Logo
Logo
×

পরবাস

আমি হিমালয় দেখিনি, শেখ মুজিবকে দেখেছি

Icon

দেলোয়ার জাহিদ

প্রকাশ: ০৮ মার্চ ২০২২, ১০:৩১ পিএম

আমি হিমালয় দেখিনি, শেখ মুজিবকে দেখেছি

‘আমি হিমালয় দেখিনি কিন্তু শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব ও সাহসিকতায় এই মানুষটি  হিমালয়’— ফিদেল কাস্ত্রো, কিউবা প্রজাতন্ত্রের সাবেক প্রধানমন্ত্রী। ফিদেল কাস্ত্রো ছিলেন একজন জগৎখ্যাত বিপ্লবী ও একজন মুক্তিদাতা। তিনি তার দ্বীপ জাতিকে ঔপনিবেশিক শক্তি এবং মাফিয়া ডনদের হাত থেকে উদ্ধার করেছিলেন; যারা ১৬ শতকের অর্ধেক থেকে ২০ শতকের মধ্যে শাসন করেছিল এবং ল্যাটিন আমেরিকা ও আফ্রিকার অন্যান্য স্বাধীনতা আন্দোলনে অনুপ্রাণিত করেছেন যে নেতা, যে যোদ্ধা।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ দেশকে এগিয়ে নিতে এখনো জনগণকে অনুপ্রাণিত করছে। তিনি বলেন, ‘দেশকে এগিয়ে নিতে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ এখনো আমাদেরকে অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছে।’ (বাসস)
 
সে হিমালয়সম শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণকে নিয়ে রয়েছে উচ্চতর গবেষণার সুযোগ। ইতিহাসের সবচেয়ে বিখ্যাত বক্তৃতাগুলির মধ্যে যা মিল রয়েছে তা হল এগুলোর অনস্বীকার্য প্রভাব। বক্তা কতটা ভাল যুক্তি তৈরি করেছেন, এর ছবি এবং ধারণাগুলি শব্দের মধ্যে কতটা ভালভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, যা নিজ ভাষায় কতটা দক্ষতার সাথে তিনি তা তৈরি করেছেন বা উপস্থাপন করেছেন। পৃথিবীর মহান বক্তৃতাগুলো তাদের সময় ও স্থানকে অতিক্রম করে, জ্ঞান প্রদান করে, সময়ের মানদণ্ডে তা প্রতিটি যুগের সাথে কথা বলে.একটি দুর্দান্ত বক্তৃতাকে সংজ্ঞায়িত করার পরামিতিগুলির কোনও মানক স্থির করা নেই।

ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও বিখ্যাত বক্তৃতাগুলির মধ্যে কিছু ভাষা এবং গল্প সমৃদ্ধ বর্ধিত বিষয় ও অন্যগুলি সংক্ষিপ্ত এবং অতিরিক্ত, সমস্ত শব্দ বাদ দিয়ে বাড়তি একটি বার্তা দেয় না। শেখ মুজিবের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ কিভাবে বাঙালির স্বাধীনতার একটি দিক নির্দেশনা হিসেবে উঠে এসেছিলো কীভাবে তার জীবন, নিয়ম ও মনোভাবকে তিনি প্রকাশ করেছেন, কিভাবে শাসকদের বুঝিয়ে দিয়েছেন যে আমরা তোমাদের ঘৃণা করি না, তবে তোমাদের ভালোবাসার সমস্ত কারণ আমরা হারিয়ে ফেলেছি। বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাসে সেই শব্দমালা, সেই কথোপকথন যেন  হিমালয়সম এক  কবির অমর কাব্যগাথা হয়ে রয়েছে । যে ভাষণ এখনো বাঙালির রক্ত কণিকায় রন্দ্রে রন্দ্রে শিহরণ তোলে।

"বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ" ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দিয়েছিলেন।  যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জনগণকে স্বাধীনতার দিকে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেই সময়ে যখন পাকিস্তানি সামরিক শাসকরা বাঙালির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে অস্বীকার করেছিল। জাতীয়তাবাদী নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, যার দল আওয়ামী লীগ ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। ভাষণটিতে কার্যকরভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিল। বক্তৃতাটি একটি বিশ্বস্ত ডকুমেন্টেশন গঠন করে যে কীভাবে উত্তর-ঔপনিবেশিক জাতি-রাষ্ট্রগুলোর অন্তর্ভুক্তিমূলক, গণতান্ত্রিক সমাজ বিকাশে ব্যর্থতা তাদের জনসংখ্যাকে বিভিন্ন জাতিগত, সাংস্কৃতিক, ভাষাগত বা ধর্মীয় গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত করে। বক্তৃতাটি ছিল নৈমিত্তিক এবং কোন লিখিত স্ক্রিপ্ট ছিল না। তবে বক্তৃতাটি অডিওর পাশাপাশি এভি সংস্করণেও টিকে ছিল"। (ইউনেস্কো)

৭ মার্চের ভাষণের কয়েকটি দিক নিয়ে এখানে আলোচনার দাবি রাখে।  এ যেন ছিল কথোপকথনের অন্যান্য এক রূপ।  সক্রেটিক সংলাপে অংশগ্রহণকারীরা যেমন অনুসন্ধানের স্বার্থে একসাথে অভিজ্ঞতা অন্বেষণ করার চেষ্টা করতো। ঠিক তেমনি কাব্যিক শব্দশৈলী ও বাক্যবিন্যাসে  এ ভাষণ হয়ে উঠেছিল অনন্য শ্রুতিমধুর ও তাৎপর্যপুর্ণ এক রাজনৈতিক দিকনির্দেশনা।

বঙ্গবন্ধুর এ অসাধারণ, সম্মোহনী  ক্ষুরধার ও তেজস্বি বাগ্মীতা যা বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার সক্ষমতায় সম্পূর্ণ ব্যাতিক্রমধর্মী । যা তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের  আপামর কৃষক, শ্রমিক ছাত্র, যুবক, নারী- পুরুষ সকলকে  এক পতাকাতলে সমবেত করে প্রস্তুত করেছিলো এক স্বাধীনতা যুদ্ধের। ইতিহাসের সবচেয়ে বিখ্যাত বক্তৃতাগুলির মধ্য থেকে এখানে কয়েকটির সংক্ষিপ্তসার এখানে তোলে ধরা হলো।

মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র, ১৯৬৩ সালে "আমার একটি স্বপ্ন আছে" বক্তৃতা করেছেন। ওয়াশিংটন, ডিসি-তে মার্চের সময় তার "আই হ্যাভ এ ড্রিম" যা ২৮ আগস্ট, দেওয়া হয়েছিল, মানব ইতিহাসের বাগ্মীতা অন্যতম সেরা অংশ। এটা নৈপুণ্য মিশ্রিত, পুনরাবৃত্তির বাগ্মী কৌশল সহ সমৃদ্ধ ভাষা ও  নির্ভীক। সবচেয়ে বিখ্যাত বক্তৃতা দেওয়ার পাঁচ বছরেরও কম সময়ের মধ্যে একজন ঘাতকের বুলেটে মারা যান কিং।

“আমি আজ তোমাদের বলছি, আমার বন্ধুরা, তাই যদিও আমরা আজ এবং আগামীকালের সমস্যার মুখোমুখি হই, তবুও আমার একটি স্বপ্ন আছে। এটি আমেরিকান স্বপ্নের গভীরে প্রোথিত একটি স্বপ্ন। আমার একটি স্বপ্ন আছে যে একদিন এই জাতি জেগে উঠবে এবং তার ধর্মে প্রকৃত অর্থে বেঁচে থাকবে, 'আমরা এই সত্যগুলোকে স্বতঃসিদ্ধ বলে ধরে রাখি, যে সমস্ত মানুষকে সমানভাবে তৈরি করা হয়েছে' …"আমার একটি স্বপ্ন আছে যে আমার চারটি ছোট শিশু একদিন এমন একটি দেশে বাস করবে যেখানে তাদের গায়ের রঙ দিয়ে নয়, তাদের চরিত্রের বিষয়বস্তু দিয়ে বিচার করা হবে।"

৩৪১ বিসিই তৃতীয় ফিলিপিক: এথেনিয়ান বক্তা ডেমোস্থেনিসের কথা হয়তো অনেকেই শুনেননি, যে ইতিহাসের সর্বকালের অন্যতম বিখ্যাত বক্তা, সিসেরো, ৩০০ বছর পরে তার প্রাচীন পূর্বপুরুষকে উদ্ধৃত করেছিলেন। ডেমোস্থেনিসের তৃতীয় ফিলিপিক, তথাকথিত কারণ ছিল তৃতীয় তার বক্তৃতায় সহকর্মী এথেনিয়ানদের ম্যাসেডনের ফিলিপের দখলকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে তুলে নিতে রাজি করার জন্য নিবেদিত করেছিলেন, যা আক্ষরিক অর্থে মানুষকে যুদ্ধে নিয়ে গিয়েছিল।

রানী এলিজাবেথ আই : ১৫৮৮ টিলাবারি সেনাদের প্রতি "স্প্যানিশ আরমাডা" প্রথম ইতিহাসের অন্যতম পুরুষবাদী বক্তৃতা দিয়েছিলেন, যদিও এক পর্যায়ে, নারী হওয়ার জন্য তার নিজের শরীরকে বাদ দিয়েছিলেন। "শক্তিশালী" স্প্যানিশ আর্মাডা, প্রায় ১৩০টি জাহাজের একটি ফ্লোটিলা, আক্রমণের পরিকল্পনা নিয়ে ব্রিটেনের দিকে রওনা হয়েছিল, রানী ইংল্যান্ডের এসেক্সের টিলবারিতে একটি উত্তেজনাপূর্ণ ভাষণ দিয়েছিলেন। এটি পরিণত হয়েছে, একটি ঝড় এবং কিছু নেভিগেশন ত্রুটি বেশিরভাগ অংশের জন্য স্প্যানিশ যুদ্ধ জাহাজের যত্ন নিয়েছে। তবুও, এটি একটি সাহসী ভাষণ যা একটি জাতিকে শক্তিশালী করতে সাহায্য করেছিল। এই ভাষণটি রানী এলিজাবেথকে তার সৈন্যদের সামনে যে বর্ম পরিধান করতেন তার জন্য বিখ্যাত করে তোলে। 

“আমি আপনাদের মাঝে এসেছি, যেমনটি আপনি দেখছেন, এই সময়ে, আমার বিনোদন এবং বিতাড়নের জন্য নয়, বরং সংকল্পবদ্ধ হয়ে, যুদ্ধের মাঝখানে এবং উত্তাপে, আপনাদের সকলের মধ্যে বাঁচতে এবং মরতে; আমার ঈশ্বরের জন্য, আমার রাজ্যের জন্য, এবং আমার লোকেদের জন্য, আমার সম্মান এবং আমার রক্তের জন্য, এমনকি ধূলিকণার জন্যও শুয়ে থাকতে। আমি জানি আমার শরীর আছে কিন্তু একজন দুর্বল ও দুর্বল মহিলার; কিন্তু আমি একজন রাজা এবং ইংল্যান্ডের একজন রাজার হৃদয় ও পেট আছে, এবং আমি মনে করি যে পার্মা বা স্পেন বা ইউরোপের কোন রাজপুত্রের আমার রাজ্যের সীমানা আক্রমণ করার সাহস করা উচিত, যা কোন অসম্মানের পরিবর্তে আমার দ্বারা বেড়ে উঠবে, আমি নিজেই অস্ত্র ধরব, আমি নিজেই হব আপনার সেনাপতি, বিচারক এবং মাঠে আপনার প্রতিটি গুণের প্রতিদানদাতা।'

জর্জ ওয়াশিংটনের ১৭৮৩ সালে পদত্যাগের ভাষণ ২৩ ডিসেম্বর আমেরিকান সামরিক বাহিনীর কমান্ডার-ইন-চিফ হিসেবে জর্জ ওয়াশিংটনের পদত্যাগের প্রকৃত ক্ষমতা উপলব্ধি করার জন্য, আপনাকে শব্দের বাইরে যেতে হবে এবং প্রসঙ্গটির প্রশংসা করতে হবে। জেনারেল ওয়াশিংটন কোনোভাবেই তার কমিশন থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য ছিলেন না, কিন্তু স্বেচ্ছায়, এমনকি সানন্দে তা করেছিলেন, ঠিক যেমন তিনি পরে জাতির রাষ্ট্রপতি হিসেবে তৃতীয় মেয়াদে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, ১৯৪০ -এর দশকে সম্মানিত হওয়ার নজির স্থাপন করেছিলেন এবং তারপরে আইনে তা গৃহীত হয়েছিল। সবচেয়ে ক্ষমতাশালী মানুষ হওয়া সত্ত্বেও জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার সক্ষমতায় তার ভাষণ ছিল ব্যতিক্রমী। (সূত্র উইকিপিডিয়া)

বঙ্গবন্ধুর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বলেন, এই ভাষণে জাতির পিতা কার্যত: বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে দিয়েছিলেন কিন্তু তা এমনভাবে করেছেন, যে পাকিস্তানি শাসকদের চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করার ছিলো না। এই ভাষণ শুধু বাঙালিকেই মুক্তির মন্ত্রে উজ্জীবিত করে নি, এই ভাষণ যুগে যুগে বিশ্বের সব নিপীড়িত মানুষের মুক্তির প্রেরণা। (বাসস)

৭ মার্চের ভাষণকে একটি দার্শনিক কথোপকথনের সাথে তুলনা করলে ভুল হবে না। এ ভাষণটি যুক্তি উপস্থাপনের বিবেচনায় ছিল খুবই আলোকিত, সত্য এবং খুবই শক্তিশালী, মানের ও সম্পর্কের দিক থেকে সর্বোচ্চ এবং ভিন্নমতের গুরুত্বের প্রতি 'শিষ্টাচার' যুক্ত। -ফিদেল কাস্ত্রো যথার্থই  অনুধাবন করেছিলেন আমরা হিমালয় সম একজন শেখ মুজিবকে পেয়েছিলাম। ব্যক্তিত্বে ও সাহসিকতায় যে মানুষটি ছিলেন শুধু বাংলাদেশের নয় বিশ্বের একজন নিপীড়িত ও নির্যাতিত মানুষের নেতা।
 

মুজিব হিমালয়

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম