রোমানিয়ায় দালালদের দৌরাত্ম্য

মাহাফুজুল হক চৌধুরী, রোমানিয়া থেকে
প্রকাশ: ০৩ জুলাই ২০২১, ০১:১০ এএম

ইউরোপ ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত দেশ রোমানিয়ার অনেক পুরোনো ইতিহাস রয়েছে। ২,৩৮,৩৯৭ বর্গমাইলের দেশটিতে প্রায় ২০ মিলিয়ন মানুষের বসবাস। এটি ২০০৭ সালে ইউরোপ ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।
রোমানিয়ার আয়তন প্রায় বাংলাদেশের দেড়গুণ বড়। রোমানিয়ার টাকার নাম হচ্ছে লিউ। এক লিউতে বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ২৫ টাকার কাছাকাছি। ভৌগোলিকভাবে রোমানিয়ার অবস্থান হচ্ছে পূর্ব ইউরোপের শেষ প্রান্তে।
রোমানিয়ার পাশ্ববর্তী দেশগুলি হচ্ছে- রোমানিয়ার পশ্চিমে সেঞ্জেনের দেশ হাঙ্গেরী দক্ষিণ পশ্চিমে রয়েছে সার্বিয়া, দক্ষিণে বুলগেরিয়া, উত্তরে ইউক্রেন, উত্তর পূর্বে মলদোভা।
রোমানিয়া একটি বড় দেশ হলেও ঘনবসতিপূর্ণ দেশ নয়। ভৌগোলিকভাবে রোমানিয়ার অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে সে হিসেবে তারা ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলির কাছে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে পারছেনা। দেশটির অর্থনীতিক সমস্যা সবসময় লেগেই থাকে৷ দুর্নীতিগ্রস্ত সরকার, সাধারণ মানুষের অযোগ্যতা দেশটিকে অনেক পিছিয়ে রেখেছে। দেশটিতে শিক্ষার হার অনেক কম।
ইউরোপ ইউনিয়নের মধ্যে সবচেয়ে শিক্ষার হার কম রোমানিয়া এবং বুলগেরিয়ায়। রোমানিয়ায় এখনো উচ্চশিক্ষার হার মাত্র ৪০% এর নিচে। ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলিতে যেভাবে সাধারণ জনগণের জন্য সুযোগ সুবিধা রয়েছে রোমানিয়ায় সেভাবে কোনো সুযোগ সুবিধা নেই। রোমানিয়ার ৬০ ভাগ মানুষ দিনে এনে দিনে খায়। রোমানিয়া ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলি থেকে পিছিয়ে থাকার অনেক কারণও আছে, রোমানিয়ার যে স্থানীয় মানুষ আছে তাদের ৬০ ভাগ অরিজিনাল রোমানিয়ার লোক নয়। রোমানিয়া, বুলগেরিয়া, সার্বিয়া এ দেশগুলি জিপ্সিয়ানে ভরা।
জিপ্সিয়ানরা হচ্ছে একটা জাতি যাদের উৎপত্তি হচ্ছে ভারতবর্ষ থেকে। আট এবং দশ শতাব্দীর দিকে ইন্ডিয়া থেকে বিতাড়িত এক শ্রেণীর লোক বিশেষ করে ভারতের উত্তর প্রদেশ থেকে অসংখ্য ভারতীয়রা মধ্যপ্রাচ্যে এসে পাড়ি জমায়, পরে সেখান থেকে তারা তুরষ্ক, কুর্দি, সিরিয়া, মিশরে এসে বাসস্থান করে। এর পরে তাদের কয়েক প্রজন্ম পরির্বতন হওয়ার পর রাশিয়ায় এসে ভীড় জমায়। পরে রাশিয়া থেকে আরো কয়েক প্রজন্ম শেষে পরের প্রজন্ম রোমানিয়া, বুলগেরিয়া সার্বিয়া, মেসিডোনিয়া, এসব দেশে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস করা শুরু করে।
ক্রোয়েশিয়া, হাঙ্গেরি এসব দেশে ভিড় জমালেও সেখানে তারা টিকতে পারেনি। ইউরোপীয়ানরা মনে করে যে তাদের উৎপত্তি হচ্ছে ইজিপ্ট থেকে যেটাকে আমরা মিসর বলি। তাদেরকে ইজিপ্ট থেকে জিপ্সি নাম দেয় ইউরোপিয়ানরা। আসলে তাদের উৎপত্তি স্থল হচ্ছে ভারত থেকে। তাই শত শত বছর পরে এসেও কয়েক প্রজন্ম পরিবর্তন হওয়ার পরেও তারা ভারতের দেশপ্রেম চর্চা করে, ভারতীয় গান, হিন্দী ভাষা তাদের প্রথম পছন্দ। জিপ্সিয়ানরা যেহেতু অন্যদেশ থেকে আগত তাই তারা সবসময় অবহেলিত ছিল। রাষ্ট্রীয়ভাবে রোমানিয়া বুলগেরিয়ার নাগরিকত্ব পেলেও এখনো তারা স্থানীয়দের দ্বারা বৈষম্যের শিকার হন। ওরা শিক্ষা এবং জীবনযাত্রার মান অনেক পিছিয়ে আছে। রোমানিয়ায় প্রায় দুই কোটি জনসংখ্যা থাকলেও এক কোটির উর্দ্বে জিপ্সিয়ান।
যার কারণে দেশটি ইউরোপের একটি অনুন্নত দেশ হিসেবেই পরিচিত। ওদের কোন অফিশিয়াল জব দেয়না, ভাল কোন কাজে তাদের রাখেনা। আর এরাও খুব বাজে স্বভাবের। চুরি করে এরা, খুন খারাপি ছাড়া যত খারাপ কাজ আছে সবকিছুই করে এরা। কাজ করতে পছন্দ করেনা তারা।
তাই প্রতিবছর রোমানিয়ায় প্রচুর দক্ষ কর্মীর প্রয়োজন পড়ে, তারা বাংলাদেশ, ইন্ডিয়া থেকে অনেক লোক আনে।
রোমানিয়ায় বর্তমানে ওয়ার্ক পারমিটে যে ভিসাগুলি হচ্ছে সেগুলি গার্মেন্টস, এগ্রিকালচার এবং বিল্ডিং কন্ট্রাক্টশনের কাজে। বাংলাদেশ থেকে আসার সময় অবশ্যই কিছুটা হলেও এসব কাজের উপর দক্ষতা থাকতে হবে। তা না হলে এখানে এসে সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়, মালিকপক্ষ কাজে নিতে চায়না। কাজ না জানলে মালিকপক্ষ খারাপ আচরণ করে কেননা তারা আপনাকে এনেছে স্কিল ওয়ার্কার হিসেবে। তাই কাজ জানাটা খুব জরুরি।
অনেকেই মনে করে যে এগ্রিকালচার কাজ এবং কন্ট্রাক্টশনের কাজগুলি তেমন কঠিন নয়, কিন্তু আসার পর দেখে যে এগুলি অনেক হার্ড, পরে তারা বিপদে পড়ে। যদিও মালিকপক্ষ থেকে দুই থেকে তিন মাসের সুযোগ দেয় কাজ শেখার জন্য, এরপরও না পারলে তখন ছাঁটাই করে দেয়। আর এসব কাজের বেতন হচ্ছে থাকা খাওয়া মালিকের দিয়ে ৪৫০ ইউরো বেতন দেয় মাসে। যদিও দালালরা ৭০০-৮০০ ইউরো যা বলে এসব মিথ্যা।
রোমানিয়ায় কাজের ভিসায় এসে আপনি কতদিন বৈধ থাকতে পারবেন? রোমানিয়া যখন প্রথম আসবেন আসার পর মালিক হওয়ার পর আরো এক বছরের জন্য করে দেয়, এভাবে যতদিন কোম্পানি চায় আপনাকে ভিসা লাগায় দিবে।
যদিও রোমানিয়ার নিয়ম হচ্ছে কেউ ৫ বছর বৈধভাবে রেসিডেন্সি নিয়ে থাকলে সে পাঁচ বছর পরে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য আবেদন করতে পারে। তবে এটা কেবল নামেমাত্র, বাস্তবে তারা কাউকে পারমেনেন্ট রেসিডেন্সি দেয়না।
বর্তমানে ইউরোপের প্রায় সব দেশেই ভিসা দেওয়া বন্ধ, একমাত্র রোমানিয়াতে ওয়ার্ক পারমিট ভিসা হচ্ছে। আর সেটাকে পুঁজি করে বাংলাদেশে ব্যাঙের ছাতার মত এজেন্সি গড়ে উঠেছে। বেশিরভাগ এজেন্সিগুলি নামেমাত্র, এদের অস্তিত্ব শুধুমাত্র একটা ফেইসবুক পেইজ আর গ্রুপেই সীমাবদ্ধ। আবার অনেকেই অফিস একটা নিলেও এগুলির কোন ব্যবসার লাইসেন্স বা সরকারিভাবে রিক্রুটিং ব্যবসার অনুমতি নেই। বিভিন্ন নাম দিয়ে সাইনবোর্ড একটা লাগিয়ে বসে আছে তারা। ফেইসবুকে বিভিন্ন নামে এজেন্সির প্রচারণা চালালেও বাস্তবে এসব দালালদের ইউরোপ সম্পর্কে তেমন কোনো ধারণাই নেই। কিন্তু নিজেদের অনেক বড় মাপের দালাল বলে প্রচার চালায়।
আমার পরিচিত অনেকজনকে দেখেছি তারা নিজেরাই ক্রোয়েশিয়া রোমানিয়া যেতে চেয়েও ভিসা পায়নি পরে তারাই লোক পাঠানোর নামে দালালি শুরু করেছে। কোন একটা এজেন্সির সঙ্গে পরিচয় থাকলে সেও দালাল।
ফেইসবুকে তথাকথিত এসব দালালরা কেউ সরাসরি রোমানিয়ার কাজ করেনা তারা ফাইলগুলি নিয়ে দেয় অন্য একজনকে, আবার সে দেয় আরেকজনকে এভাবে মুল জায়গায় যেতে যেতে ৪-৫ জন দালাল পরিবর্তন হয়। ফেইসবুকের এসব এজেন্সিগুলি নিজেরাও জানেনা তাদের ফাইলটা কার মাধ্যমে কাজ হচ্ছে। কিন্তু তারা মানুষকে কোনভাবেই সেটা বুঝতে দিচ্ছেনা।
কোন কোন দালাল অন্যজনের ভিসা নিয়ে ফেইসবুকে নিজে করেছে বলে পোষ্ট দিয়ে মানুষকে দেখাচ্ছে, বিভিন্ন জনের নামে ফেইক বানানো ভিসা ফেইসবুকে পোষ্ট দিয়ে মানুষের কাছে বিশ্বস্ত হবার চেষ্টা করছে। তারা মানুষের থেকে টাকা এডভান্স নিয়ে আবার সে টাকা ফেরত দেবার নাটকও বানিয়ে ফেইসবুকে পোষ্ট দিয়ে মানুষের আস্থা অর্জন করার চেষ্টা করছে।
তারা প্রতিদিন ডজন ডজন পারমিট হাতে পায় ফেইসবুকে এমন পোষ্ট দিলেও এসব মিথ্যা।
সবগুলি নকল পারমিট দেখিয়ে মানুষকে লোভ লাগায়, মানুষ যেন তাড়াতাড়ি তাকে টাকা দিয়ে দেয়।
আর এসব ফাঁদে পাঁ দিয়ে সাধারণ মানুষ নিঃস্ব হচ্ছে। অনেকেই দালালদের টাকা দিয়ে এক বছর ধরে ঘুরলেও কোন ভিসাও পায়নি, টাকাও ফেরত পায়নি।
আমি যখন রোমানিয়া ভিজিটে যাই, সেখানেও দেখেছি বেশকিছু বাংলাদেশি দালালচক্র বাংলাদেশ এবং মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থানরত দালালদের সাথে যৌথভাবে এসব প্রতারণা করে আসছে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের কঠোর আইনি পদক্ষেপ না নিলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশিরা ইউরোপের বাজার হারাতে পারে৷