Logo
Logo
×

আন্তর্জাতিক

ফিলিস্তিনিরা কি শুধু দৌড়াবে লুকাবে আর রক্ত ঝরাবে?

নাজমুশ শাহাদাৎ

নাজমুশ শাহাদাৎ

প্রকাশ: ১৫ অক্টোবর ২০২৫, ০১:৪০ পিএম

ফিলিস্তিনিরা কি শুধু দৌড়াবে লুকাবে আর রক্ত ঝরাবে?

ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ায় ধ্বংসস্তূপ মাড়িয়ে গাজায় ফিরছে ফিলিস্তিনিরা। ছবি: রয়টার্স

মানব ইতিহাস রক্ত আর স্মৃতিতে ভেজা— সেখানে সিংহেরা অবাধে বিচরণ করেছে; মহিমান্বিত, নির্মম, আর অবিচল। তারা গর্জন করেছে উপত্যকা, নদী, মরুভূমির বুক জুড়ে; জীবন ছিঁড়ে ফেলেছে, মেষশাবকদের ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছে নীরবতার ভেতর। সত্য সব সময়ই ছিল নিষ্ঠুর; যেমন- সিংহ মেষ খায়, মেষ কখনো সিংহকে নয়।

এক বন্ধু আমাকে এ কথাই মনে করিয়ে দিলেন, যখন আমরা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের তথাকথিত ইসরাইল-ফিলিস্তিন ‘শান্তি পরিকল্পনা’ নিয়ে আলোচনা করছিলাম। তিনি কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন, ‘মেষকে তার পরিণতি মেনে নিতেই হবে — না হয় পালাতে পালাতে ক্লান্ত হয়ে লুটিয়ে পড়তে হবে।’

এটাই ইতিহাসের শক্তির যুক্তি: বিজেতারা সীমান্ত আঁকে, পরাজিতদের জীবন নির্ধারণ করে, আর দুর্বলদের বেঁচে থাকার জন্য মানিয়ে নিতে হয়।

কিন্তু এই গল্প কি চিরকাল এমনই থাকবে? মেষরা কি কেবল দৌড়াবে, লুকাবে, আর রক্ত ঝরাবে? নাকি কোনো একদিন তারা শিখবে যে— শুধু বেঁচে থাকাই মূল কথা নয়, ইতিহাসও লিখতে হবে? 

ট্রাম্পের তথাকথিত শান্তি পরিকল্পনাটি যেন এক সোনালী খাঁচা— বাইরে থেকে ঝকঝকে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত খাঁচাই। 

ফিলিস্তিনিদের দেওয়া হয়েছিল ভগ্নাংশে বিভক্ত এক ‘রাষ্ট্র’— টুকরো টুকরো জমি, যা সর্বক্ষণ নজরদারিতে থাকবে; যেন এক উপনিবেশ, যেখানে স্বাধীনতা কেবল কাগজে।

মূল্য? তাদের শোকের নীরবতা, তাদের উচ্ছেদের স্মৃতি মুছে ফেলা, তাদের ইতিহাস গ্রাস করা।

ফিলিস্তিন শুধু এক টুকরো ভূমিই নয়; এটি এক প্রাচীন জলপাইগাছ— যার শিকড় সময়ের গভীরে প্রোথিত, নবী ও কবিদের ভালোবাসায় সিক্ত, বৃষ্টির পানি ও রক্তের মিলনে পুষ্ট। বুলডোজার আসুক, আগুন লাগুক— সেই গাছ এখনো দাঁড়িয়ে। শতাব্দীর পর শতাব্দী বিজেতারা এসেছে, গেছে— কিন্তু জলপাইগাছ রয়ে গেছে অবিচল।

তার শাখাগুলোয় ঝুলছে এক জাতির নীরব প্রত্যয়— যাদের বলা হয়েছে হারিয়ে যেতে। তারা অস্বীকার করেছে। গর্জনের শক্তি নয়, বরং শিকড়ের নীরব জেদে টিকে আছে তারা।

শান্তির পায়রা এই ভূমির আকাশে বহুবার উড়েছে। কিন্তু প্রায় প্রতিবারই তাকে গুলি করা হয়েছে— দখলের নামে, প্রতিশোধের নামে, নিরাপত্তার ছদ্মবেশে। তবুও, গাজার ধ্বংসস্তূপের মাঝে এক শিশু ভাঙা দেয়ালে আঁকে পাখির ছবি; জেরুজালেমের গলিতে এক দাদি তার নাতিকে শেখায় সেই গ্রামগুলোর নাম, যেগুলো মানচিত্র থেকে মুছে দেওয়া হয়েছে।

শরণার্থী শিবিরের কিশোরেরা এখনো স্লিংশট হাতে বিশ্বাস করে— একদিন সাদা পায়রা আবার উড়বে, যদি শুধু আকাশটা তাদের দেওয়া হয়।

তারা চায় না জয়, চায় শুধু ফিরে আসা। চায় না আধিপত্য, চায় সম্মান। 

অত্যাচারীর ছদ্মবেশ

এখানেই আসল ট্র্যাজেডি: ইসরাইল, যে জাতি একসময় ছিল নির্যাতনের শিকার— এখন নিজেই পরিণত হয়েছে নির্যাতকে।

যে জাতি একদিন গেটো, নির্বাসন আর গণহত্যার যন্ত্রণা ভোগ করেছিল, আজ তারা-ই আরেক জাতির ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে নির্বাসন, দেয়াল, অবরোধ— এমনকি এখন পুরো পৃথিবীর চোখের সামনেই চালিয়ে যাচ্ছে গণহত্যা।

শাসকরা হয়তো নীরব দর্শক— কেউ কেউ সহযোগীও— কিন্তু পৃথিবীর জনগণের চেতনা জেগে উঠেছে।

আজ ইসরাইল বিশ্বের অন্যতম নিন্দিত রাষ্ট্র। এটাই কি সত্যিই নেতানিয়াহুর কাম্য উত্তরাধিকার? এক দেশ, যা চিরকাল যুদ্ধবিদ্ধ, বিশ্বব্যাপী ঘৃণিত, ইতিহাসের বিচারে দোষী?

বুদ্ধি বলবে— না।

ইসরাইল এখনো সময় থাকতেই বেছে নিতে পারে এক ন্যায্য, স্থায়ী শান্তি— এমন শান্তি, যা স্বীকৃত হবে শুধু বিশ্বের নয়, ফিলিস্তিনিদের কাছেও।

কোনটি শ্রেয়— বেআইনিভাবে আরও কিছু জমি দখল করা, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অনন্ত যুদ্ধের উত্তরাধিকার দেওয়া, নাকি এমন এক শান্তি নিশ্চিত করা যা স্থায়ী, আরোগ্যদায়ক? উত্তর স্পষ্ট, যদি অহংকারের চেয়ে প্রজ্ঞার কণ্ঠস্বর জোরালো হয়। 

আমেরিকা ও মুসলিম বিশ্ব

যুক্তরাষ্ট্রকেও নিজেকে প্রশ্ন করতে হবে: তারা কোন উত্তরাধিকার চায়?

অকথ্য যুদ্ধাপরাধ ও দখলদারিত্বে অর্থ ঢালতে থাকবে, আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের ‘গণহত্যা’র রায়কেও অগ্রাহ্য করে?

নাকি দেয়ালে লেখা কথাগুলো পড়বে— বিশ্বের জনমত বদলাচ্ছে, এমনকি আমেরিকার ভেতরেও বাতাস ঘুরছে?

ইতিহাসের ভুল পাশে দাঁড়ানো সহজ; কিন্তু দিক পরিবর্তনে সাহস লাগে। আর ইতিহাস পুরস্কৃত করে সেই সাহসীকেই, যারা পথ বদলায়।

আর মুসলিম উম্মাহ? তাদের নেতারা?

তারা কি এতটাই সরল যে এই তথাকথিত ‘চুক্তির’ ভেতরের প্রতারণা বুঝতে পারছেন না?

নাকি বুঝেই চুপ থেকেছেন?

হোয়াইট হাউসে করমর্দন, লাল গালিচা, আমেরিকান প্রেসিডেন্টের সঙ্গে একখানা ছবি— এতেই কি তারা বিক্রি করে দিলেন ফিলিস্তিনকে?

অস্থায়ী সেই আলোয় স্নান করতে গিয়ে তারা ভুলে গেলেন নিজের সম্মানের ছায়া কত দীর্ঘ হয়েছে। 

ইতিহাসের শিক্ষা

ইতিহাসে কলম আর তলোয়ার সবসময় একসঙ্গে চলে।

নবী মুহাম্মদ (সা.) মক্কার প্রভাবশালী নেতাদের প্রস্তাবিত লোভনীয় সমঝোতা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন— নির্বাসন ও কষ্টকে বেছে নিয়েছিলেন আপসের বদলে। তিনি ফিরে এসেছিলেন প্রতিশোধ নয়, দয়া ও ন্যায় নিয়ে।

যিশু খ্রিস্টও লাভলোভী ব্যবসায়ীদের টেবিল উল্টে দিয়েছিলেন— সাম্রাজ্যের অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন আত্মত্যাগের শক্তিতে।

এই শতাব্দীর বিভিন্ন সময়েও নিপীড়িতরা ন্যায়বিচারের জন্য মাথা উঁচু করেছেন—

  • বর্ণবাদের বিরুদ্ধে ম্যান্ডেলা,
  • ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে গান্ধী,
  • ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে জিন্নাহ,
  • আমেরিকান বর্ণবাদের বিরুদ্ধে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র।

তারা দাঁড়িয়েছিলেন যেখানে আজ ফিলিস্তিনিরা দাঁড়িয়ে— ন্যায়ের পক্ষে, দৃঢ় বিশ্বাস আর অধ্যবসায়ের অস্ত্র হাতে।

শেষ কথা

বার্তাটি স্পষ্ট: ন্যায়বিচারহীন শান্তি কখনোই শান্তি নয়।

এটি আত্মসমর্পণ— আপসের পোশাকে।

এটি নীরবতা, যা মর্যাদার বিনিময়ে কেনা হয়।

জোর করে চাপানো কোনো চুক্তি কেবল ঘৃণা আর দীর্ঘ যুদ্ধের বীজ বপন করবে।


যদি ইসরাইল সত্যিই শান্তি চায়, তাহলে তাকে ফিলিস্তিনিদের সমান মর্যাদায় সামনে বসতে হবে।

যদি আমেরিকা সত্যিই শান্তি চায়, তাহলে তাকে অন্ধ আনুগত্য ত্যাগ করতে হবে।আর মুসলিম নেতারা যদি সত্যিই নিজেদের জনগণকে ভালোবাসেন, তাহলে তাদের ফিলিস্তিনকে বিক্রি করা বন্ধ করতে হবে।

ফিলিস্তিনিরা তো রাজসিংহাসন চায় না, চায় জলপাইগাছ।

চায় না সাম্রাজ্য, চায় ঘর।

চায় না মুকুট, চায় মর্যাদা।


হ্যাঁ, সিংহ মেষকে খায়। কিন্তু প্রতিটি সাম্রাজ্য, যত শক্তিশালীই হোক, একদিন ভেঙে পড়ে।

প্রতিটি অন্যায্য শান্তি একদিন ভেঙে যায়।

আর দুর্বলতম কণ্ঠও শতাব্দী পেরিয়ে প্রতিধ্বনিত হয়— যতক্ষণ না তা শোনা যায়।


গল্পটি এখনো শেষ হয়নি।

কালি এখনো শুকোয়নি।

হয়তো, এইবার মেষশাবকটি লেখার কলম শিখে নিয়েছে।

(জিও নিউজে প্রকাশিত পাকিস্তানি লেখক আজহার আব্বাসের নিবন্ধ অবলম্বনে)

ঘটনাপ্রবাহ: হামাস ইসরাইল যুদ্ধ


আরও পড়ুন

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম