|
ফলো করুন |
|
|---|---|
সকাল ছয়টা, ঘড়ি বেজে উঠতেই মারিয়া উঠে অফিসের জন্য রেডি হতে আমিও উঠে গেলাম। ঘুম থেকে উঠেই প্রতিদিন কমপক্ষে দুই ঘন্টা লেখালিখি করার অভ্যাসটি হয়েছে ছয় মাস ধরে।
আজ একটি জটিল লেখাতে হাত দিয়েছিলাম, তা শেষ করতে হঠাৎ সকাল দশটা বেজে গেছে, বাজারে যেতে হবে। ফ্রেশ সিফুড কিনতে হবে কারণ আজ ডিনারে ইতালিয়ান পাসতা সঙ্গে সিফুড। ভাবতে অবাক লাগে জন্মের পর থেকে ১৯ বছর অবধি ভাবনাতে আসেনি কখনও রান্না করতে হবে বা ভাবতে হবে কি খাবো দুপুরে বা রাতে।
এখন কি খাবো শুধু তাই না, কি বাজার করবো এবং কি রান্না করবো এটা একটি দৈনিক রুটিনের মধ্য পড়েছে। বাংলা খাবার আমি খেতে পছন্দ করি তা ছাড়া থাই, ভিয়েতনামী, স্প্যানিশ, সুইডিস, মেক্সিকান, ইতালিয়ান খাবার রান্না করতেও শিখেছি। জোর জুলুম করে কিছু করা আর পছন্দ করে কিছু করার মধ্যে যে বিশাল একটি ব্যবধান আছে তা আমি বেশ অনুভব করি এখন। আশ্চর্য! মনে হচ্ছে এই তো সেদিনের কথা।
বাংলাদেশে কাজের লোক এটা করবে, কাজের লোক সেটা করবে, আর আমরা করবো কি? একটু পড়াশোনা করা, খাবার টেবিলে বসে একটু খাবার খাওয়া, একটু খেলাধুলা করা বা আড্ডা মারা, তারপর টানা ঘুম, ব্যাস শেষ হয়ে গেল দিনটি। আমরা অন্যকে দিয়ে নিজেদের কাজ করাতে বেশ পছন্দ করতাম, কারণ কাজের লোকের তো অভাব ছিল না তখন।
ছোট বেলায় শীতের সময় লেপের মধ্যে বসে পড়তে বেশ মজা ছিল। যতক্ষণ পর্যন্ত বইয়ের পাতা উল্টাতে না হতো। ঠান্ডার মধ্যে হাত বের করে পাতা উল্টানো ছিল এক কঠিন কাজ। কি করি! বাড়ির কাজের ছেলের সঙ্গে চুক্তি হলো যে সে কাছে বসে থাকবে আর যখন পাতা উল্টানোর দরকার তখন সে পাতা উল্টাবে।
প্রতিদিন তাকে এক টাকা দেবো চুক্তি হয়েছে। সকালে যে তার নানা কাজ রয়েছে বা মা জানলে তার যে খবর আছে সঙ্গে আমারও, তা আমার বা তার বোধগম্য হয়নি।
এদিকে এক টাকা এক্সট্রা রোজগার করা তার জন্য বিরাট ব্যাপার। আমার আবার দিনের শেষে টাকাটা জোগাড় করতে হবে। বিপদ! সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত চেষ্টা করেছি কিন্তু টাকার সন্ধান মেলেনি। টাকা না দিলে তো কাজের ছেলে বইয়ের পাতা উল্টাবেনা? কার পকেট মারব! আবার ধরা খাব এবং ধরা খেলে তো মান সম্মান যাবে! কি যে করি! যাইহোক টাকা ম্যানেজ হয়নি। কাজের ছেলের কাছে তিন টাকার দেনা, সে আমার কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে, উপায় কি? সমাধান খুঁজতে হবে। শেষে পাটকাঠি দিয়ে লেপের ভেতর থেকে পাতা উল্টানোর পদ্ধতি বের করলাম। তবে ছোটরা আমার বুদ্ধিটি দিব্বি নকল করে শিখে নিলো যা আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারি নি তখন।
কারণ এত কষ্ট করে বুদ্ধিটা বের করলাম আমি আর তারা বিনা চেষ্টায় এবং বিনা খরচে সব জেনে নিলো! ঘটেছে এসব ঘটনা ছোট বেলায় বাংলাদেশে। আজ বসবাস করছি বরফের দেশে অথচ সব কিছুই অভ্যাসে পরিনত হয়েছে।
কোথায় সেই অলসতা? সে অলসতা আর নেই। হঠাৎ রান্নাবান্না ছেড়ে অনেক দূরে এবং অন্য কথায় চলে গিয়েছিলাম। যাইহোক অভ্যাস বা প্রাকটিস যাই বলি না কেন, দরকারে বা বিপদে বা সমস্যা যখন জীবনে হাজির হয় তখন আমরা বাধ্য হই তার সমাধান খুঁজতে। বিশ্বাস না হবারই কথা, যা আমি লিখছি উপরে যে আমি রান্না করতে পছন্দ করি।
উপায় নেই গোলাম হোসেন, তাই রান্না থেকে শুরু করে থালাবাটি ধোঁয়া, ঘর দুয়ার পরিস্কার করা, বাজার করা, লন্ড্রিকরা, বাসার টয়লেট পরিষ্কার করা, গাড়ি চালানো, সব করতে হয় ফ্রি অব চার্জ।
শুধু আট ঘন্টা অফিসে যে কাজ করি তার জন্য বেতন পেয়ে থাকি। বাকি কাজ বিনা পয়সায় করতে হয়। কাজগুলো করতে কষ্ট কম হয় পছন্দের সঙ্গে করি বলে। জীবনের অনেক কঠিন কাজ, যে কাজে কোন মজা নেই কিন্তু তার গুরুত্ব রয়েছে সমাজের কাছে, অন্যের কাছে, তাও করতে হয়।
আমি না করলে আরেকজন করবে বা করছে। হয়তো অনেকে করছে না কারণ তারা অন্যকে টাকা দিয়ে তা ম্যানেজ করছে, যেমনটি আমি ছোটবেলাতে কাজের ছেলেকে দিয়ে ম্যানেজ করতে চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু অর্থের অভাবে ব্যর্থ হয়েছিলাম। কি হতো যদি আমি সেদিন টাকা ম্যানেজ করতে সক্ষম হতাম চুরি করে হোক বা অন্য কোন উপায়ে! আমি কাজের ছেলের ওপর নির্ভরশীল হয়ে যেতাম এবং হয়তো দুর্নীতির মাধ্যমে টাকা রোজগার করে তাকে বেতন দিতাম।
কিন্তু যেহেতু সম্ভব হয়নি তা সেদিন, তাই বাধ্য হয়েছিলাম সমাধান খুঁজতে। সেদিনের সেই সমাধানের কারণে আজ প্রায় চল্লিশ বছর ধরে বরফের দেশে ম্যানেজ করে চলতে শিখেছি। তার মানে সেদিনের সেই সমাধান আজও কাজে লাগছে, বল্লে কি ভুল হবে মনে হয়? না। পাঠক, শিক্ষা কি? কেন আমরা শিখি? এবং তার জন্য যে শিক্ষাঙ্গণে যেতে হবে তেমন বাধ্যতামূলক বলে কিছু আছে কি? জীবন চলার জন্য পুঁথিগত বিদ্যার সঙ্গে দরকার রয়েছে দৈনিক শিক্ষার যা আমরা পেয়ে থাকি বা পেতে পারি আমাদের পরিবেশ বা আশপাশ থেকে।
আমি আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে চাই, ‘লেসন লার্নড’ কথাটি সম্বন্ধে যা জীবন চলার পথে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ফার্মাসিউটিক্যালস ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করতে হয়তো স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশিক্ষণের দরকার ছিল। একই সঙ্গে ছোটবেলার সেই সমস্যাগুলো যা সমাধান করতে শিখেছিলাম এখন কিন্তু তা কাজে লাগছে।
আমার ছোট বেলার জীবনের পাওয়া দু:খ কষ্ট আমাকে যে শিক্ষা দিয়েছিল, তা পরে বিদেশে আসার পর কাজে লেগেছে। যেমন যে কাজগুলো তখন কাজের ছেলেমেয়ে করতো দেশে, তা আমি আজ নিজে করি বা করতে পছন্দ করি এখানে। আরেকটি জিনিস জানা দরকার তা হলো অন্যায় বা দুর্নীতি কিন্তু ছোটবেলার অভ্যাস যা হয়তো আমরা ভাবিনা। আমরা মনে করি দুর্নীতি শুধু কাজে বা অফিসে হয়।
আমার ছোটবেলার বিলাসিতার কারণে আমি কিন্তু দুর্নীতিগ্রস্ত হয়েছিলাম। যদি প্রতিনিয়ত ঐ একই সমাজে দারিদ্রতার মধ্যে থেকে জীবন গড়তে হতো জানিনে আমি দুর্নীতিমুক্ত জীবন গড়তে পারতাম কিনা! শিক্ষাঙ্গণে লেখাপড়ার সঙ্গে আমাদের যে দৈনিক শিক্ষা বলে একটি স্কুল রয়েছে, সে স্কুলের শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী কে? সে বিষয়টিও ভাবতে হবে। কিভাবে আমরা নিতে এবং দিতে পারি সেই দৈনিক শিক্ষা যা হতে হবে সুশিক্ষা, যাতে করে ছোটবেলা থেকেই আমাদের নতুন প্রজন্ম যেন সঠিক এবং সরল পথ খুঁজে পায়। আমার জীবনের কিছু কথা যা আমি বিশ্বাস করি এবং পছন্দ করি এখনও, তাই শেয়ার করলাম - শেয়ার ভ্যালু হিসেবে।
