সেবার লক্ষ্যে স্বপ্নের ক্যারিয়ার
জুবাইয়া বিন্তে কবির
প্রকাশ: ০৫ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
মানুষের জীবনে কিছু স্বপ্ন থাকে, যা সময়ের পরিক্রমায় কেবল লক্ষ্য নয়-দায়বদ্ধতার প্রতীক হয়ে ওঠে। কেউ শিল্পী হতে চায়, কেউ উদ্যোক্তা, কেউবা শিক্ষক। কিন্তু বাংলাদেশের অসংখ্য তরুণ-তরুণীর স্বপ্নে একটিই নাম বারবার প্রতিধ্বনিত হয়-বিসিএস। এ তিনটি অক্ষর যেন এক আলাদা গৌরব, সম্মান, দায়িত্ব আর সম্ভাবনার প্রতিশব্দ। লিখেছেন জুবাইয়া বিন্তে কবির
বিসিএস
বাংলাদেশের প্রথম শ্রেণির সরকারি চাকরিতে নিয়োগের সর্বোচ্চ প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার নাম বিসিএস; যা পরিচালনা করে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন (বিপিএসসি)। সহজভাবে বলতে গেলে, এটি এমন এক সেতু, যা মেধাবী তরুণদের দেশের প্রশাসন, পররাষ্ট্র, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, পুলিশ, ট্যাক্স, অডিটসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ খাতে প্রবেশের সুযোগ দেয়। প্রজাতন্ত্রের এ চাকরিতে নিয়োগপ্রাপ্তরা শুধু রাষ্ট্রের কর্মচারী নন-তারা জনগণের সেবক, উন্নয়নের সৈনিক। তাদের হাত ধরেই বাস্তবায়িত হয় সরকারের নীতি, পরিকল্পনা ও আইন। বিসিএস’র পূর্ণরূপ ‘বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস’ (Bangladesh Civil Service-BCS)।
কেন বিসিএস
আমাদের সমাজে কিছু পেশা আছে যেগুলো কেবল চাকরি নয়, এক ধরনের মর্যাদা ও বিশ্বাসের প্রতীক। বিসিএস তারই একটি। বিসিএস ক্যাডার মানে সম্মান, নিশ্চয়তা, স্থায়িত্ব এবং জনসেবার সুযোগ-যা একসঙ্গে খুব কম পেশাতেই মেলে। একজন বিসিএস ক্যাডারের নামের পাশে যুক্ত হয় ‘জনতার প্রতিনিধি’র গৌরব। তার হাতে থাকে দেশের উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়নের দায়িত্ব। সমাজে সম্মানের চোখে দেখা হয় তাকে, সরকারি অনুষ্ঠানে থাকে বিশেষ মর্যাদা এবং পরিবারে এনে দেন নিশ্চিন্ত ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি।
এ কারণেই দেশের প্রায় ৯০ ভাগ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী অনার্স শেষ করেই বিসিএসের দিকে ছুটে যান। কন্যার বাবা-মা সন্তানের নিরাপত্তা ও সম্মানের আশায় খোঁজেন একজন ‘বিসিএস ক্যাডার’ পাত্র। সমাজে এরকম একটি অবস্থান আজও আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। বিসিএস ক্যাডার মানে কী? ‘ক্যাডার’ মানে কোনো নির্দিষ্ট কাজে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একটি দল। বিসিএস ক্যাডাররা মূলত দুই শ্রেণির। একটি হচ্ছে জেনারেল ক্যাডার (প্রশাসন, পুলিশ, পররাষ্ট্র, ট্যাক্স, কাস্টমস ইত্যাদি), অন্যটি টেকনিক্যাল ক্যাডার (শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রকৌশল, কৃষি ইত্যাদি বিশেষজ্ঞ ক্ষেত্র)। জেনারেল ক্যাডারে যে কোনো বিষয়ের শিক্ষার্থী আবেদন করতে পারেন, তবে টেকনিক্যাল ক্যাডারের জন্য নির্দিষ্ট ডিগ্রি (যেমন-এমবিবিএস, বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং ইত্যাদি) আবশ্যক। বর্তমানে বাংলাদেশে মোট ২৭টি ক্যাডার রয়েছে। প্রশাসন ক্যাডার থেকে শুরু করে চিকিৎসা, শিক্ষা, তথ্য, বন, মৎস্য-সব ক্ষেত্রেই রয়েছে রাষ্ট্রের সেবায় যুক্ত হওয়ার সুযোগ।
কেন এত প্রতিযোগিতা
বিসিএস পরীক্ষা আজ বাংলাদেশের সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষাগুলোর একটি। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে যেখানে গড়ে প্রতি আসনে প্রতিযোগিতা করেন ২০ জন শিক্ষার্থী, সেখানে ৪১তম বিসিএসে প্রতি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন প্রায় ২৩৭ জন প্রার্থী! এত প্রতিযোগিতা সত্ত্বেও তরুণরা বিসিএসের দিকে ঝুঁকছেন-কারণ এটি শুধুই একটি চাকরি নয়, এটি সামাজিক অবস্থানের প্রতীক। চাকরির শুরুতেই বেতন শুরু হয় নবম গ্রেডে (বেসিক ২২,০০০ টাকা), সঙ্গে থাকে ইনক্রিমেন্ট, বাড়িভাড়া, শিক্ষা ভাতা, যোগাযোগ ভাতা, চিকিৎসা ও পেনশন সুবিধা। তদুপরি, চাকরির স্থায়িত্ব এবং সম্মানজনক অবসরকালীন জীবন বিসিএসকে নিয়ে গেছে এক অনন্য উচ্চতায়।
বিসিএস পরীক্ষার ধাপ
বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হলে একজন প্রার্থীকে তিনটি ধাপ অতিক্রম করতে হয়। প্রথম ধাপে রয়েছে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা। এটি ২০০ নম্বরের বহুনির্বাচনি (এমসিকিউ) পরীক্ষা, সময় দুই ঘণ্টা। ১০টি বিষয়ে প্রশ্ন থাকে-বাংলা, ইংরেজি, বাংলাদেশ বিষয়াবলি, আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি, গণিত, মানসিক দক্ষতা, বিজ্ঞান, তথ্যপ্রযুক্তি, ভূগোল, নৈতিকতা ও মূল্যবোধ। এটি শুধু বাছাই পরীক্ষা। দ্বিতীয় ধাপে রয়েছে লিখিত পরীক্ষা। প্রিলিতে উত্তীর্ণ প্রার্থীরা ৯০০ নম্বরের লিখিত পরীক্ষায় অংশ নেন। এখানে মূলত মেধা, বিশ্লেষণ ও লেখনীর দক্ষতা যাচাই করা হয়। প্রতিটি বিষয়ের গড় পাস নম্বর ৫০ শতাংশ। তৃতীয় ধাপে হয় মৌখিক (ভাইভা) পরীক্ষা। লিখিত উত্তীর্ণদের ২০০ নম্বরের মৌখিক পরীক্ষায় ডাকা হয়। একজন চেয়ারম্যান ও বোর্ডের সদস্যরা প্রার্থীর জ্ঞান, চিন্তাভাবনা, ব্যক্তিত্ব, সমাজ-রাজনীতি সচেতনতা এবং আত্মবিশ্বাস যাচাই করেন। মোট নম্বর : লিখিত ৯০০+ভাইভা ২০০=১১০০। ফলাফলের ভিত্তিতে বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন (বিপিএসসি) নিয়োগের সুপারিশ করে। এরপর হয় স্বাস্থ্য পরীক্ষা, পুলিশ ও এনএসআই ভেরিফিকেশন এবং সর্বশেষ গেজেট প্রকাশ।
প্রস্তুতির সঠিক কৌশল
বিসিএস-এ সফল হতে হলে শুধু মেধা নয়, দরকার সুশৃঙ্খল অধ্যবসায় ও কৌশল। প্রতিযোগিতার এ পরীক্ষায় সফলদের অভিজ্ঞতা বলে-‘যারা নিয়মিত, তারাই টিকে’।
প্রতিদিনের পরিকল্পনা
১. পত্রিকা পড়া : জাতীয় ও আন্তর্জাতিক খবর, নীতিনির্ধারণী পরিবর্তন, অর্থনীতি, বিজ্ঞান ও পরিবেশ বিষয়ক খবর পড়ার অভ্যাস করুন।
২. নোট তৈরি : সূত্র, গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও ডেটা আলাদা খাতায় লিখে রাখুন।
৩. মডেল টেস্ট : প্রতিদিন সময় বেঁধে মডেল টেস্ট দিন। চেষ্টা করুন ১ ঘণ্টা ৪৫ মিনিটে সমাধান শেষ করতে।
৪. রিভিশন : শেষ সপ্তাহে নতুন কিছু না পড়ে পুরোনো বিষয়গুলো দুই থেকে তিনবার ঝালিয়ে নিন।
৫. বিষয়ভিত্তিক টিপস, বাংলা ও ইংরেজি : বানান, শব্দার্থ, স্পেলিং, গ্রামার, রচনাশৈলী অনুশীলন করুন।
৬. গণিত ও মানসিক দক্ষতা : বিগত প্রশ্ন সমাধান করে সূত্র মনে রাখুন।
৭. বিজ্ঞান ও আইসিটি : জীবাণু, খাদ্য, রোগ-প্রতিরোধ, নোবেল বিজয়ী, প্রযুক্তি ও এআই বিষয়গুলো হালনাগাদ রাখুন।
৮. নৈতিকতা ও সুশাসন : মনীষীদের উক্তি, বিখ্যাত বইয়ের নাম, নীতিবোধমূলক ধারণাগুলো পড়ুন।
৯. মানসিক দৃঢ়তা : বিসিএস প্রস্তুতির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ‘ধৈর্য’। এখানে হঠাৎ সাফল্য আসে না; বরং প্রতিদিনের ছোট ছোট প্রস্তুতিই বড় সাফল্যের দিকে নিয়ে যায়। ‘Slow and steady wins the race’- এ নীতিতে বিশ্বাস রাখুন।
নারীদের অংশগ্রহণ
আজকের বিসিএস প্রজন্মে মেয়েদের অংশগ্রহণ বিশেষভাবে চোখে পড়ার মতো। যারা একসময় ঘর-সংসার সামলে পেশাগত জীবনে সীমাবদ্ধ ছিলেন, তারা এখন দেশের প্রশাসন, পুলিশ, পররাষ্ট্র ও শিক্ষা খাতে কৃতিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন। তারা প্রমাণ করেছেন-মেধা, সাহস ও পরিশ্রম থাকলে লিঙ্গ নয়, যোগ্যতাই সাফল্যের মানদণ্ড।
সর্বশেষ তথ্য
২০২৫ সালের শুরুতে প্রকাশিত ৪৮তম বিসিএস (বিশেষ) বিজ্ঞপ্তিতে প্রায় ৩,০০০ চিকিৎসক নিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে সরকার। অন্যদিকে, নিয়মিত ৪৭তম বিসিএস পরীক্ষার ফল প্রকাশের প্রস্তুতিও নিচ্ছে পাবলিক সার্ভিস কমিশন (বিপিএসসি)। কমিশন জানিয়েছে, ভবিষ্যতে বছরে অন্তত দুটি বিসিএস পরীক্ষা সম্পন্ন করার পরিকল্পনা রয়েছে-যাতে দীর্ঘ প্রতীক্ষা কমে এবং দ্রুত নিয়োগ নিশ্চিত হয়।
পরিশেষে, বিসিএস কেবল একটি চাকরির নাম নয়-এটি এক প্রজন্মের আত্মপ্রত্যয়, আত্মত্যাগ ও আত্মসম্মানের প্রতীক। যারা প্রতিদিন ভোরে উঠে বই হাতে নেন, ক্লান্ত সন্ধ্যায়ও মডেল টেস্ট দেন, তারা কেবল নিজের নয়, দেশের ভবিষ্যৎ গড়ছেন। এ পথ সহজ নয়। প্রতিযোগিতা কঠিন, সময় দীর্ঘ, মানসিক চাপ প্রবল। কিন্তু যারা বিশ্বাস করেন, ‘আমি পারব’, তাদের জন্য বিসিএস কেবল একটি স্বপ্ন নয়-একটি ইতিহাস হয়ে ওঠে। নিজেকে প্রস্তুত করুন জ্ঞান, ধৈর্য, নিয়মিত অনুশীলন আর ইতিবাচক মানসিকতায়। যেদিন গেজেটে আপনার নাম ছাপা হবে, সেদিন বুঝবেন আপনার প্রতিটি জাগ্রত রাত, প্রতিটি পরিশ্রমী সকাল সত্যিকার অর্থেই সার্থক হয়েছে। সবাইকে শুভকামনা।
পরামর্শ
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (পবিপ্রবি) উপাচার্য, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও গবেষক এবং সাবেক বিসিএস লাইভস্টক ক্যাডার অধ্যাপক ড. কাজী রফিকুল ইসলাম তরুণ প্রজন্মকে অনুপ্রেরণা দিয়ে বলেন, ‘বিসিএস কেবল একটি চাকরির সুযোগ নয়, এটি আজীবন শেখার এক যাত্রা। যারা রাষ্ট্রের সেবক হতে চায়, তাদের উচিত নিজের ভিতকে শক্ত করা-নৈতিকতা, দায়িত্ববোধ ও মানবিকতার ভেতরে। শুধু বই পড়লেই বিসিএস হয় না; একজন প্রকৃত ক্যাডার হন যিনি মানুষের মুখে হাসি ফোটান, প্রশাসনে সততা আনেন এবং দেশের উন্নয়নে নিজেকে নিবেদন করেন। বিসিএসের জন্য প্রস্তুতি মানে শুধু পাস করা নয়, নিজেকে গড়ে তোলা- একজন যোগ্য নাগরিক হিসাবে’। অধ্যাপক ড. কাজী রফিকুল ইসলাম আরও বলেন, ‘অধ্যবসায়, সময়ানুবর্তিতা ও ইতিবাচক মানসিকতা-এ তিনটি জিনিস যদি কেউ ধারণ করতে পারে, তবে বিসিএস তার নাগালের বাইরে নয়।’
