বিবেক যখন তার প্রতিরক্ষা ক্ষমতা হারায়
রহমান মৃধা, সুইডেন থেকে
প্রকাশ: ২৯ জুন ২০১৯, ০৫:৪৭ পিএম
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
শুনে আশ্চর্য এবং বিরক্তবোধ করছি। কী শুনে? শিক্ষিত হয়ে লাভ কি হবে যদি দায়িত্ববোধ এবং জ্ঞান না থাকে। যদি বলি দায়িত্ববোধ এবং জ্ঞান দিয়ে কি হবে যদি শিক্ষা না থাকে? দায়িত্ববোধ কি?
কিভাবে তা যাচাই করা যাবে? কেন আমরা শিক্ষিতদের ওপর সব দোষ বা গুণ চাপিয়ে দিতে ব্যস্ত? আমরা কি কখনও ভেবেছি শিক্ষার মূল্যবোধ কী? হোক না সে শিক্ষা পুথিগত বা পুথিগতের বাইরের শিক্ষা। পৃথিবীতে আছে কি কেউ যে সত্যিকারে অশিক্ষিত? আমরা ভালো মন্দ কিছু হলেই শিক্ষাকে টেনে আনতে পছন্দ করি। জ্ঞানকে দোষারোপ করি, দায়িত্ববোধের অভাব বলি।
কিন্তু আসল কারণ কি সত্যিই দায়িত্ববোধের অভাব? নাকি অন্য কিছু যেমন মূল্যবোধ? ভেবেছি কি কখনও যে সব কিছুর মূলে আমাদের কর্মের ফল (যা হতে পারে ভালো কিংবা মন্দ) দায়ী? লেখায় শুধু প্রশ্ন করলে হবে না। প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে। তার আগে জানতে হবে শিক্ষিত এবং অশিক্ষিত বলতে আমরা কি বোঝাতে চাই। আমাদের জন্মের শুরুতেই আমরা শিক্ষার সঙ্গে জড়িত।
যেমন শিশুর ক্ষুধা পেয়েছে, মা কিভাবে বুঝবে? শিশু কেঁদে দিল। এখন কাঁন্নার অনেক কারণ থাকতে পারে। বুকের দুধ মুখে তুলে দিলো, ব্যাস কাঁন্না থেমে গেলো। মানে ক্ষুধার কারণ ছিল শিশুর কাঁন্না। শিশুর কাঁন্নার রোল মাকে শিখালো যে খেতে দিতে হবে। হাঁটতে পারে না শিশু না খেয়ে আছাড়। কথা বলতে শেখার আগে পর্যন্ত কাঁন্নাকাটি, আকার ইংগিতের মধ্য দিয়ে শিশুর ইচ্ছা-অনিচ্ছার প্রকাশ ঘটে। পরে কথা বলার মাধ্যমে। একইভাবে বাবা-মা নানাভাবে শিশুকে বিভিন্ন বিষয় শেখাতে শুরু করে। তার মানে আমি বুঝাতে চাচ্ছি যে জন্মের শুরু থেকে মৃত্যু পর্যন্ত আমরা সবাই শিক্ষার্থী। তাহলে আমরা কেউ কি অশিক্ষিত? নিশ্চয় না। তবে কি কারণে আমরা বলি শিক্ষিত হয়ে কি হবে যদি দায়িত্ববোধ না থাকে? আমাকে কি কেউ 'দায়িত্ববোধ ছিল না' বা 'নেই' এমন একটি মানুষ দেখাতে পারবে?
পৃথিবীর সব মানুষই শিক্ষিত, তাই তারা তাদের দায়িত্ববোধ এবং জ্ঞান ব্যবহার করছে প্রতিক্ষণ, প্রতিদিন, প্রতিমাস, প্রতি বছর। হঠাৎ মুরগীর মাংস খেতে ইচ্ছে হলো, আমার আর্থিক অবস্থা ভালো, তাই হুট করে একটি মুরগী কিনে তাকে জবাই করে রান্না করে খেলাম। কিন্তু একটি প্রাণীর জীবন মূহুর্তে চলে গেলো। এখানে দায়িত্ববোধ বা জ্ঞানের সমস্যা আছে কি? আরেক জনেরও একই ইচ্ছে হয়েছে। সেও মুরগীর মাংস খেতে চায় কিন্তু তার সামর্থ্য নেই।
কিন্তু সে মুরগীর মাংস খাবেই খাবে! কি করলো, সে নিজের দায়িত্বে অন্য একজনের একটি মুরগী রাতের আঁধারে চুরি করে এনে জবাই করার পর রান্না করে খেলো। এখানে অবৈধভাবে সে খেলো।
এ ক্ষেত্রে কি দায়িত্ববোধ বা জ্ঞানের সমস্যা আছে? শিক্ষার অভাব আছে? না নেই। তাহলে এখন পরিস্কার যে শিক্ষা, দায়িত্ববোধ, বিবেক, জ্ঞান এর সব কিছু আছে বিধায় আমরা যার যা ইচ্ছে তাই করছি। এখন আমাদের কর্মের ফল কখনও কারো জন্য ভালো আবার কারো জন্য মন্দ হয়ে থাকে। এই ভালো মন্দের প্রতিফলন নির্ভর করছে আমাদের কর্ম এবং আচরণের ওপর।
আচরণের নিয়ন্ত্রণ করা নির্ভর করছে অবস্থার উপর। অনেকের ধারণা যদি কারো পুঁথিগত বিদ্যা না থাকে তাহলে তাকে শিক্ষিত বলা যাবে না। কিন্তু পুঁথিগত বিদ্যা তো আলাদা বিষয়। যেমন ধরি কেউ ডাক্তার হবে। সে ডাক্তার হয়ে চিকিৎসার ওপর বিশেষজ্ঞ হলো এবং সে তার পুঁথিগত বিদ্যা দিয়ে তার দায়িত্ব-কর্তব্য এবং জ্ঞান কাজে লাগিয়ে চিকিৎসার কাজ ঠিক মতো করছে।
এখানেও কিন্তু দায়িত্ববোধ বা জ্ঞানের সমস্যা দেখছিনা। আবার ধরি আমি বিয়ে করেছি। বউ মাকে পছন্দ করছে না। ঠিক আছে আমি মাকে বাড়ি থেকে বের করে দিলাম। বউকে খুশি করতে দায়িত্ব পালন করেছি। এখানেও দায়িত্ববোধ বা জ্ঞানের সমস্যা নেই। সমস্যা হলো সিদ্ধান্তে, একজন খুশি অন্যজন ক্ষতিগ্রস্ত। এখন মা ক্ষতিগ্রস্ত বিধায় মায়ের পক্ষের লোক আমাকে অমানুষ, দায়িত্বহীন, বিবেকহীন ইত্যাদি বলবে।
আবার অন্যদিকে বউয়ের কথামতো বা তাকে খুশি করতে মাকে বাড়ি ছাড়া করেছি এর জন্য বউ খুশি হয়েছে এবং বউয়ের পক্ষের লোকেরাও খুশি হয়েছে। আমরা আমাদের শিক্ষা, দায়িত্ববোধ, জ্ঞান সবই কাজে লাগিয়ে কিন্তু আমরা প্রতিদিন বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিচ্ছি। এখন নিশ্চিত করতে হবে আমাদের সিদ্ধান্তের ফলাফলকে। মানুষ জাতির সবচেয়ে বড় চালেঞ্জ হচ্ছে তার আচরণ।
যে বা যারা আচরণকে ম্যানেজ করতে অক্ষম হয়েছে, সে বা তারা মনুষ্যত্বের অবক্ষয় ঘটিয়েছে। আর এ মনুষ্যত্বের অবক্ষয়ের কারণে সমাজে মানবের সঙ্গে চলছে দানবের লড়াই। কখন,কোথায়, কিভাবে কী করতে হবে এর জন্য দরকার পদ্ধতির। পদ্ধতির ওপর যারা চর্চা করছে তাদের আচরণে প্রশ্ন কম, ভাবনা বেশি। একটি উদাহরণ দিই। আমাদের শারীরিক দিকটা নিয়ে একটু আলোচনা করতে পারি।
ধরা যাক, প্রতিদিন আমরা যে খাবার বা তরল পদার্থ শরীরে ঢোকাচ্ছি, শরীর তার মতো করে যা যেখানে দরকার পৌঁছে দিচ্ছে। হঠাৎ যা শরীরের জন্য ভালো না, এমন পদার্থ আমাদের অজান্তে শরীরে ঢুকে পড়ে; তখন শরীর কী করে? শরীর সঙ্গে সঙ্গে অসুস্থ হয়ে পড়ে, খাবারের রুচি নষ্ট করে এবং শরীরের ভেতরের সব বের করতে চেষ্টা করে। কারণ শরীর তার নিজের প্রতিরক্ষা ক্ষমতার গুণে যা মন্দ সেটা ত্যাগ করে।
মাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়া জ্ঞানের অজান্তে ঘটে যাওয়া ঘটনা নয়। আমাদের কী করণীয় সে ক্ষেত্রে? শরীর যেমন তার প্রতিরক্ষা ক্ষমতা দিয়ে শরীরের অসুস্থতাকে দূর করে। আমাদের মনুষ্যত্বে ঠিক তেমন করে বিবেক রয়েছে, এখন এই বিবেককে কাজে লাগানো শিখতে হবে। বিবেককে কাজে লাগানোর পদ্ধতি হচ্ছে আমাদের প্রতিরক্ষা ক্ষমতা। কিন্তু যদি সে দায়িত্ববোধ বা জ্ঞান আমাদের মনের মধ্যে না আসে তবে শিক্ষার দোষ দিলে লাভ হবে না। বরং দোষ দেয়া যেতে পারে মনুষ্যত্বের অবক্ষয়কে, যে কারণে হচ্ছে মানবতার ধ্বংস।
আমাদের কর্মে যদি খারাপ চিন্তা, খারাপ চর্চা বা মন্দের পরিমাণ বেশি হতে থাকে তখন বিবেক তার প্রতিরক্ষা ক্ষমতা হারাতে থাকে। এমনই একটি ঘটনা কয়েকদিন আগে পড়েছি যেখানে মাকে আইনের মধ্যে ফেলে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে পরিস্কার যে বিবেক তার ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে, ফলে যা খুশি তা করতে দ্বিধাবোধ করছে না। দুর্নীতি, চুরি, মিথ্যা বলা এসবের জন্য শিক্ষা, দায়িত্ববোধ বা জ্ঞানের দোষ দিয়ে আমরা নিজেরা দানবের মতো আচরণ করতে শুরু করেছি। মানুষ কখন দানব হয়, তাকে দেখতে কেমন?
দেখতে যদি সত্যি ইচ্ছে করে তবে আয়নার সম্মুখে দাঁড়াতে হবে। কাঁচের আয়না নয়, মনের আয়নার সম্মুখে। মনের আয়নায় নিজেকে দেখতে হলে বিবেককে সামনে আনতে হবে। বিবেক যদি এখনও দানবের মত আচরণ না করে থাকে তবে তাকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। বিবেক যখন তার প্রতিরক্ষা ক্ষমতা হারায় তখন ধ্বংস হয় মনুষ্যত্বের। তখনি সে দানব আকার ধারণ করে! সুশিক্ষা, আত্মবিশ্বাস, ভালোকর্ম, ভালো আচরণ এবং সর্বপরি মূল্যবোধের সমন্বয়ে বিবেক তার প্রতিরক্ষা ক্ষমতা বাড়াতে পারে। শুধু বিশ্বাস রাখতে হবে নিজের কর্মের এবং আত্মবিশ্বাসের ওপর।
