প্রতি ৬০ লাখে একজনের শরীরে থাকে ‘গোল্ডেন ব্লাড’
লাইফস্টাইল ডেস্ক
প্রকাশ: ০১ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৩:৩৪ পিএম
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
আমাদের কারও কখনো দুর্ঘটনা, আহত কিংবা বড় ধরনের সার্জারির কারণে শরীরে রক্তের প্রয়োজন হলে ছুটি যাই রক্ত দিতে। অন্যের দান করা রক্ত দিয়ে জীবন রক্ষা করে থাকি। কিন্তু সবাই এই পদ্ধতি থেকে উপকৃত হতে পারেন না। কারণ এমন একজন মানুষ রয়েছেন, যার শরীরের রক্ত পাওয়া বিরল।
কারণ প্রতি ৬০ লাখ মানুষের মধ্যে মাত্র একজন মানুষ থাকেন, যার শরীরে থাকে বিরল সেই রক্ত। আর বিরল রক্তের গ্রুপ যাদের, এমন মানুষের জীবন বাঁচাতে কাজে সেই রক্ত পাওয়া সম্ভব নয়। তাই সে রক্ত পেতে এখন ল্যাবরেটরিতে তৈরির চেষ্টা করছেন গবেষকরা।
রক্ত সঞ্চালন কিংবা অন্য কাউকে রক্তদান করার যে প্রক্রিয়া আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থা, সেটি সম্পূর্ণ বদলে গেছে। কারণ যাদের শরীরে এমন রক্ত আছে, তারা যদি কখনো দুর্ঘটনার শিকার হন এবং রক্ত নেওয়ার দরকার পড়ে, সে ক্ষেত্রে তাদের জন্য রক্ত পাওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই ক্ষীণ, যা প্রায় অসম্ভব।
রক্তের গ্রুপ ম্যাচিং হয় না— এমন রক্ত খুঁজে পেতে মানুষ হিমশিম খান। তবে এ বিষয়ে সহায়ক হতে পারে সেই বিরল রক্ত, যাতে আরএইচ ফ্যাক্টরের উপস্থিতি নেই (আরএইচ নাল)। সেই রক্ত পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত শনাক্ত হয়েছে মাত্র ৫০ জনের শরীরে। আর সে কারণে যাদের রক্তের গ্রুপ আরএইচবিহীন, তাদের নিজেদের রক্ত সংগ্রহ করে দীর্ঘমেয়াদি সংরক্ষণ করার পরামর্শ দিয়েছেন গবেষকরা। এটি দুষ্প্রাপ্য হলেও সেই রক্ত বিভিন্ন কারণে অত্যন্ত মূল্যবান। চিকিৎসা এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণা মহলে একে কখনো কখনো ‘গোল্ডেন ব্লাড’ বলা হয়ে থাকে।
বিজ্ঞানীরা যেহেতু বর্তমানে দান করা রক্ত ব্যবহারে রোগপ্রতিরোধজনিত যে সীমাবদ্ধতা রয়েছে, তা দূর করার উপায় খুঁজছেন। কারণ এটি সবার শরীরে দেওয়া যায় এমন রক্ত তৈরিতে সহায়তা করতে পারে।
মানব দেহে যে রক্ত প্রবাহিত হয়, তার ধরন নির্ধারিত হয় লাল রক্তকণিকার উপরিভাগে কিছু নির্দিষ্ট উপাদানের থাকা না থাকার ওপর। এসব উপাদানকে অ্যান্টিজেন বলা হয়ে থাকে। এগুলো মূলত প্রোটিন বা শর্করা, যা কোষের পৃষ্ঠ থেকে বেরিয়ে থাকে এবং শরীরের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা শনাক্ত করতে পারে। আর আপনি যদি এমন দাতার রক্ত গ্রহণ করেন, যার অ্যান্টিজেন আপনার রক্তের অ্যান্টিজেন থেকে ভিন্ন, তাহলে আপনার শরীর সেই রক্তের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি করবে এবং সেই রক্তকে আক্রমণ করবে।
আবার দেখা গেছে, ওই একই রক্ত আপনি নিলে তা প্রাণঘাতীও হতে পারে। রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থার সবচেয়ে শক্ত প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে এমন দুটি ব্লাড গ্রুপ সিস্টেম হলো— এবিও এবং রেসাস (আরএইচ)। যাদের রক্তের গ্রুপ ‘এ’, তাদের লাল রক্তকণিকার পৃষ্ঠে থাকে ‘এ’ অ্যান্টিজেন। আর যাদের গ্রুপ ‘বি’, তাদের থাকে ‘বি’ অ্যান্টিজেন।
এবি গ্রুপে ‘এ’ ও ‘বি’—দুটি অ্যান্টিজেন থাকে। আর ‘ও’ গ্রুপে কোনোটিই থাকে না। প্রতিটি রক্তের গ্রুপই আবার আরএইচ পজিটিভ অথবা আরএইচ নেগেটিভ হতে পারে। এর অর্থ হলো— কোনো ব্যক্তি যদি ‘ও’ নেগেটিভ রক্ত গ্রহণও করেন, তবু রক্তে থাকা অন্যান্য অ্যান্টিজেনের কারণে তার শরীরে প্রতিরোধকারী প্রতিক্রিয়া হতে পারে। যদিও কিছু অ্যান্টিজেন অন্যগুলোর তুলনায় বেশি শক্তিশালী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে থাকে।
তবে আরএইচ ফ্যাক্টর নেই যেসব মানুষের রক্তে, তাদের মোট ৫০টি আরএইচ অ্যান্টিজেনের কোনোটিই নেই। যদিও সেই ব্যক্তিরা অন্য কোনো ধরনের রক্ত নিতে পারেন না। তবে তাদের রক্ত সব ধরনের আরএইচ রক্তের ধরনের সঙ্গে উপযুক্ত। আর এ বিষয়টি ও টাইপ আরএইচ নাল রক্তকে অত্যন্ত মূল্যবান করে তোলে। কারণ অধিকাংশ মানুষ এটি গ্রহণ করতে পারেন, যার মধ্যে এবিওর সব ভ্যারিয়েন্ট আছে এমন মানুষও অন্তর্ভুক্ত।
আরএইচ (অ্যান্টিজেন ট্রিগার) রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতায় বড় ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। কাজেই আপনার যদি কোনোটিই না থাকে, তাহলে আরএইচের ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়া করার মতো কিছুই থাকে না।
সাম্প্রতিক গবেষণায় জানা গেছে, আরএইচবিহীন রক্ত জিনগত রূপান্তরের কারণে উৎপন্ন হয়, যা একটি প্রোটিনকে প্রভাবিত করতে পারে। সেই প্রোটিনটি লাল রক্তকণিকায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এবং এটিকে আরএইচ অ্যাসোসিয়েটেড গ্লাইকোপ্রোটিন বা আরএইচএজি বলা হয়ে থাকে।
এর আগে ২০১৮ সালে ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর টোয়ে ও তার সহকর্মীরা ল্যাবরেটরিতে আরএইচ নাল রক্তের অনুকরণ তৈরি করতে সফল হন। এর জন্য তারা ল্যাবে উৎপন্ন অবিকশিত কতগুলো লোহিত রক্তকণিকা ব্যবহার করেছিলেন।
এরপর সেই গবেষকরা সিআরআইএসপিআর-সিএএস৯ নামের জিন এডিটিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে পাঁচটি প্রধান ব্লাড গ্রুপের অ্যান্টিজেন সংশ্লিষ্ট জিনগুলো মুছে ফেলেন। এই পাঁচটি রক্তের গ্রুপে মিল না হওয়ার কারণে সাধারণত রক্ত সঞ্চালনে সবচেয়ে বড় অসঙ্গতি দেখা দেয়। এর মধ্যে রয়েছে এবিও এবং আরএইচ অ্যান্টিজেনের পাশাপাশি কেল, ডাফি এবং জিপিবি নামের অন্যান্য অ্যান্টিজেনও।
প্রফেসর টোয়ে বলেন, আমরা বের করেছি যে এই পাঁচটি অ্যান্টিজেনকে যদি নিষ্ক্রিয় করা যায়, তাহলে একটি অতি সুসঙ্গত কোষ তৈরি করা সম্ভব। কারণ এর থেকে সবচেয়ে সমস্যা-জর্জরিত পাঁচটি রক্তের গ্রুপ সরানো থাকবে। ফলে তৈরি হওয়া রক্তকণিকাগুলো সাধারণ প্রধান রক্তের গ্রুপগুলোর সঙ্গে যেমন সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে, ঠিক তেমনই বিরল রক্তের ধরনের (যেমন আরএইচ নাল ও বোম্বে ফেনোটাইপ, যা প্রতি ৬০ লাখ মানুষের মধ্যে একজনে পাওয়া যায়) সঙ্গেও সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে।
