Logo
Logo
×

পরবাস

নীল নদ পেরিয়ে স্মৃতির সেতুতে, কনাতুল খায়রিয়া সফরে সাত আজহারি ছাত্র

Icon

জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ান

প্রকাশ: ০৮ আগস্ট ২০২৫, ১২:১৮ এএম

নীল নদ পেরিয়ে স্মৃতির সেতুতে, কনাতুল খায়রিয়া সফরে সাত আজহারি ছাত্র

মিশরের নীল নদ যেন সময়ের নদী। এর স্রোতে ভেসে চলে ইতিহাস, ভেসে চলে সভ্যতা। আর সেই নদীর তীরেই দাঁড়িয়ে আছে এক গ্রাম, El Qanater El Khayreya — বাংলায় যার অর্থ “কল্যাণের সেতু।” নামেই যেমন শান্তি, তেমনি তার প্রকৃতিতেও বিরাজ করে অপার শুদ্ধতা। 

এই গ্রামে আমাদের সফর ছিল যেন ইতিহাসের ছায়ায় ছুটি কাটানো, আধুনিকতা থেকে দূরে একদিনের অবকাশ — প্রকৃতির কোলে ফিরে যাওয়ার এক নির্মল প্রয়াস। 

এই দিন সকালটা ছিল একেবারে স্বচ্ছ। আমরা, আল-আজহারের সাতজন ছাত্র — হাফেজ ইব্রাহিম তুরাগ, মুহাম্মদ মামুন বিন আব্দু সাত্তার, মুহাম্মদ আবু সুফিয়ান, মুহাম্মদ নাঈম উদ্দীন ফারহাদ, আব্দুল্লাহ বিন দ্বীন ইসলাম, খালেদ সাইফুল্লাহ এবং আমি নিজে — কায়রো শহরের কোলাহল পেছনে ফেলে রওনা দেয় নীলের ডেল্টার দিকে। 

সকাল ১১টায় কায়রো থেকে আমাদের যাত্রা শুরু। নগরের দেয়াল আর যানজট পেরিয়ে যখন আমরা El Qanater El Khayreya পৌঁছাই, তখন ঘড়ির কাঁটা দুপুর ২টায় এসে থেমেছে। কিন্তু প্রকৃতির ঘড়ি যেন তখনই খুলল তার দরজা। 

আমরা সোজা ছুটে যাই নীল নদীর পাড়ে। সে ছিল এক আশ্চর্য মুহূর্ত — কেউ নদীর জলে ঝাঁপিয়ে পড়ছে, কেউ সাঁতরে যাচ্ছে নদীর বুক চিরে, কেউ ঠান্ডা জলে গা ভেজাচ্ছে সূর্যের উষ্ণতা দূর করতে।

কিন্তু এর চেয়েও গভীর ছিল সেই অনুভব — যেন ইতিহাসের সেই স্রোতে আমরাও একটুখানি স্থান পেলাম। 

এই নদীর পাড়ে ১৮৬২ সালে নির্মিত হয়েছিল মিশরের প্রথম আধুনিক বাঁধ — Delta Barrage। বৃটিশ ও ওসমানীয় যুগের সাক্ষ্য বহনকারী এই স্থাপনাটি পরবর্তীতে ১৯৩৯ সালে পুনর্গঠিত হয়। আজ তা শুধুই একটি প্রকৌশল কাঠামো নয়, বরং একটি জাতির জীবনের সঞ্চালনকেন্দ্র। 

আমরা সেই বাঁধের গায়ে দাঁড়িয়ে সময়কে ছুঁয়ে দেখার চেষ্টা করলাম। ভাবলাম, কত রাজা, কত কৃষক, কত নবীজাদার পা পড়েছে এ পাড়ে... আমরা তাদের উত্তরসূরী হিসেবে শুধু একদিনের অতিথি। নদী পার হয়ে আমরা বাইকে চড়ি। 

গ্রামের ভিতর ঢুকে যেন এক নতুন জগতের দেখা মেলে — সরু রাস্তা, কাঁচা মাটির গন্ধ, সবুজে ঢাকা কৃষিক্ষেত, আর মানুষের সাদামাটা জীবন। 

সেই সবজির খেত, গমের মাঠ, খেজুরের গাছ, শিশুদের হাসিমুখ, বৃদ্ধদের দৃষ্টি — যেন জীবনের পাঠশালা খুলে গেল আমাদের চোখের সামনে।

এই গ্রামের প্রতিটি ধুলিকণাতেও ইতিহাস। এখানকার মাটি সে যুগ থেকে চাষাবাদ দেখে আসছে যখন মিশরের ভূমি নীলের বন্যা ছাড়া শস্য ফলাত না। এখানকার কৃষকরা এখনো সেই প্রাচীন ঐতিহ্যের ধারক — তারা প্রযুক্তির মাঝে থেকেও প্রকৃতির নিয়মে চলে। 

সন্ধ্যার শেষ আলোয় আমরা নদীর তীর ধরে হাঁটি। নীরবতা ভেঙে কেবল ভেসে আসে আজানের ধ্বনি আর নদীর ঢেউয়ের কলরব। মনে হয় — এই দিন, এই সময়, এই অনুভব — সবকিছুই থাকবে আমাদের স্মৃতির চিরন্তন চিত্রপটে। 

আমরা ফিরেছি কায়রোতে, কিন্তু থেকে গেছে আমাদের এক টুকরো হৃদয় কনাতুল খায়রিয়ার মাটিতে। এ সফর শুধু আনন্দের নয়, ছিল আত্মিক পরিশুদ্ধির। ইতিহাস, প্রকৃতি ও বন্ধুত্বের এক মোহময় মেলবন্ধন। আমাদের চাওয়া — আরও ছাত্র, আরও তরুণ, এমন গ্রামের ছায়ায় নিজেদের হারিয়ে পাক, ফিরে পাক নতুন আলো। 

তবে বলা যায়, নীল নদ শুধু মিশরের রক্তনালী নয়, তা আমাদের চেতনারও অংশ। আর কনাতুল খায়রিয়া, সেই নীল নদ-ঘেরা শান্ত গ্রাম, আমাদের স্মৃতির পাতায় রয়ে যাবে চিরকাল।

লেখক: শিক্ষার্থী, আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়, কায়রো, মিশর।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম