায়ের করেন এক নারী উদ্যোক্তা। এছাড়া এ অভিনেত্রীর নামে ১২ নভেম্বর রাজধানীর গুলশান থানায় প্রাণনাশের হুমকির অভিযোগ এনে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন আরও এক নারী উদ্যোক্তা ও ফ্যাশন ডিজাইনার। চিত্রনায়িকা অপু বিশ্বাসের বিরুদ্ধে ২০২৪ সালে প্রতারণার অভিযোগে একটি মামলা করেছিলেন প্রযোজক সিমি ইসলাম কলি। এছাড়া চলতি বছরে ভাটারা থানায় আরও একটি হত্যাচেষ্টা মামলা হয় এ অভিনেত্রীর নামে। পরে আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন নেন অপু বিশ্বাস। চিত্রনায়িকা নুসরাত ফারিয়াও ভাটারা থানায় দায়ের করা একটি হত্যাচেষ্টা মামলায় গ্রেফতার হন। সে মামলায় একদিন কারাভোগও করতে হয় এ অভিনেত্রীকে। পরে জামিনে মুক্ত হন। এছাড়া আরেক সমালোচিত নায়িকা পরীমনি মাদক মামলায় জেল খেটেছেন ১৯ দিন। এখনো নিয়মিত আদালত প্রাঙ্গণে যেতে হয় সাক্ষ্য দিতে। এছাড়া রাজনৈতিক কারণে দেশের শোবিজ অঙ্গনের প্রায় শতাধিক শিল্পীর বিরুদ্ধে হয়েছে মামলা। এরমধ্যে কেউ কেউ কারাগারে আছেন, কেউ কেউ আবার পালিয়ে গেছেন বিদেশে।
প্রশ্ন থেকে যায়, এ পরিস্থিতি কি শুধুই তারকাদের জীবনের প্রতিফলন, নাকি বিনোদনশিল্পের ভেতরের কাঠামোগত দুর্বলতার চিহ্ন? স্বচ্ছ চুক্তি, নির্ভরযোগ্য প্রযোজনা ব্যবস্থা, সোশ্যাল মিডিয়ায় দায়বদ্ধতা, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা এবং ডিজিটাল হয়রানির কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে না পারলে আদালত প্রাঙ্গণে তারকাদের ভিড় আরও বাড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