এই রক্তের গ্রুপের মানুষকে ও, এ, বি বা এবি— কোনো রক্তই দেওয়া যায় না। তবে জিন এডিটিং প্রযুক্তি ব্যবহার এখনো বিশ্বের বহু স্থানে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত ও বিতর্কিত হয়ে আসছে। ফলে প্রায় সবার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এই রক্তের ধরন ক্লিনিক্যাল ব্যবহারে আসতে আরও সময় লাগবে।
এটি অনুমোদন পেতে হলে বহু ধাপের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল ও বিস্তৃত পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। সে জন্য প্রফেসর টোয়ে স্কারলেট কয়েকজনের সঙ্গে মিলে থেরাপিউটিক্স নামক একটি স্পিন-আউট কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। সেই কোম্পানি আরএইচবিহীনসহ বিভিন্ন বিরল রক্তের গ্রুপের মানুষের কাছ থেকে রক্ত সংগ্রহ করছে। দলটি আশা করছে, এই রক্ত ব্যবহার করে তৈরি করতে এমন কোষগুচ্ছ, যা ল্যাবরেটরিতে অনির্দিষ্টকাল ধরে লাল রক্তকণিকা উৎপাদন করতে সক্ষম হবে। এরপর এই ল্যাব-উৎপাদিত রক্ত হিমায়িত করে সংরক্ষণ করা যাবে, যাতে বিরল রক্তের গ্রুপের কারও জরুরি প্রয়োজন হলে তা ব্যবহার করা যায়।
প্রফেসর টোয়ে আশা করে আরও বলেন, জিন এডিটিং ব্যবহার ছাড়াই ল্যাবরেটরিতে বিরল রক্তের ব্যাংক তৈরি করা সম্ভব। যদিও এই প্রযুক্তি ভবিষ্যতে ভূমিকা রাখতে পারে। যদি আমরা এডিটিং ছাড়া এটি করতে পারি, তবে দারুণ। কিন্তু এডিটিং আমাদের জন্য একটি বিকল্প। তিনি বলেন, আমাদের কাজের একটি অংশ হলো— সাবধানে দাতাদের নির্বাচন করা, যাতে তাদের সব অ্যান্টিজেন বেশিরভাগ মানুষের জন্য যতটা সম্ভব সামঞ্জস্যপূর্ণ করার চেষ্টা করা যায়।
সম্প্রতি কানাডার কুইবেকে লাভাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা 'এ' পজিটিভ রক্তের দাতাদের কাছ থেকে রক্তের স্টেমসেল সংগ্রহ করেন। এরপর তারা সিআরআইএসপিআর-সিএএস৯ প্রযুক্তি ব্যবহার করে 'এ' এবং 'আরএইচ' অ্যান্টিজেনের জন্য কোডিং করা জিনগুলো মুছে ফেলেন, যার ফলে ও আরএইচ নাল অপরিপক্ব লোহিত রক্তকণিকা তৈরি হয়।
অন্যদিকে বার্সেলোনার গবেষকরা সম্প্রতি একজন আরএইচ নাল রক্তদাতার কাছ থেকে স্টেমসেল নিয়েছিলেন এবং সিআরআইএসপিআর-সিএএস৯ ব্যবহার করে তাদের রক্তকে 'এ' টাইপ থেকে 'ও' টাইপে রূপান্তরিত করেছিলেন, যা এটিকে আরও সার্বজনীন করে তুলেছিল। তবু এই অসাধারণ প্রচেষ্টা সত্ত্বেও বলা গুরুত্বপূর্ণ যে, এমন কৃত্রিম ল্যাব-উৎপাদিত রক্ত এমন পরিমাণে তৈরি করা, যা মানুষ ব্যবহার করতে পারে, সেটি এখনো অনেক দূরের বিষয়।
প্রফেসর টোয়ে রিস্টোর নামে পরিচিত গবেষণার ট্রায়ালের সহ-নেতৃত্বে আছেন। এটি বিশ্বের প্রথম ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল, যেখানে দাতার রক্তের স্টেমসেল থেকে ল্যাবরেটরিতে কৃত্রিমভাবে উৎপাদিত লোহিত রক্তকণিকা স্বেচ্ছাসেবীদের পরীক্ষামূলকভাবে দেওয়া হচ্ছে। পরীক্ষামূলক এই কৃত্রিম রক্তে কোনোভাবেই জিন এডিট করা হয়নি। তবে মানবদেহে পরীক্ষা করার পর্যায়ে পৌঁছাতে বিজ্ঞানীদের ১০ বছর গবেষণা লেগেছে।
