টিকটক সমাচার: কী লাভ কী ক্ষতি? কেন এই রাজনীতি?
মোহাম্মদ তৌহিদ, (বেইজিং) চীন থেকে
প্রকাশ: ০৯ আগস্ট ২০২০, ০৪:৩৬ পিএম
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
সম্প্রতি বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় চীনের একটি অ্যাপলিকেশন দ্বিতীয় দফায় আলোচনায় উঠে এসেছে। এর আগে এই মোবাইল অ্যাপটির ওপর ব্যাপক নাখোশ হয়েছিল ভারত সরকার। খুবই সাধারণ মানের কিন্তু জনপ্রিয় এই অ্যাপের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের কী কী ক্ষতি হয়েছে এবং এই মোবাইল অ্যাপটি নিষিদ্ধ করার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে লাভবান হচ্ছে- তা জানার একটি সাধারণ ইচ্ছা জাগতেই পারে।
এমনকি মোবাইল অ্যাপ বন্ধ করতে স্বয়ং মার্কিন প্রেসিডেন্টকে এমন খড়গহস্ত কেন হতে হলো! কিছুটা বিস্ময়কর বৈকি! প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের দাবির পেছনে যুক্তিগুলো কী কী? আদৌ কোনও বাস্তবসম্মত কারণ আছে কি? এই শক্তি প্রদর্শনের রাজনৈতিক ‘ফায়দা’ কতখানি? সাধারণ এসব প্রশ্নের কিছুটা জবাব খোঁজার চেষ্টা করছি এখানে।
‘টিকটক’ অ্যাপটি চীনা সংস্থা বাইটড্যান্সের মালিকানাধীন অন্যতম জনপ্রিয় শর্ট ভিডিও প্ল্যাটফর্ম। এই মোবাইল অ্যাপলিকেশনটির বর্তমান সার্ভার যুক্তরাষ্ট্র ও সিঙ্গাপুরে স্থাপন করা হয়েছে। এ প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী বা সিইও একজন মার্কিন নাগরিক।
সম্প্রতি মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা ঝুঁকির অজুহাতে যুক্তরাষ্ট্রে অ্যাপটি বন্ধ হওয়ার পথে চলে যায়। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই অ্যাপ্লিকেশনটিকে পুরোপুরি নিষিদ্ধ করার হুমকি দেন। তবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে টিকটকের গোটা ব্যবসা দেশটির অন্য বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান মাইক্রোসফটের সঙ্গে সম্ভাব্য চুক্তির শর্তে তার ‘শেষরক্ষা’ হয়।
ওয়াশিংটনের আগ্রাসন ঠেকাতে টিকটক প্রাথমিকভাবে অনেক চেষ্টা করে। মার্কিন নাগরিকদের তথ্য যুক্তরাষ্ট্রের আওতায় রাখার জন্য টিকটকের তথ্যভাণ্ডার বা সার্ভার যুক্তরাষ্ট্রে সরিয়ে নেওয়া হয়। তারপরও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের হুমকি থেকে রক্ষা করা যায়নি। স্পষ্টতই যখন কোনও কিছুর সঙ্গে রাজনৈতিক ইস্যু যুক্ত হয়ে যায়, তখন যে কোনও বিষয়ে তথাকথিত রাজনীতিকরা আর যুক্তি খুঁজে পান না। ‘যারে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা’- অবস্থাটা এমনই।
আমরা দেখেছি টিকটকের বিরুদ্ধে বার বার যেসব অভিযোগ করা হচ্ছে, তার স্বপক্ষে কোনও বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না! মার্কিন প্রশাসনের কেউ কোনও প্রমাণও দেননি। তাহলে আমাদের অবশ্যই বুঝতে হবে যে, টিকটকের বিরুদ্ধে ট্রাম্প প্রশাসনের অভিযোগ মূলত অ্যাপটির ‘চীনা উৎসের’সঙ্গেই জড়িত।
ঠিক যেমন চীনা কোম্পানি হুয়াওয়েইর সঙ্গে আচরণ করছে আমেরিকা ও কানাডা। যেখানে "জাতীয় নিরাপত্তা সুরক্ষার" নামে জুজুর ভয় দেখিয়ে তার বিরুদ্ধে দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়ে যায়। সেখানেও অভিযোগের পক্ষে আজ পর্যন্ত কোনও প্রমাণ দেখতে পায়নি সাধারণ মানুষ! মজার ব্যাপার হলো, ‘প্রমাণহীন অভিযোগ’ বিচারের কাঠগড়ায় কোনও সাক্ষী হতেই পারে না। অথচ, শক্তির রাজনীতিতে প্রমাণহীন অভিযোগগুলোই (অপবাদ) এসব বলদর্পী রাষ্ট্রগুলোর অন্যতম চাল।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের চীন-বিরোধী-যুদ্ধে যুক্ত হয়েছেন হাই-প্রোফাইল কিছু সঙ্গী। যেমন, নিউ ইয়র্কের সিনেটর চক শুমার। যিনি শীর্ষস্থানীয় ডেমোক্র্যাট হয়েও ‘শত্রুর শত্রু বন্ধু’ এই নীতির আলোকে রিপাবলিকানদের সঙ্গে হাত মেলালেন। তিনি ট্রাম্পের নিষেধাজ্ঞার আহ্বানে সাড়া দিয়ে হোয়াইট হাউজের অভিযোগ মেনে নেন। যা কোনও বিরোধীদলের জন্য স্বাভাবিক নয়! ৪০ বছর ধরে গড়ে তোলা চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক যেন এসব রাজনীতিকের কাছে একেবারে ছেলেখেলা!
মূলত এ পরিস্থিতি ইচ্ছাকৃতভাবে তৈরি। চীন-যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যম ইস্যু, মানবাধিকার পরিস্থিতি, আর্থ-বাণিজ্যিক সংঘাত, প্রযুক্তিযুদ্ধ দীর্ঘদিন ধরেই চলে আসছে। বিগত চার দশকে এসব সমস্যা কাটিয়ে ওঠার একটা চেষ্টা দেখাও গিয়েছে। কিন্তু বর্তমান মার্কিন প্রশাসন অতীতের সব চেষ্টাই যেন অস্বীকার করতে চায়। যে কোনভাবে অতীত অগ্রাহ্য করে কাল্পনিকে স্নায়ুযুদ্ধ, অবৈজ্ঞানিক “আমেরিকা ফার্স্ট” নীতি, একতরফাবাদ ও একগুঁয়ে আচরণ করছে।
মার্কিন নীতি এখন এমন যে, রাশিয়া-চীন-ইরান সংশ্লিষ্ট যে কোনও অস্তিত্ব আর বিশ্বাসযোগ্য নয়। জনসাধারণের মধ্যে এ বৈষম্যমূলক চেতনার বীজ বদ্ধমূল করতে দেশে-দেশে ধারাবাহিক অপকৌশল বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এসব এখন শুধু চীন বা চীনা প্রযুক্তিতে সীমাবদ্ধ নয়; বরং সর্বত্র অনুশীলন করছে ওয়াশিংটন।
আবারও আসি টিকটক প্রসঙ্গে। টিকটকের মতো জনপ্রিয় সামাজিক অ্যাপ হস্তগত করতে পরিশেষে মাইক্রোসফট দিয়ে কাজ সারতে হলো দেশটিকে। ট্রাম্প বলেছেন, টিকটক বন্ধ করা হবে, কারণ এটি চীনের পণ্য! চাপ সামলাতে টিকটক তার সার্ভার যুক্তরাষ্ট্র ও সিঙ্গাপুরে সরিয়ে নেয়। বর্তমানে টিকটকের সিইও একজন মার্কিন নাগরিক। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বাণিজ্যিক উপদেষ্টা টিকটকের বিরুদ্ধে মার্কিন নাগরিকদের ব্যক্তিগত তথ্য চুরি করা এবং চীন সরকারের সঙ্গে তথ্য বিনিময় সম্পর্কে প্রকাশ্যে অভিযোগ করেন।
কিন্তু এ অভিযোগের কোনও প্রমাণ তারা দেয়নি। ওই বাণিজ্য উপদেষ্টা আগেও অভিযোগ করেছিলেন যে, চীন করোনাভাইরাস সৃষ্টি করেছে। ট্রাম্প ও তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও বলেছিলেন যে, উহানের একটি গবেষণাগার থেকে ভাইরাসটি এসেছে বলে তারা প্রমাণ পেয়েছে। তিনি বলেছেন, হুয়াওয়েই নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণ হতে পারে। বছরের পর বছর ধরে তারা শুধু অভিযোগই করছেন, কিন্তু কোনও প্রমাণ দেখাতে পারলেন না।
এবার আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সঙ্গে দেশটির প্রযুক্তিগত বহুজাতিকের কোম্পানির যোগাযোগটা কেমন তা বিশ্লেষণ করছি। মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে তথ্য বিনিময়ের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার অভিযোগ তোলা হয়েছে টিকটকের বিরুদ্ধে। অথচ, মার্কিন জাতীয় সুরক্ষা সংস্থার ডেটা সংগ্রহের প্রকল্পে দেশের গুগল, অ্যাপল, অ্যামাজন, ফেসবুক এবং মাইক্রোসফটের ভূমিকা সবটুকু কি আমরা জানি?
গণমাধ্যমের বদৌলতে যা জানা যায়, মাইক্রোসফট বা অ্যামাজন দেশটির কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে ৬০০ মিলিয়ন ডলারের ক্লাউড কম্পিউটিং চুক্তি রয়েছে। সেই সঙ্গে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ এবং এফবিআই গবেষণা কাজে অন্যতম প্রাথমিক অনুদানকারী কিন্তু টেক জায়ান্ট গুগল। অর্থাৎ দেশটির মাইক্রোসফট, গুগল, আমাজন আপনার-আমার মতো যাদের অ্যাকাউন্ট রয়েছে- সেসব তথ্য নিয়মিত গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে সরবরাহ করছে এসব প্রতিষ্ঠান। কারণ এটাই তাদের সহযোগিতা চুক্তির মূল কথা।
আশ্চর্যের বিষয় হলো টিকটকের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগের যথার্থতা প্রমাণিত না হলেও যুক্তরাষ্ট্র ভয়ঙ্কর রূঢ় আচরণ করেছে। অথচ নিজ দেশের শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানগুলোর আপত্তিকর আচরণ কিন্তু প্রশাসনের নজরে আসছে না। আর এটাই হলো দেশটির ডবল স্ট্যান্ডার্ড বা দ্বৈতনীতি।
যাই হোক, চলুন এবার প্রযুক্তিবিদদের কথা শুনি। সম্প্রতি ওয়াশিংটন পোস্টের এক প্রবন্ধে বলা হয়, একটি টিকটক অ্যাকাউন্ট খুলতে ফেসবুকের মতো এত বেশি ব্যক্তিগত তথ্য দিতে হয় না। পত্রিকাটি স্বীকার করেছে যে, টিকটক এখন পর্যন্ত কোনও গোপন বা আপত্তিকর কাজও করেনি। এই অ্যাপটি দুনিয়ার অন্যান্য অ্যাপলিকেশনের মতোই স্বাভাবিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছিল।
অবস্থাদৃষ্টে এটা প্রমাণিত যে, টিকটকের একমাত্র দোষ- তার জন্ম ও উৎস চীনে। যে দোষে ইতোমধ্যে দোষী সাব্যস্ত হয়েছে হুয়াওয়েই, জেডটিইসহ অন্যরা। “যুক্তরাষ্ট্র এখন টিকটককে চীনের উৎস থেকে সম্পূর্ণ আলাদা করতে চাপ দিচ্ছে। ঠিক যেন, কাউকে তার বাবা-মা’র অস্তিত্ব অস্বীকার করতে বাধ্য করা, দেহের সব শিরা-উপশিরা-ধমনীর রক্ত নিংরে বের করা এবং নয়া পরিবারের কাছে নিজেকে বিক্রি করার জন্য বলপ্রয়োগ করা হচ্ছে।” এভাবেই বিষয়টি দেখছে চীনা জনগণ।
মোহাম্মদ তৌহিদ, বিদেশি বিশেষজ্ঞ, চায়না মিডিয়া গ্রুপ, বেইজিং, চীন থেকে, tawhid_dhaka@icloud.com
