কোহিনুর আক্তার সুচন্দা।ছবি: সংগৃহীত
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ঢাকাই সিনেমার কিংবদন্তি অভিনেত্রী কোহিনুর আক্তার সুচন্দা। লাইট, ক্যামেরা, অ্যাকশনে বন্দি একসময়ের দারুন ব্যস্ত এ অভিনেত্রীর এখন সময় কাটে ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে। সিনেমাপর্দা থেকে দুরে আছেন বহু বছর। পারিবারিক কাজের পাশাপাশি কিছু অনুষ্ঠানে অবশ্য অংশ নেন। তবে সময়টা নিজ বাসাতেই কাটাতে ভালোবাসেন তিনি।
ঢাকাই সিনেমায় নন্দিত একটি নাম কোহিনূর আক্তার সুচন্দা। ১৯৭০ ও ৮০-এর দশকে অনেক ব্যবসা সফল সিনেমায় অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি গড়েছেন এক স্বতন্ত্র পরিচয়। তার অভিনয়ের স্বতন্ত্রতা ও দক্ষতা বাংলাদেশের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিকেও সমৃদ্ধ করেছে। বাংলা সিনেমার সঙ্গে সুচন্দার গোটা পরিবার ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তার আপন দুই বোন ববিতা ও চম্পা- দুজনও সমৃদ্ধ করেছেন ঢাকাই সিনেমাকে। ব্যক্তিজীবনে সুচন্দা এ দেশের কিংবদন্তি চলচ্চিত্র পরিচালক জহির রায়হানের সহধর্মিণী।
১৯৬৪ সালে প্রখ্যাত অভিনেতা কাজী খালেকের একটি প্রামাণ্যচিত্রে প্রথম কাজ সুচন্দার। ১৯৬৬ সালে সুভাষ দত্ত পরিচালিত ‘কাগজের নৌকা’ সিনেমা দিয়ে বড়পর্দায় অভিষেক হয়। একই বছরে মুক্তি পায় এ অভিনেত্রীর আরও দুটি সিনেমা, সালাহ উদ্দিন পরিচালিত ‘রুপবান’ ও জহির রায়হান পরিচালিত ‘বেহুলা’। রাজ্জাকের বিপরীতে ‘বেহুলা’ সিনেমায় অভিনয় করে তিনি আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা পান।
এরপর তার দর্শকপ্রিয় সিনেমার মধ্যে উলেখযোগ্য কয়েকটি হচ্ছে- ‘জীবন থেকে নেয়া’, ‘চাওয়া পাওয়া’, ‘কুচবরণ কন্যা’, ‘ধীরে বহে মেঘনা’, ‘নয়নতারা’, ‘সুয়োরানী দুয়োরানী’, ‘আনোয়ারা’, ‘আয়না ও অবশিষ্ট’, ‘যে আগুনে পুড়ি’, ‘মনের মত বউ’, ‘কুচবরণ কন্যা’, ‘কথা দিলাম’, ‘যোগ বিয়োগ’, ‘ফুলের মতো বউ’, ‘জীবন তৃষ্ণা’, ‘কাচের স্বগর্’, ‘অশ্রু দিয়ে লেখা’, ‘দুই ভাই’, ‘বিচার’, ‘গলি থেকে রাজপথ’, ‘মনের মতো বউ’, ‘দুই ভাই’ প্রভৃতি। তাছাড়া পাকিস্তানের বেশ ক’টি সিনেমাতেও অভিনয় করেন এবং সেখানে পুরস্কৃত হন।
১৯৯২ সালে তিনি জহির রায়হান পরিচালিত ‘জীবন থেকে নেয়া’ সিনেমায় অভিনয়ের জন্য আন্তর্জাতিক পুরষ্কারও অর্জন করেছেন। ১৯৭২ সালে মস্কো ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে তিনিই প্রথম বাংলাদেশের পতাকা গর্বের সঙ্গে নিজ হাতে উড়িয়েছিলেন এবং শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরষ্কার নিজের দখলে নিয়েছিলেন। শুধু অভিনয় করেই থেমে থাকেননি। পরবর্তীতে নাম লিখিয়েছেন প্রযোজনা ও পরিচালনাতেও। তার স্বামী জহির রায়হানের জীবদ্দশায় ‘টাকা আনা পাই’ ও ‘প্রতিশোধ’ সিনেমা দুটি প্রযোজনা করেন। এছাড়াও ‘তিন কন্যা’, ‘বেহুলা লখিন্দর’, ‘বাসনা’ ও ‘প্রেম প্রীতি’ সিনেমা প্রযোজনা করেছেন এ অভিনেত্রী। তার পরিচালিত প্রথম সিনেমা ‘সবুজ কোট কালো চশমা’।
