Logo
Logo
×

পরবাস

তেল

Icon

রহমান মৃধা, সুইডেন থেকে

প্রকাশ: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০৯:৫৫ পিএম

তেল

ছোটবেলায় দেশে থাকতে শুনেছি যে, বাংলাদেশে সরকারি বা বেসরকারি কর্মী বলে কোনো কথা নেই- তাদের কাছে কোনো কিছুর জন্য গেলেই হয় সালামি না হয় ঘুস দিতে হয়।  চাকরিতে প্রমোশনের দরকার, বসকে পটাতে হবে; বদলি হওয়ার দরকার তও বসকে তেল দিতে হবে।

বস হয়তো কিছু আশা করেননি তারপরও অনেকে নিজ থেকে কিছু নিয়ে বসের বাড়ি হাজির হয়েছে। এটাও শুনেছি একবার একজন ইলিশ মাছ নিয়ে বসকে বলেছিলেন এ মাছ তার নিজের পুকুরের। 

এখন ঘুস, সালামি বা নিজ থেকে কাউকে কিছু দেওয়া এ ধরনের রেয়াজ বাংলাদেশে অতীতে যেমন ছিল এখনো আছো। তাহলে যতক্ষণ পর্যন্ত কেও কারো সম্পদ বা অর্থ হরণ না করে বরং বিনিময় করে তাকে ঘুস বলা হয়। আবার যেমন পাম্পপট্টি মারা, বা তেল দেওয়া এসবও কিন্তু আমাদের সমাজে খুব প্রচলন। আমরা তেল মেরে, ঘুস দিয়ে/নিয়ে বা পাম্পপট্টি মেরে আমাদের কার্য সাধন করতে ওস্তাদ। 

আজ একটি ঘটনা চোখে পড়ল সেটা দেখার পর এক বন্ধুকে ফোন করলাম। তাকে জিজ্ঞেস করলাম আচ্ছা বলতো কি কারণ থাকতে পারে বাঙালিদের এত তেল মারার পেছনে? ও'মা সে দিব্বি আমাকে তেলের বর্ণনা থেকে শুরু করে তেল মারার গুণাগুণ সম্পর্কে অনেক কিছু জানালো। শুধু কি তাই? হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর তেলের ওপর লিখাটি আমাকে ধরিয়ে দিল যার অংশ বিশেষ যেমন “তৈল যে কি পদার্থ, তাহা সংস্কৃত কবিরা কতক বুঝিয়াছিলেন। তাহাদের মতে তৈলের অপর নাম স্নেহ।

বাস্তবিকও স্নেহ ও তৈল একই পদার্থ। আমি তোমায় স্নেহ করি, তুমি আমায় স্নেহ কর অর্থাৎ আমরা পরস্পরকে তৈল দিয়া থাকি। স্নেহ কি? যাহা স্নিগ্ধ বা ঠান্ডা করে , তাহার নাম স্নেহ। তৈলের ন্যায় ঠাণ্ডা করিতে আর কিসে পারে? বাস্তবিকই তৈল সর্বশক্তিমান; যাহা বলের অসাধ্য, যাহা বিদ্যার অসাধ্য, যাহা ধনের অসাধ্য, যাহা কৌশলের অসাধ্য, তাহা কেবল একমাত্র তৈল দ্বারা সিদ্ধ হইতে পারে।

যে সর্বশক্তিময় তৈল ব্যবহার করিতে জানে, সে সর্বশক্তিমান। তাহার কাছে জগতের সকল কাজই সোজা। তাহার চাকরির জন্য ভাবিতে হয় না —যে তৈল দিতে পারিবে,তাহার বিদ্যা না থাকিলেও সে প্রফেসার হইতে পারে। আহাম্মক হইলেও ম্যাজিস্ট্রেট হইতে পারে, সাহস না থাকিলেও সেনাপতি হইতে পারে এবং দুর্লভরাম হইয়াও উড়িষ্যার গভর্নর হইতে পারে।

প্রদীপ জ্বলে না, ব্যঞ্জন সুস্বাদু হয় না, চেহারা খোলে না, হাজার গুন থাকুক তাহার পরিচয় পাওয়া যায় না, তৈল থাকিলে তাহার কিছুরই অভাব থাকে না। পূর্বেই বলা গিয়াছে, যে তৈল দিতে পারে, সে সর্বশক্তিমান, কিন্তু তৈল দিলেই হয় না। দিবার পাত্র আছে, সময় আছে, কৌশল আছে। কে যে তৈল দিবার পাত্র নয় ,তাহা বলা যায় না। পুঁটে তেলি হইতে লাটসাহেব পর্যন্ত তৈল দিবার পাত্র। তৈল এমন জিনিস নয় যে, নষ্ট হয় । একবার দিয়া রাখিলে নিশ্চয়ই কোন না কোন ফল ফলিবে। কিন্তু উপযুক্ত সময়ে অল্প তৈলে অধিক কাজ হয় ।

কৌশল — পূর্বেই উল্লেখ করা গিয়েছে, যেরূপেই হোক, তৈল দিলে কিছু না কিছু উপকার হইবে। যেহেতু তৈল নষ্ট হয় না, তথাপি দিবার কৌশল আছে।

যাহার বিদ্যা আছে,তাহার তৈল আমার তৈল হইতে মূল্যবান। বিদ্যার উপর যাহার বুদ্ধি আছে, তাহার আরও মূল্যবান। তাহার উপর যদি ধন থাকে, তবে তাহার প্রতি বিন্দুর মূল্য লক্ষ টাকা। কিন্তু তৈল না থাকিলে তাহার বুদ্ধি থাকুক, হাজার বিদ্যা থাকুক, হাজার ধন থাকুক, কেহই টের পায় না।

তৈল সবাই দিয়া থাকেন —কিন্তু কেহই স্বীকার করেন না যে, আমি দেই। সুতরাং এ বিদ্যার অধ্যাপক জোটা ভার। এ বিদ্যা শিখিতে হইলে দেখিয়া শুনিয়া শিখিতে হয়। রীতিমত লেকচার পাওয়া যায় না। শেষে মনে রাখা উচিত, এক তৈলে চাকাও ঘোরে আর তৈলে মনও ফেরে”।

ছোটবেলায় সাগরিকা ছবি দেখেছিলাম ঢাকার পিলখানা সিনেমা হলে, তখন কেদার দাকে তার এক বন্ধু নাম মনে নেই বলেছিল নিজের চর্কায় তেল দিতে, তখন কেদার দা উত্তরে বলেছিল যতটুকু মনে পড়ে, “যার তেল দেবার অভ্যাস তার কাছে নিজ আর পর বলে কিছু নেই, চর্কা পেলেই তেল দেয়”। সে বহু বছর আগের কথা, তবে তেল দেওয়া নিয়ে এত সুন্দর করে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী লিখেছেন তা আমার জানা ছিল না।

আমি আমার জীবনে এত সুন্দরভাবে বিষয়টি নিয়ে কখনো ভাবিনি। ভেবেছিলাম তেলের ওপর অনেক কিছু লিখব যেমন তেলের গুরুত্ব, তেলের ব্যবহার এবং এর উপকারিতা আমার মতো করে। কিন্তু তেল এমন এক বস্তু যা সাধারণ তাপমাত্রায় তরল অবস্থায় থাকে। এটি পানির সাথে মেশে না; অথচ জৈব দ্রাবকের সাথে মিশে যায়। তেলে উচ্চমাত্রার কার্বন এবং হাইড্রোজেন রয়েছে।

বিভিন্ন প্রকারের তেল, যেমন: উদ্ভিজ্জতেল, ঔষুধি তেল এবং অপরিহার্য উদ্বায়ী তেল প্রদত্ত সাধারণ সংজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত। সব ধরনের তেলই আদিতে জৈব পদার্থ থেকে উৎসারিত। বিশেষ করে সরিষার তেল পরিপাক, রক্ত সংবহন ও রেচনতন্ত্রের শক্তিশালী উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে। এ ছাড়া খাওয়ার পাশাপাশি বাহ্যিকভাবে শরীরে মালিশ করলে শরীরের রক্ত সঞ্চালন এবং ঘর্মগ্রন্থি উদ্দীপিত হয় এবং শরীরের তাপমাত্রা কমে।

সরিষার তেলে গ্লুকোসিনোলেট নামক উপাদান থাকে, যা অ্যান্টিকারসিনোজেনিক উপাদান হিসেবে পরিচিত। তাই এটি ক্যান্সারজনিত টিউমারের গঠন প্রতিরোধে সাহায্য করে। এর ফাইটোনিউট্রিয়েন্ট কোলোরেক্টাল ও গ্যাস্ট্রোইন্টেস্টাইনাল ক্যানসার থেকে সুরক্ষাও প্রদান করে।তবে সেটা শতভাগ ভেজাল মুক্ত হতে হবে।

ওপরের বর্ণনায় যতটুকু জানলাম তাতে আমি মুগ্ধ হয়েছি। তেলের গুরত্ব আমাদের জীবনে এত বেশি আগে আমার জানা ছিলো না। তবে এতটুকু বলতে চাই তা হলো ভেজাল সরিষার তেল কি আমাদের জন্য উপকার বয়ে আনবে? মোটেও তা নয়। দোকানের খোলা সরিষার তেলে ভেজাল মিশ্রিত থাকে, যা ব্যবহার করলে নানা রকম অসুখ–বিসুখ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই খাঁটি সরিষার তেল কেনার ক্ষেত্রে সাবধান হতে হবে। তাছাড়া অতিরিক্ত তেল শরীরের জন্য ক্ষতিকর।
 
শিক্ষণীয় বা ভালো কিছু থেকে যখন আমরা নতুন কিছু শিখি সেটাকে আমরা নানাভাবে প্রয়োগ করি। অতএব তেলের গুণাগুণ এবং তার ব্যবহার বা তেল মারা অভ্যাসটা সেভাবেই আমাদের আচরণে ঢুকেছে। শিক্ষককে খুশি করতে আমরা সালাম করি, আদব কায়দা বা মার্জিত ভাষা ব্যবহার করি, প্রতিদিন আল্লাহকে খুশি করতে ভালো কাজ করি।

সব কিছুই মূলত তেল মারার মধ্যেই কিন্তু পড়ে। বন্ধুর কথায় যুক্তি দেখে আমি তার সঙ্গে তর্কে না গিয়ে একটু তেল মেরে অন্য প্রসঙ্গে কথা বলে আলোচনা শেষ করলাম। তবে আমাদের কথার শেষের দিকে আমরা দুইজনই কেন যেন একমত হলাম সেটা হলো- বেশি তেল খাওয়া, ব্যবহার করা, এমনকি বেশি তেল মারা ভালো না।

তেল

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম