Logo
Logo
×

পরবাস

দক্ষিণ কোরিয়ায় বাংলাদেশি দূতাবাসে মতবিনিময়

কৃষিখাতে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বাংলাদেশের করণীয় নিয়ে গবেষকদের প্রস্তাবনা

Icon

দ্বীন মোহাম্মদ দিপু, পিএইচডি রিসার্চার, কিংপুক ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, দক্ষিণ কোরিয়া

প্রকাশ: ১৬ জুলাই ২০২০, ০৩:২৪ পিএম

কৃষিখাতে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বাংলাদেশের করণীয় নিয়ে গবেষকদের প্রস্তাবনা

দক্ষিণ কোরিয়ায় নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত আবিদা ইসলামের সভাপতিত্বে মতবিনিময় অনুষ্ঠানে অংশ নেয়া গবেষক ও শিক্ষার্থীরা। ছবি: সংগৃহীত

করোনাভাইরাসের প্রকোপে ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশের অর্থনীতির পুনরুদ্ধার এবং এক্ষেত্রে কৃষিখাত কিভাবে ভূমিকা রাখতে পারে এ বিষয়ে দক্ষিণ কোরিয়ায় দূতাবাসের সঙ্গে বাংলাদেশী গবেষক ও শিক্ষার্থীদের মতবিনিময় অনুষ্ঠিত হয়েছে। 

দক্ষিণ কোরিয়ায় নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত আবিদা ইসলামের সভাপতিত্বে বাংলাদেশ হাউসে মতবিনিময় অনুষ্ঠানে অংশ নেন ইহুআ ওয়মান্স ইউনিভার্সিটির রিসার্চ প্রফেসর ড. মো. জামাল উদ্দিন, ভেটেরিনারি গবেষক ড. ফজলে এলাহি, ড. মাহবুবুর রহমান, পিএইচডি গবেষক শক্তি চন্দ্র মণ্ডল, অনিরুদ্ধ সরকার। এছাড়া দূতালয় প্রধান স্যামুয়েল মুর্মুসহ দূতাবাসের কর্মকর্তারা এসময় উপস্থিত ছিলেন।  

গত ৪ জুলাই অনুষ্ঠিত ওই মতবিনিময় সভায় কৃষি ও প্রাণিসম্পদ বিষয়ে দক্ষিণ কোরিয়ায় গবেষণারত ও উচ্চশিক্ষায় অধ্যয়নরত বাংলাদেশী গবেষক ও শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করেন।  

বাংলাদেশে করোনা মহামারীর বর্তমান পরিস্থিতি ও জাতীয় অর্থনীতিতে এর বিরূপ প্রভাব সম্পর্কে আলোকপাত করেন এবং এ হতে উত্তোরণের জন্য সম্ভাব্য কর্মপরিকল্পনা কী হতে পারে সে বিষয়ে মতামত ব্যক্ত করেন গবেষকরা। কোভিড-১৯ মহামারীর কারনে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান দুই খাত-রফতানি ও রেমিট্যান্স ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ায় এবং এর ফলে দেশে বেকারত্ব ও দারিদ্র্য বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকায় এ পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য দেশের কৃষি খাতকে অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করতে হবে বলে আলোচকগণ মত প্রকাশ করেন।

এ লক্ষ্যে কৃষি খাতকে আধুনিকীকরণ, বাংলাদেশ ও দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে কৃষি খাতে সহযোগিতা সম্প্রসারণসহ সরকারের পক্ষ হতে কৃষি সংক্রান্ত যুগোপযোগী ও কার্যকর নীতি ও কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের ওপর আলোচকরা জোর দেন। এছাড়া কোভিড-১৯ মহামারী প্রতিরোধে দক্ষিণ কোরিয়ার সফলতার প্রেক্ষিতে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রযুক্তি ও চিকিৎসা সামগ্রী বাংলাদেশে রফতানিসহ এ বিষয়ে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার ওপর জোর দেয়া হয়।  

আলোচকরা কৃষি গবেষকদের নীতিমালা সংক্রান্ত বিষয়ে বিভিন্ন মেয়াদী প্রস্তাবনা রাষ্ট্রদূতের নিকট উপস্থাপন করেন।
নিম্নে তা দেয়া হলো-

► বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহে কোরিয়ায় গবেষণারত বাংলাদেশী গবেষকদের সরাসরি অথবা কনসালটেন্ট হিসেবে নিয়োগ দেয়া যেতে পারে। 

গবেষণার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও দক্ষিণ কোরিয়ার গবেষকরা যৌথভাবে গবেষণা (Collaborative research) কর্ম পরিচালনা করতে পারেন। 