২০০৫ সালে স্বামী জহির রায়হানের ‘হাজার বছর ধরে’ উপন্যাস অবলম্বনে একই শিরোনামে সিনেমা নির্মাণ করেন এবং সেরা প্রযোজক ও পরিচালক হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। এরপর সিনেমার অবস্থা মন্দা হতে শুরু করলে চরম ক্ষোভ নিয়ে এ জগৎ থেকে দূরে সরেন তিনি।
চোখ আর হাসির অদ্ভুত মেশালে দর্শক হৃদয়ে রাজ করছেন দীর্ঘ ছয় দশক। সংসারধর্ম আর বয়সজনিত কারণে এখন সিনেমার সঙ্গে তার দূরত্ব আরও বেড়েছে। তবে তার জনপ্রিয়তা এবং ভক্তদের ভালোবাসা অটুটই রয়ে গেছে। অনেক নবীন শিল্পীই প্রেরণা। বর্তমানে তিনি ঢাকায় বসবাস করছেন এবং নিজের মতো করে সময় কাটান। সিনেমার বাইরে তিনি পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটাতে পছন্দ করেন। অনেক সময় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। যদিও তিনি বড় পর্দার কাজ থেকে একেবারে সরে এসেছেন, তবে মাঝে মাঝে টেলিভিশন অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে উপস্থিত হন, যা তার ভক্তদের জন্য এক বড় উপহার।
মাঝে কিছুদিন অসুস্থ ছিলেন, চলতি বছরের শুরুতেই নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতাল পর্যন্ত যেতে হয়েছিল তাকে। তবে এখন সুস্থ আছেন বলেই জানিয়েছেন। পরিবারের সঙ্গে তার দিন কাটছে। সিনেমা থেকে দূরে থাকলেও, সূচন্দার সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড এবং সমাজসেবামূলক কাজে তার ব্যস্ততা অব্যাহত রয়েছে।
২০১৯ সালে তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের আজীবন সম্মাননায় ভূষিত হন সুচন্দা। ৬০ বছরের দীর্ঘ ক্যারিয়ার প্রসঙ্গে অভিনেত্রী বলেন, ‘ছোট্ট এই জীবনে চলার পথে পেয়েছি দর্শকের অকুণ্ঠ ভালোবাসা। এটাই আসলে জীবনের অনেক বড় প্রাপ্তি। সিনেমার সোনালি দিন নিয়ে যখন ভাবি, তখন ভাবনায় চলে আসে বর্তমান সিনেমার কথা। আমাদের সময় অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যে মেধাবী পরিচালকরা, অভিনয়শিল্পীরা তাদের সেরা কাজটুকু উপহার দিয়েছেন। বর্তমানে যেসব তরুণ পরিচালক সিনেমা নির্মাণ করছেন তাদের ওপরই নির্ভর করছে আমাদের ঢাকাই সিনেমার ভবিষ্যৎ। কারণ আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মধ্য দিয়ে তরুণ নির্মাতারা তাদের ভালোবাসা ও প্রচেষ্টা দিয়ে নিশ্চয়ই ভালো ভালো সিনেমা উপহার দিতে পারবেন। আমি সর্বোপরি সিনেমার মঙ্গল চাই।’
