লালবাগে সড়ক দখল করে ‘স্থায়ী হাট’, ভোগান্তি চরমে
হাজারীবাগ (ঢাকা) প্রতিনিধি
প্রকাশ: ২৩ নভেম্বর ২০২৫, ১২:৩৪ পিএম
সড়কজুড়ে চলছে অবৈধ দখলদারদের সীমাহীন দাপট।
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
রাজধানীর লালবাগ থানাধীন ২৬ নম্বর ওয়ার্ডে ছাপড়া মসজিদের পাশ থেকে মেটারনিটি হাসপাতাল মোড় পর্যন্ত পুরো সড়কজুড়ে দীর্ঘদিন ধরে চলছে অবৈধ দখলদারদের সীমাহীন দাপট। ফুটপাত ও প্রধান সড়ক দখল করে প্রতিদিনই বাজার বসে, আর এর কারণে অফিসগামী মানুষ, কর্মজীবী নারী-পুরুষ, স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থীসহ হাজারো পথচারীর দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে। এলাকাবাসীর অভিযোগ—প্রশাসন ও সিটি করপোরেশন বহুদিন ধরে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, ফুটপাত তো বটেই, প্রধান সড়কের একটি বড় অংশ দখল করে বসানো হয়েছে দুই শতাধিক ভ্রাম্যমাণ ও স্থায়ী দোকান। চায়ের দোকান, অবৈধ রেস্টুরেন্ট, কাঁচাবাজার, ভ্যান-ঠেলা দোকান, মাছ-মুরগি, ফল-মসলা, ডিম-সবজি, চটপটি-ফুচকা—নিত্যপ্রয়োজনীয় এমন কিছু নেই, যা এখানে বিক্রি হয় না। এসব দোকানপাট দিনের পর দিন রাস্তার ওপর ময়লা ফেলছে, যার ফলে সড়কের কোণায় কোণায় জমছে দুর্গন্ধময় আবর্জনা। পরিবেশ দূষণ ও স্বাস্থ্যঝুঁকি বিস্তার করছে এই বাজার।
শুধু দোকানই নয়, সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সড়কের বিশাল অংশ দখল করে থাকে অবৈধ অটো, সিএনজি, ভ্যান-রিকশাসহ বিভিন্ন ধরনের যানবাহন। এতে প্রায় সারাদিনই এলাকাজুড়ে সৃষ্টি হয় তীব্র যানজট। স্থানীয়রা জানান, সকাল-সন্ধ্যা কোনো সময়ই নির্বিঘ্নে হেঁটে চলার মতো পরিবেশ থাকে না। জনজীবন যেন দখলদার ও বিশৃঙ্খলার কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক বাসিন্দা যুগান্তরকে জানান, গত ২৫ থেকে ৩০ বছর ধরে এভাবেই ফুটপাত এবং প্রধান সড়ক দখল করে বাজার বসছে। মাঝে মাঝে প্রশাসন এবং সিটি করপোরেশন উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করলেও দু-এক দিনের মধ্যেই আগের মতোই দোকানপাট আবার বসে পড়ে। বাসিন্দারা ক্ষোভ জানিয়ে বলেন, পাশেই পলাশী কাঁচাবাজার থাকা সত্ত্বেও এই সড়কে বাজার বসানোর কোনো যৌক্তিকতা নেই। বরং এ বাজারকে কেন্দ্র করে অতীতে দুই-তিনটি হত্যাকাণ্ডও ঘটেছে, যা এলাকাটি কতটা অনিরাপদ হয়ে আছে তারই প্রমাণ।
আজিমপুর ২৬ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপি নেতা ইসমাইল হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ছাপড়া মসজিদ থেকে মেটারনিটি হাসপাতাল পর্যন্ত দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে ফুটপাত ও প্রধান সড়ক দখল করে বাজার বসিয়ে দখলের রাজত্ব চলছে। তিনি জানান, বিগত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের আমলে এ বাজারকে কেন্দ্র করে ‘মুরগি সেলিম’ এবং সর্বশেষ ইতালি প্রবাসী রসুলবাগের আওয়ামী লীগ নেতা সাবু হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনাও ঘটে। তার দাবি, বর্তমানে কিছু অসাধু রাজনৈতিক কর্মী এবং প্রশাসনের একটি অংশ এখনও এই বাজার থেকে নীরবে চাঁদাবাজি করছে।
তিনি আরও বলেন, ৫ আগস্টের পর নতুন বাংলাদেশে চাঁদাবাজমুক্ত ও দখলমুক্ত সমাজ গড়ার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। লালবাগের এই এলাকাটি ঘনবসতিপূর্ণ হওয়ায় প্রতিদিন স্কুল-কলেজ, কর্মজীবী মানুষ ও ব্যবসায়ীরা আজিমপুর হয়ে চলাচল করেন। কিন্তু ২৬ নম্বর ওয়ার্ডজুড়ে এখন দখলের মহোৎসব চলছে—অবৈধ বাস স্ট্যান্ড, অটো স্ট্যান্ড, ভ্রাম্যমাণ দোকান, ঠেলাগাড়ি—সব মিলিয়ে সড়ক ও ফুটপাতের বড় অংশ ২৪ ঘণ্টাই দখল হয়ে আছে। তার অভিযোগ, বিষয়টি দেখার মতো কেউ নেই; সিটি করপোরেশনও নির্বিকার হয়ে পড়েছে।
আজিমপুর ছাপড়া মসজিদ এলাকার বাসিন্দা আরিফুর রহমান রনি যুগান্তরকে জানান, গত ৩০ বছর ধরে ছাপড়া মসজিদ থেকে মেটারনিটি হাসপাতাল পর্যন্ত প্রধান সড়কটি স্থায়ীভাবে বাজারের দখলে রয়েছে। তিনি বলেন, তার মেয়ে আজিমপুর গার্লস স্কুলে পড়ে, তাই প্রতিদিনই রিকশা বা মোটরসাইকেলে এই পথ দিয়ে যেতে হয়। কিন্তু ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত তীব্র যানজটে রাস্তা প্রায় অচল থাকে, ফলে প্রায়ই স্কুলে দেরি হয়ে যায়। অন্যান্য কাজেও এই সড়কে চলাচল করতে সময় বেশি লাগে। তিনি দাবি করেন, সিটি করপোরেশন ও প্রশাসনের উদ্যোগে দ্রুত এই সড়ক ও ফুটপাত দখলমুক্ত করা জরুরি।
এ বিষয়ে গত ৬ সেপ্টেম্বর যুগান্তরে প্রতিবেদন প্রকাশের পর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের তৎকালীন প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা হাছিবা খান বলেছিলেন, সড়ক ও ফুটপাত দখলমুক্ত রাখতে নিয়মিত অভিযান চালানো হচ্ছে এবং পর্যায়ক্রমে সব এলাকা উচ্ছেদ করা হবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, গত ৬ সেপ্টেম্বর থেকে ২০ নভেম্বর পর্যন্ত দুই মাস ১৪ দিনেও কোনো অভিযান হয়নি। এ কারণে এলাকাবাসীর অভিযোগ—সিটি করপোরেশনের কার্যক্রম কেবল বক্তব্যেই সীমাবদ্ধ, মাঠে তার প্রতিফলন নেই।
পুনরায় যোগাযোগ করা হলে হাছিবা খান জানান, তিনি বর্তমানে ছয় মাসের ‘মেটারনিটি লিভ’-এ থাকায় কোনো মন্তব্য করতে পারবেন না। দায়িত্বপ্রাপ্ত নতুন প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা মোবাশ্বর হাসানের সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেন তিনি। কিন্তু মোবাশ্বর হাসানের সঙ্গে ফোন, মেসেজ কিংবা হোয়াটসঅ্যাপে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা সাড়া না দেওয়ায় সিটি করপোরেশনের উদ্যোগ ও আন্তরিকতা নিয়ে আরও প্রশ্ন উঠেছে।
এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা কমান্ডো মাহাবুবুর রহমান তালুকদারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলে, একজন ফোন ধরে বলেন— স্যার বর্তমানে মিটিংয়ে রয়েছেন। অনুগ্রহ করে এক ঘণ্টা পরে যোগাযোগ করুন।
এ বিষয়ে লালবাগ থানার ওসি মোস্তফা কামাল খান যুগান্তরকে বলেন, সড়ক ও ফুটপাত দখলমুক্ত রাখতে পুলিশের অভিযান চলমান রয়েছে, আগেও দখলদারদের ধরে আদালতে পাঠানো হয়েছে। তবে ফুটপাত উচ্ছেদ করার মূল দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের বলেও তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, সড়ক দখল করে দোকান বসালে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, শুধু দখলদারই নয়—কিছু সিটি করপোরেশনের ময়লা সংগ্রহকারীও অতিরিক্ত টাকা নিয়ে বাজারের বর্জ্য তুলে দেন। এতে দখলদারদের অবস্থান আরও শক্তিশালী হচ্ছে। স্থানীয়রা বলছেন, এক অঘোষিত সিন্ডিকেট এভাবে বাজারটিকে টিকিয়ে রাখছে।
স্থানীয়দের দাবি, অফিসগামী ও শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি কমাতে সড়ক ও ফুটপাত অবিলম্বে দখলমুক্ত করতে হবে। নইলে দখল, বর্জ্য, যানজট ও অপরাধ মিলে এলাকা দ্রুত ভয়াবহ পরিস্থিতিতে পৌঁছাবে।