 বাংলাদেশের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ ও দক্ষিণ কোরিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের মধ্যে সমঝোতা স্মারক সম্পন্ন করা যেতে পারে যাতে প্রতি বছর বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা এদেশে পড়াশোনা ও গবেষণা করার সুযোগ গ্রহণ করতে পারেন। Korea International Cooperation Agency (KOICA)  বাংলাদেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করে আসছে। যেহেতু কোরিয়ায় গবেষণারত বাংলাদেশী গবেষকদের একইসঙ্গে বাংলাদেশ ও কোরিয়া সম্পর্কে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা থাকে, সেক্ষেত্রে KOICA-এর প্রকল্পসমূহ সঠিকভাবে প্রনয়ণ ও বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কোরিয়ায় গবেষণারত বাংলাদেশী গবেষকদের  KOICA-এর কর্মসূচিসমূহে সংযুক্ত করা যেতে পারে।    

 বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে বিদেশে গবেষণারত বাংলাদেশী গবেষকদের অভিজ্ঞতা, প্রকাশনা, প্রোফাইল ইত্যাদির ভিত্তিতে অগ্রাধিকার প্রদান করা যেতে পারে। বিশেষ করে নবগঠিত কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে/বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে। বিদেশে গবেষণারত বাংলাদেশী গবেষকগণ যদি তাদের গবেষণালব্ধ অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানোর উদ্দেশ্যে নিজ উদ্যোগে বাংলাদেশে গবেষণা প্রতিষ্ঠান/ল্যাব প্রতিষ্ঠা করতে আগ্রহী হন  সেক্ষেত্রে সরকার হতে প্রয়োজনীয় আইনি সহায়তা ও প্রণোদনা প্রদান করা যেতে পারে। 

 চাষাবাদে সহায়তার জন্য প্রান্তিক কৃষকদের প্রয়োজনীয় কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহের মাধ্যমে সহায়তা প্রদান করা যেতে পারে।  উল্লেখ্য যে, হাওড় অঞ্চলে শস্য সংগ্রহের সময় খুবই স্বল্প হয়ে থাকে। অতএব, স্বল্প সময়ের মধ্যে ফসল সংগ্রহ করা জরুরি হয়ে পড়ে নতুবা বন্যার দরুন ফসলের ক্ষতি হওয়ার আশংকা থাকে। 

এছাড়া বর্তমানে কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে মৌসুমি কৃষি শ্রমিকদের লভ্যতাও সীমিত হয়ে যাচ্ছে। এরূপ পরিস্থিতিতে ফসল সংগ্রহের জন্য সরকারি সহায়তায় কৃষকদের মাঝে ব্যাপকহারে প্রযুক্তির ব্যবহার (বিশেষতঃ কম্বাইন্ড হারভেস্টার) নিশ্চিত করা আবশ্যক এবং এক্ষেত্রে সরকারের নীতিমালা প্রনয়ণ করা প্রয়োজন। 

► দক্ষিণ কোরিয়ায় বিভিন্ন মাছের ফিলেট (fillet) জনপ্রিয়। এক্ষেত্রে বাংলাদেশে পাঙ্গাস মাছের উৎপাদন বেশি হওয়ায় এ মাছ দক্ষিণ কোরিয়ায় রফতানি করার উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। এছাড়া দক্ষিণ কোরিয়ায় ফলের মধ্যে কাঁঠালের জনপ্রিয়তা রয়েছে যা ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড প্রভৃতি দেশ হতে আমদানি করে থাকে।  

অতএব, বাংলাদেশে কাঁঠালের যথেষ্ট উৎপাদন হওয়ায় তা রফতানি করার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। বাংলাদেশে এসব কৃষি পণ্যের উৎপাদন ব্যাপক হলেও এগুলো উৎপাদন ও রফতানির জন্য প্রয়োজনীয় নির্দিষ্ট নীতির আওতায় বাণিজ্যিক কাঠামোর মধ্যে আনা আবশ্যক। যেসব কৃষি পণ্যের দক্ষিণ কোরিয়ায় ব্যাপক চাহিদা রয়েছে সেসব কৃষি পণ্য কোরিয়ার উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় ও নির্দেশনা অনুসরণ করে বাংলাদেশে উৎপাদন করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে ফসল উৎপাদনের জন্য কোরিয়ার অনুসৃত উৎপাদন পদ্ধতিসমূহ অনুসরণ করা যেতে পারে। বাংলাদেশের জমিতে তিন মৌসুমের ফসল উৎপাদন করার সুযোগ থাকায় এসব ফসল (সবজি) বাংলাদেশে ব্যাপকহারে উৎপাদন করে কোরিয়ায় রফতানি করা যেতে পারে।

► বাংলাদেশে ফিরে আসা প্রবাসী শ্রমিকগণ নিজ এলাকায় গবাদি পশুর খামার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নিজেদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে নিতে পারেন। তবে খামার হতে উৎপাদিত পণ্য বাজারজাতকরণে প্রথাগত পদ্ধতি অনুসরণ করার কারনে এবং বাজারে মধ্যস্বত্বভোগীদের উপস্থিতির কারনে উৎপাদনকারীরা ন্যায্য মূল্য হতে বঞ্চিত হচ্ছেন। 

এছাড়া বিদেশ হতে কৃষি পণ্য আমদানি করার ফলে বাজারে এর সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় মূল্য হ্রাস পাচ্ছে। ফলশ্রুতিতে, আয়ের তুলনায় উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ায় খামারিরা খামার  পরিচালনা করার উৎসাহ হারিয়ে ফেলছেন।

সরকারি উদ্যোগে প্রায় প্রতিটি জেলায় খামার রয়েছে কিন্তু যথাযথ তত্ত্বাবধানের অভাবে এ থেকে যথেষ্ট পরিমাণে উৎপাদন পাওয়া যাচ্ছে না। অতএব, এ সব খামারগুলোর সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচর্চা আবশ্যক।  দক্ষিণ কোরিয়ার প্রায় প্রতিটি হাসপাতালে আলাদা গবেষণা ইউনিট থাকে। এ সব ইউনিটসমূহে  রোগ ও ঔষুধ ও ভ্যাকসিন সম্পর্কে গবেষণা এবং নতুন ঔষুধ ও ভ্যাকসিন আবিষ্কার করার সুযোগ থাকে। বাংলাদেশের  হাসপাতালগুলোতেও এরূপ গবেষণা ইউনিট স্থাপন করা যেতে পারে যেখানে বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশী গবেষকগণ তাদের গবেষণার মাধ্যমে অবদান রাখতে পারেন।

কোভিড-১৯ মহামারীর প্রেক্ষাপটে দক্ষিণ কোরিয়ার অনেক প্রতিষ্ঠান copper shield উৎপাদন ও ব্যবহার করছে যা বাংলাদেশে রফতানি করা যেতে পারে। এটি বাংলাদেশের বিভিন্ন অফিসসমূহে কোভিড-১৯ সংক্রমণ প্রতিরোধে ব্যবহার করা যেতে পারে। বাংলাদেশে কোভিড-১৯ পরীক্ষার জন্য RT-PCR মেশিনের পর্যাপ্ততা সীমিত। 

এছাড়া, RT-PCR মেশিনের মাধ্যমে পরীক্ষার ফলাফলের সঠিকতা নির্ণয়ের হার শতকরা ৭০-৯০ ভাগ। RT-PCR এর মাধ্যমে পরীক্ষার ফলাফলের সঠিকতা শতভাগ নির্ণয়ের জন্য দক্ষ অপারেটর প্রয়োজন। এক্ষেত্রে দক্ষ বিশেষজ্ঞ যারা রয়েছেন তাদেরকে এটি পরিচালনার জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহে নিয়োগ প্রদান করা যেতে পারে।  

 কৃষি মন্ত্রণালয়, খাদ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশের কৃষি গবেষণা সংস্থাগুলির সঙ্গে একত্রীকরণের মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষি পণ্যের গুণমানের মূল্যায়ন ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সামগ্রিক সমাধান সম্পর্কে চিন্তা করতে পারে।

এমতাবস্থায়, "খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষি পণ্যের গুণগত মান উন্নয়ন ইন্সটিটিউট" দেশের প্রধান ফসলসমূহে ও রফতানিসম্ভাব্য কৃষিপণ্যে দূষিত ক্যামিক্যাল এবং কীটনাশক এর জন্য নিরাপদ মাত্রা নিশ্চিত করে ভবিষ্যতে কৃষি পণ্যগুলির  অনিরাপদ ব্যবহার রোধ করা সম্ভব হবে। দক্ষিন কোরিয়াতে বাংলাদেশী গবেষকগন এই ধরনের যৌথ আন্তর্জাতিক গবেষণায় সরাসরি সম্পৃক্ত থেকে অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশ থেকে কোরিয়াসহ উন্নত বিশ্বের বাজারে কৃষি পন্যের জন্য রফতানি ক্ষেত্র সৃষ্টি করতে পারে।

 দক্ষিণ কোরিয়ায় যারা কৃষি/ প্রাণিজ সম্পদ বিষয়ে গবেষণা করছেন তাদের ডাটাবেজ তৈরি ও সংরক্ষণ করা। উক্ত ডাটাবেজ বাংলাদেশে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সহযোগিতা করার মাধ্যমে পরবর্তী প্রয়োজনীয় কাজে ব্যবহার করা।

দক্ষিণ কোরিয়া করোনাভাইরাস কৃষিখাত

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম