|
ফলো করুন |
|
|---|---|
১.
প্রতিটি দেশ কিংবা অঞ্চলের নিজস্ব ঘ্রাণ আছে। পৃথিবীর আশ্চর্য রন্ধনশালায় ভিন্নভিন্ন উনুনে চড়িয়ে এই প্রকৃতি রান্না করে যাচ্ছে সে কে নিখুঁত রাধুনী? রান্নার ঘ্রাণ ছড়িয়ে যাচ্ছে বাতাসে। চীনেরও নিজস্ব ঘ্রাণ আছে। চীনের সাধারণ মানুষ প্রায় ৯৮% মানুষকে চীন বললে বুঝবে না আপনি কি বলছেন। ওদের দেশের নাম ওদের ভাষায় Zhōngguó বলে সম্মোধন করে, পৃথিবীর সকল দেশকে ওরা ওদের প্রশাসনিক মান্দারিন ভাষায় আলাদা আলাদা করে ডাকে। বাংলাদেশকে ডাকে চাইনিজরা Mèngjiālā guó (মাঙঝালা কুও) বলে। চীনের ভাঙা-গড়ার দিকে কিছুটা মগ্ন হওয়া যাক। গৃহযুদ্ধের বিভীষিকাময় ক্ষুধার্ত হতাশার পায়চারি মধ্যে জাপান দ্বিতীয় যুদ্ধ এসে গরম নিঃশ্বাস ছাড়ছে ক্লান্ত চীনের ঘাড়ে। ১৯২৭-১৯৩৭ সালে জাপানের সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের মধ্যে চীন আবার পুনরুজ্জীবিত হয়। চীনের জাতীয়তাবাদী পার্টি (কুওমিনতাং) ও চীনের কমিউনিস্ট পার্টি এক হয়ে লড়াই শুরু করে। মস্কোর রেড স্কয়ার থেকে অক্টোবরের বিপ্লবী হাওয়ায় পাল আচ্ছন্ন করে পুরো চীনকে। জাপানের এর পরাজয় শেষে অভ্যুদয় হয় আবার গৃহযুদ্ধ। চীনের জাতীয়তাবাদী পার্টি ও চীনা কমিউনিস্ট পার্টির গৃহযুদ্ধ। কৃষক শ্রমিক আপামর জনগণ যোগ দেয় কমিউনিস্ট পার্টির আন্দোলনে। চীনে সমজাতান্ত্রিক সংগ্রাম জয়ী হয়। চীনের জাতীয়তাবাদী পার্টি জাপানের সাথে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছিলো। ১৯৪৯ সনে কুওমিনতাং এর নেতা চিয়াং কাই শেক তাইওয়ানে পালিয়ে গিয়ে সমস্ত চীনের ক্ষমতা নেওয়ার জন্য শক্তি সঞ্চয় করতে থাকে। চিয়াং কাই শেক ছিলো পশ্চিমা সমর্থনপুষ্ট। অন্যদিকে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি ছিলো সোভিয়েত সমর্থনপুষ্ট সমাজতান্ত্রিক আদর্শের। তাইওয়ান থেকে আর ফেরা হয়নি চিয়াং কাই শেকের। মার্কস-লেলিন-মাওবাদের রক্তাক্ত আঙুল ধরে শুরু হয় নয়া চীনের যাত্রা। অনুর্বর জাতীর উর্বর হয়ে যাওয়ার জাদুবাস্তবতা। মাও সে তুং এর মৃত্যুর পর বিস্ময়কর এক যাদুকরের আবির্ভাব হয় সে তেং শিয়াওপিং চীনের আধুনিক অর্থনৈতিক সংস্কারের জনক। বদলে দেয় চীনের অর্থনীতি। অনেকেই শিয়াওপিংকে চীনের ফাদার অব ইকোনমিক্স বলে সম্মোধন করে। চীনের আজকের অর্থনীতির শক্তিশালী পরাশক্তি হয়ে উঠার পিছনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা শিয়াওপিং এর। সিচুয়ানের গুয়ানিনে শিয়াওপিং এর আদি বাড়িতে গিয়েছিলাম। সেখানে আলাপচারিতা হয় ব্রুসের সঙ্গে, মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিক্ষক। কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। সে বিস্তারিত জানাচ্ছিলো শিয়াওপিং সম্পর্কে। তাদের আনুগত্যপ্রবণ ইতিহাস। ব্রুস আমেরিকায় প্রায় দশবছর কাজ করেছে। তাকে যখন বলছিলাম- চীনের অর্থনীতি আর দশ বছর পর বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রভাবশালী পাণ্ডায় রূপ নিবে। ও শুধু বলছিল- আমেরিকার কাছাকাছি যেতে দীর্ঘসময় সাধনা করতে হবে, মার্কিন রণশক্তি অনেক ওপরে বিরাজ করে। তবে চীন আমেরিকার সাথে টেক্কা দিয়ে পারবে বলে মনে হয় না। ওদের শিল্প সাহিত্যের প্রভাব নেই বললেই চলে। জাপানের সাহিত্য, সিনেমা, এনিমের যে প্রভাব সারা পৃথিবী জুড়ে আছে তা চীনের নেই। অর্থনীতি ছাড়া চীন বুদ্ধিবৃত্তিক প্রভাব খুবই কম মনে হয়েছে আমার দৃষ্টিতে। বিজ্ঞান, মেধা আর শ্রম দিয়ে চীন অন্যন্য এক উচ্চতায় পৌঁছে গেছে, সমৃদ্ধির চূড়ায়।

২.
চীনের অলিতে-গলিতে হাঁটলে আন্দাজ করা যায় ওদের সংস্কৃতি, পোষাক স্থাপত্য শিল্পের কি দারুণ নিজস্বতা। পেইকিং অপেরার মন্ত্রমুগ্ধকর মঞ্চ নাটক। আধুনিক চীনের শহরগুলো অবকাঠামো মনে হয় পশ্চিমাদের কোলন। তরুণদের মধ্যে পশ্চিমা প্রভাব বেশ লক্ষনীয়ভাবে চোখে ধরা পড়ে। তবে ঐতিহ্যগতভাবে ওদের পুরোনো বাড়িঘর যেন সম্পূর্ণ ভিন্ন এক জগৎ নিয়ে যায়। চীনের সবচেয়ে বড় বিপ্লব হল- ওদের যোগাযোগ ব্যবস্থার অকল্পনীয় উন্নতি। হাজার হাজার কিলোমিটার পাহাড়ের শরীর চিঁড়ে চলে গেছে ট্রেনের রাস্তা। গুয়াংশি থেকে সিচুয়ান ১,২৪৩ কিলোমিটার যেতে যেতে দূর্গম পাহাড়ি পথের রেলপথ দেখে বিস্মিত হয়েছি। এখানেও মানুষের উপস্থিতি কিভাবে সম্ভব। পাহাড়ঘেরা শহরগুলো দেখলে অবাক না হয়ে পারছি না। প্রকৃতি আর নগারয়নের সঙ্গোপনে মানবসভ্যতা গড়ে উঠতে পারে পাশাপাশি? প্রকৃতি ও মানুষের সন্ধি, পাখিদের জন্য অভয়ারণ্য নিশ্চিত করেই ওদের নগারয়নের অগ্রযাত্রা। পাহাড় বৃক্ষের কোনো ক্ষতি না করে যতটুকু সমভূমি আছে ততটুকুই মানুষের জন্য উপযোগী করে নিয়েছে। দুর্গম গ্রামের রাস্তা ফুটপাত, সাবওয়ের সুযোগ-সুবিধা এখনই লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ভবিষ্যতের পরিকল্পনা ওরা এখনই করে নিয়েছে, এখানের মানুষেরা বলে তেং শিয়াওপিং এর সময় এই পরিকল্পনা করে রেখেছে রাষ্ট্রের অবকাঠামো কিভাবে আগাবে। শিক্ষিত মানুষের চেয়ে অধিক আন্তরিক নিম্ন শ্রেণীর মানুষজন, যারা ফল বিক্রেতা, কৃষক, স্ট্রিটফুড বিক্রেতারা। ওদের সাথে সামান্য নমনীয় সুরে কথা বললে যেন- কেমন মেলোডির সুরে আপন করে নেয়। শিক্ষিত শ্রেণীর মানুষকে মনে হবে রোবট ওদের কোনো অনুভূতি নেই, যেন নিজেকে মানুষ হিসেবে বহুদিন ফিল করে না ওরা। একদলীয় শাসনের দেশে মানুষের জনআকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পেরেছে কমিউনিস্ট শাসকরা। জনমনে কোনো অসন্তোষ নেই। মানুষের আনুগত্য তাই প্রমাণ করে। আশ্চর্য হবেন যে একজন কৃষক, শ্রমিক ফসলের ক্ষেতে কাজ শেষ করে নিজের বিএমডব্লিউ দিয়ে বাড়ি ফিরছে। শ্রমিকরা বিকাল পাঁচটার মধ্যে কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরে অথবা নদীর পাড়ে মাছ ধরছে, বারবিকিউ করে খাচ্ছে। ফসলের ন্যায্য দাম পাচ্ছে। মানুষের রুটিরুজির অসীম সুযোগসুবিধা। ডিম, ইক্ষু, সকল খাদ্যদ্রব্য কেজি হিসেবে বিক্রি হয়। সন্ধ্যার অবসরে বৃদ্ধা নারীরা গান বাজিয়ে একসঙ্গে নাচানাচি করছে রাস্তার পাশের খোলাস্থানে। তরুণতরুণীরা স্ট্রিটফুডের দোকানে বসে আড্ডা মেতে উঠে। রাষ্ট্রে জনগণের সমস্ত সুযোগসুবিধা দিয়ে পরিতৃপ্ত করতে পরেছে কমিউনিস্ট শাসকরা। এইজন্য বলা যায় চীনের কমিউনিস্ট পার্টি এখনো বহালতবিয়তে ক্ষমতার আসনে বসে আছে। জনমনে নেতিবাচক কোনো প্রভাব নেই। খাঁচার পাখিটি কী শুধু খাদ্য ও অর্থবৈভবেী স্বাধীনতায় তৃপ্ত হয়? তবে কিছু কিছু দৃশ্য আমাকে খুব দুঃখ দিয়েছে। রাতে বাজারে যেতে দেখা মিলে ৮৯-৯০ বছরের বৃদ্ধা মায়েদের ওরা ময়লার ঝুড়ি থেকে বোতল সংগ্রহ করছে। ঠিক মতো হাঁটতে পারেনা। একটা বোতল ধরে মিনিট দুই কাঁপতে থাকে। তখন মনে প্রশ্ন জাগে এতো বিশাল অর্থনীতির দেশে বৃদ্ধাদের কি ভরনপোষণ রাষ্ট্র দিতে পারতো না? কাজাকিস্তানের বন্ধু আব্বাস আর আমি মুসলিম রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার খেয়ে আসার সময় ও বলছিলো, যে দেশের মানুষের উদ্দেশ্য কেবল অর্থবৈভবের সে দেশের মানুষ মূলত একটা পণ্য হিসেবে দেখা হয়, ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে গেলে, শেষে তাকে পানির খালি বোতলের মতো ময়লার ঝুড়িতে ফেলে দেওয়া হয়। অনেক কিছু শেষে বলা যায়, এশিয়ার মানুষের জন্য চীন আশীর্বাদপুষ্ট একটা রাষ্ট্র। চীনা ভাষায় দক্ষতা থাকলে চীন হলো আপনার জন্য অপার সম্ভবনার। নগরীক নিরাপত্তা ব্যবস্থা পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা হিসেবেই মেনে নিতে হবে।

৩.
চীন সম্পূর্ণ সেক্যুলার রাষ্ট্র হলেও মানুষকে যথেষ্ট এথিস্ট বলা যায় কী? ঐশ্বরিক আশ্রয় তারাও আজও খুঁজে। আমার যতদূর গহীনে যাওয়ার সামর্থ্য হয়েছে গিয়ে দেখেছি। পাহাড়ি গ্রামের গাছপালার আড়ালে তেং পোর মন্দির (গড অব মানি এঁর আরাধনা চীনের কিছু কিছু মানুষ করে)। আগরবাতি আর মোম, মদ দিয়ে। গুয়াংশির পাহাড়ি কৃষি গ্রামে গিয়ে খুঁজে পাই বিশাল এক উপসনালয় সুনশান, মোম, আগরবাতি, ফুল দিয়ে মানুষজন পূজা দিচ্ছে। পাশে ছোট্ট করে গৌতম বুদ্ধের মূর্তি। হান রাজবংশের তৃতীয় সম্রাট ছিলেন হ্যানের সম্রাট ওয়েন (হান রাজবংশের সম্রাট জিংয়ের রাজত্বকাল ‘ওয়েনজিং সরকার’ নামে পরিচিত ছিল)। তার নাম ছিল লিউ হেং। তিনি ছিলেন সম্রাট লিউ ব্যাং-এর তৃতীয় পুত্র। হান রাজবংশের। তাকে প্রাথমিকভাবে দাইয়ের রাজা বলা হয়েছিল। লিউ হেং তিনি (যিনি তার শাসনামলে সদাচার ও শাসনের উপর জোর দিয়েছিলেন) তার দানশীলতা এবং ধার্মিকতার জন্য বিখ্যাত ছিলেন। এখনো তার পূজা আর্চনা করে গ্রামের মানুষজন। মূর্তির উপর লেখা আছে (Yáng suī yìng huī অর্থ সূর্য উজ্জ্বলভাবে জ্বলছে)। বাংলাদেশের মতো অলিতে-গলিতে মসজিদ মন্দির নেই। তবে পুরো শহরে একটা মসজিদ আছে। শুক্রবার হুই মুসলিম নারী-পুরুষেরা নামাজ পড়তে আসে। উৎসব বিরাজ করে। উইঘুর মুসলিমদের প্রতি হুই মুসলিমরা কিছুটা বিরক্ত লক্ষ্য করা যায়। হুই মুসলিমরা ভাবে উইঘুরদের জন্য ওরাও কিছুটা কোনঠাসা। তবে হুই, উইঘুর মুসলিমরা সবাই স্বাধীন ভাবে ব্যবসা বাণিজ্য করে জীবনযাপন করছে। এতো বিশাল দেশ সামান্য একটা প্রদেশে থেকে একটা দেশ সম্পর্কে কথা বলা মুশকিল। আমার চোখে যতদূর দেখেছি মুসলিমরা এখানে বেশ সুখে-শান্তিতে জীবনযাপন করছে। পশ্চিমা মিডিয়ার প্রোপাগান্ডার জন্য পৃথিবীর মানুষ চীন সম্পর্কে অনেক ভুল ধরণা পোষণ করে থাকে। তবে অভ্যন্তরীণ অনেক কিছুই সাধারণ মানুষের দৃষ্টিতে দৃষ্টিগ্রাহ্য হয় কি?। চীনের মানুষের সাথে যত মিশেছি ততই তাদের বিদেশিদের প্রতি আন্তরিকতা কত নির্মোহ বুঝেছি। তবে ধর্মকর্ম রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো বাঁধা নেই চীনে। মানুষের ব্যক্তিগত বিশ্বাসে, আমার জানামতে চায়নিজদের সাথে কথা বলে জেনেছি, রাষ্ট্র কোনো হস্তক্ষেপ করে না। ধর্মীয় উৎসবগুলোতে রাষ্ট্রীয়ভাবে ধর্মপ্রাণ মানুষদের নিরাপত্তা দেওয়া হয়। তবে প্রশ্ন জাগে ওরা কী ওদের হৃদয়কে উপলব্ধি করতে পারে? সাবওয়েতে বসে এক অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকার সাথে কথা হয়েছিলো ভাঙাভাঙা ইংরেজি বলছে। তিনি অনেকটা উদভ্রান্তের মতো কথা বলছিলেন। ‘অর্থবৈভব আর পেশাগত জীবনে পিষ্ট হয়েছি, এতো কিছু থাকার পরও আমি শূন্য, সুখ কোথায়? সারাজীবন মেশিনের মতো শ্রম দিয়ে গেছি, হৃদয়ের বেদনা বলার জন্য তো আমাদের কোনো ইশ্বর নেই। টাকাকে ইশ্বর ভেবেছিলাম তা এখন মূল্যহীন আবর্জনা। নির্বাক থেকে গন্তব্যে ফিরেছি।’
ধর্মহীন মানুষের জীবন অনেকটা এমন। অথবা যাদের শিল্পসাহিত্য নিজেকে অনুভব করার জন্য যে শক্তি দেয়, তাও কি তাদের কখনো ছিলো না।
‘Welcome my son, welcome to the machine
Where have you been?
It's alright we know where you've been
You've been in the pipeline, filling in time’.
( Pink Floyd)
লেখক: চীনের গুইলিন ইউনিভার্সিটি অব ইলেকট্রনিক টেকনোলজির শিক্ষার্থী
ইমেইল: zehadiehsan@gmail.com

