
‘মা’ শব্দটি অনেক ছোট। কিন্তু এর চেয়ে মধুর শব্দ পৃথিবীতে আর নেই। সবকিছু বদলাতে পারে, কিন্তু মায়ের ভালোবাসা কখনও বদলায় না। প্রত্যেক সন্তানের জন্য মা এক অপার আশ্রয়স্থল। সেই মায়ের চিরন্তন রূপ পর্দায় খুব দক্ষতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেন অভিনেত্রীরা। মায়ের চরিত্রে যেসব অভিনেত্রীরা অভিনয় করেন তাদেরকে মায়ের শক্তি ও মমতাকে ধারণ করতে হয়।
পর্দার এমন কয়েকজন মা-কে নিয়েই বিশ্ব মা দিবস উপলক্ষ্যে লিখেছেন রিয়েল তন্ময়
আনোয়ারা
ষাটের দশকে বাংলা সিনেমায় অভিনয় শুরু করেন আনোয়ারা জামাল। তবে তার পরিচিতি আনোয়ারা বেগম নামেই। নানামাত্রিক চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করে জীবন্ত কিংবদন্তি এই অভিনেত্রী পেয়েছেন তুমুল জনপ্রিয়তা। তার অভিনয়ে মুগ্ধ হয়েছেন এ দেশের সব শ্রেণির দর্শক।
শুরুতে নায়িকা চরিত্রে অভিনয় করলেও পরবর্তীতে মায়ের চরিত্রেই পর্দায় বেশি উপস্থিত হয়েছেন। তার সাবলীল অভিনয় মন ছুঁয়েছে আট থেকে আশির বৃদ্ধকেও। লাইট, ক্যামেরা আর অ্যাকশনের শব্দের মুখরতায় কেটে গেছে তার জীবনের বেশির ভাগ দিন। তবে এখন আর তার দাঁড়ানো হয় না লাইট-ক্যামেরার সামনে। বার্ধক্যজনিত কারণে এখন অভিনয় থেকে দূরে তিনি।
আনোয়ারা বলেন, ‘অভিনয়ের জন্য রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেয়েছি নয়বার। এছাড়া অনেক সিনেমায় মায়ের চরিত্রে অভিনয় করার জন্য ‘মা পদক’ ও পেয়েছি। এটা সত্যিই অন্যরকম ভালোলাগার বিষয়। মানুষ আমাকে ভালোবাসেন। এক জীবনে এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কী থাকতে পারে!’
মায়ের চরিত্রে অভিনয় করা আনোয়ারার উল্লেখযোগ্য সিনেমা হচ্ছে ‘মায়ের স্বপ্ন’, ‘সমাধি’, ‘মায়ের হাতে বেহেস্তের চাবি’, ‘গোলাপি এখন ট্রেনে’, ‘মায়ের চোখ’, ‘দাঙ্গা’, ‘রাধা কৃষ্ণ’, ‘ভাত দে’, ‘বর্তমান’, ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ ইত্যাদি।
ডলি জহুর
ঢালিউড সিনেমার আরেক জনপ্রিয় মা হলেন ডলি জহুর। তার প্রথম সিনেমা ছিল ‘শঙ্খনীল কারাগার’। এ সিনেমায় ‘রাবেয়া’ চরিত্রে তার অনবদ্য অভিনয়ের জন্য তিনি অর্জন করেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার।
পরবর্তীতে হুমায়ূন আহমেদ পরিচালিত জনপ্রিয় সিনেমা ‘আগুনের পরশমণি’-তেও তিনি অভিনয় করেন।
তার মায়াভরা চোখ, সংবেদনশীল সংলাপ ও মাতৃত্বের আবেগময় রূপান্তর তাকে পরিণত করেছে বাংলা সিনেমা ও নাটকের ‘মায়ের প্রতিমূর্তি’ হিসেবে। মা চরিত্রে অভিনয় করেও জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেছেন তিনি।
দীর্ঘদিন ধরে মায়ের চরিত্রে দাপটের সঙ্গে বড় ও ছোটপর্দায় বিচরণ করছেন। আজ বিশ্ব মা দিবসেও বিশেষ সম্মাননায় ভূষিত হচ্ছেন এ অভিনেত্রী। মায়ের চরিত্রে তার অসামান্য অভিনয়গুণের জন্য এবার তিনি পাচ্ছেন ‘মা পদক’। সাংবাদিক অভি মঈনুদ্দীনের উদ্যোগে আলী-রূপা ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় গুণী এ অভিনেত্রীকে আনুষ্ঠানিকভাবে এই পদক তুলে দেওয়া হবে।
ডলি জহুর বলেন, ‘জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার থেকে শুরু করে আজীবন সম্মাননাসহ বহু পুরস্কারে আমি ভূষিত হয়েছি। কিন্তু শুধুমাত্র মায়ের চরিত্রে অভিনয়ের জন্য এমন কোনো স্বীকৃতি আগে পাইনি। তাই এই পুরস্কারটি আমার কাছে খুবই বিশেষ।’
দিলারা জামান
মায়ের চরিত্রে অনবদ্য এক অভিনেত্রীর নাম দিলারা জামান। একুশে পদকে ভূষিত এ অভিনেত্রী ৮১ বছর বয়সেও অভিনয় করছেন নিয়মিত। নাটক, সিনেমায় মায়ের ভ‚মিকায় অভিনয় করতে করতে মিডিয়ার সবার কাছে তিনি মা হিসাবেই সম্মান পেয়ে থাকেন। অসংখ্য নাটকের পাশাপাশি সিনেমায়ও অভিনয় করেছেন এ অভিনেত্রী।
ষাটের দশকে কেন্দ্রীয় চরিত্রগুলোতে অভিনয়ের মাধ্যমে ক্যারিয়ার শুরু করলেও পরবর্তীতে মা চরিত্রে পর্দায় জনপ্রিয় উঠেন তিনি। বর্তমানে নাটকেই তার বেশি ব্যস্ততা। ছোটপর্দায় মায়ের ভূমিকায় বেশি অভিনয় করে থাকেন তিনি, অনেক খ্যাতিও অর্জন করেছেন। পেয়েছেন মায়ের চরিত্রে অভিনয়ের জন্য মা পদক।
দিলারা জামান বলেন, ‘পর্দায় মায়ের চরিত্রে এতো বেশি অভিনয় করা হয়, এখন আমি সবারই মা। শুধু অভিনয়ের জন্য নয়, যাদের মা হচ্ছি পর্দায়, তাদেরকে সন্তানের মতো করেই দেখি। তারাও আমাকে সেই শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা দিচ্ছে।’
শাবানা
বাংলা সিনেমার কিংবদন্তি অভিনেত্রী শাবানা। তার প্রকৃত নাম আফরোজা সুলতানা রত্মা। অভিনয়ের শুরুটা সেই ষাটের দশকের শুরুতে ‘নতুন সুর’ সিনেমা দিয়ে। এহতেশাম পরিচালিত সেই সিনেমাতে অভিনয় করেন শিশুশিল্পী হিসেবে। এরপর বছর পাঁচেক পর নায়িকা হিসেবে তার অভিষেক হয় ‘চকোরী’ সিনেমাতে। একটানা কাজ করেছেন নব্বই দশকের শেষ সময় পর্যন্ত। তিনি তার ৩৬ বছর কর্মজীবনে ২৯৯টি সিনেমায় অভিনয় করেন।
তুমুল জনপ্রিয় এই নায়িকাকে ‘সত্যের মৃত্যু নেই’ সিনেমায় প্রথমবারের মতো মায়ের ভূমিকায় দেখা যায়। এই সিনেমায় খুব প্রশংসিত হন এই অভিনেত্রী। তবে মা হিসেবে অভিনয় করা সিনেমার সংখ্যা খুব একটা বেশি নয়। যেক’টি সিনেমায় মায়ের চরিত্রে অভিনয় করেছেন তা যেন আজও দাগ কেটে আছে দর্শক হৃদয়ে।
দীর্ঘ কর্মজীবনে তিনি অভিনয়ের জন্য নয়বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন এবং ২০১৭ সালে আজীবন সম্মাননায় ভ‚ষিত হন। বর্তমানে অভিনয়কে বিদায় জানিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন যুক্তরাষ্ট্রে। ২৫ বছর ধরে অভিনয় থেকে দূরে সরে আছেন এ অভিনেত্রী।
ববিতা
ঢাকাই সিনেমার কিংবদন্তি অভিনেত্রী ববিতা। তার পুরো নাম ফরিদা আক্তার পপি। ষাটের দশকের শেষ দিকে অভিনয় শুরু করেন তিনি। বলা যায়, সত্তরের দশকের সেরা অভিনেত্রী ছিলেন ববিতা। নায়িকা হিসেবে ববিতার প্রথম সিনেমা ছিল ‘শেষ পর্যন্ত’।
ক্যারিয়ার জুড়ে ববিতা তিনশো’র বেশি সিনেমায় অভিনয় করেছেন। সাতবার জাতীয় পুরস্কারজয়ী এ অভিনেত্রী নব্বই দশকের মাঝামাঝি এসে নিয়মিত মায়ের চরিত্রে অভিনয় করা শুরু করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘মহামিলন’, ‘মায়ের অধিকার’, ‘প্রাণের চেয়ে প্রিয়’, ‘অবুঝ বউ’, ‘খোদার পরে মা’, ‘মনের জ্বালা’, ‘সবাইতো ভালবাসা চায়’, ‘ওরা আমাকে ভালো হতে দিল না’।
২০১৬ সালে তাকে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের আজীবন সম্মাননা পুরস্কার প্রদান করা হয়। ববিতাকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বড় পর্দায় দেখা গেছে। নার্গিস আক্তারের ‘পুত্র এখন পয়সাওয়ালা’ ছিল তার সর্বশেষ মুক্তি পাওয়া সিনেমা। সিনেমার প্রস্তাব পান নিয়মিতই, তবে মনের মতো গল্প ও চরিত্র না পাওয়াতে আর অভিনয়ে দেখা যাচ্ছে না এ অভিনেত্রীকে। কিছুদিন আগেই ববিতা গণমাধ্যমে বলেন, অভিনয় তো করতে চাই, কিন্তু নায়কের মা কিংবা নায়িকার মা- এমন চরিত্রে নয়। এমন চরিত্র হতে হবে, যা পুরো গল্পে প্রভাব বিস্তার করবে।’
খালেদা আক্তার কল্পনা
মায়ের ভূমিকায় আরেকজন বেশ জনপ্রিয় অভিনেত্রী হচ্ছেন খালেদা আক্তার কল্পনা। তিনিও অনেক সিনেমাতে মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। ১৯৮৯ সালে ‘জিনের বাদশা’ সিনেমায় অভিনয়ের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব অভিনেত্রী বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। তিনিও অভিনেতা অভিনেত্রীদের কাছে মমতাময়ী মা হিসাবে পরিচিত।
সুচরিতা
ঢালিউডের জনপ্রিয় নায়িকা সুচরিতা নব্বই দশকের শেষে এসে মায়ের ভ‚মিকায় নিয়মিত অভিনয় শুরু করেন। চাষী নজরুল ইসলামের ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ সিনেমায় অভিনয় করে তিনি শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। সিনেমাটিতে দেশের জন্য নিজের সন্তানকে উৎসর্গের দৃশ্যটি দর্শকদের হৃদয়ে দাগ কেটে যায়।
এছাড়াও নাটক, সিনেমায় মায়ের চরিত্রে রূপদান করছেন এমন আরও অনেক অভিনেত্রী রয়েছেন। যারা মায়ের মমতা দিয়েই চরিত্রটিকে ফুটিয়ে তুলছেন প্রতিনিয়ত। সেসব অভিনেত্রীদের মধ্যে রয়েছেন রাশেদা চৌধুরী, ওয়াহিদা মলিক জলি, রেহানা জলি, শিল্পী সরকার অপু, চিত্রলেখা গুহ, মিলি বাশার, শারমিন আক্তার, সাবেরী আলম, রেবেকা রউফ, মনিরা মিঠু, সাবিহা জামান’সহ আরও অনেক অভিনেত্রী। এদের মধ্যে অনেকেই এখনও নিয়মিত নাটক ও সিনেমায় অভিনয় করছেন।