কওমি মাদ্রাসা : জ্যোতির্ময় ঐতিহ্য
শরীফুল ইসলাম
প্রকাশ: ১২ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
শিক্ষা শুধু জ্ঞান অর্জনের মাধ্যম নয়; এটি জাতির আত্মচেতনা গঠনের ও নৈতিক শক্তি প্রতিষ্ঠার গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি। কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা সেই আলোকিত পথের বাস্তব রূপ, যেখানে শিক্ষার্থীর হৃদয় ও মেধা উভয়ই ইসলামি জ্ঞান ও নৈতিকতার আলোয় আলোকিত হয়। শতাব্দী প্রাচীন এ শিক্ষার ঐতিহ্য শুধু গৌরবময় নয় বরং আধুনিক সমাজের চাহিদার সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে থাকা এক জীবনমুখী প্রক্রিয়া, যা নতুন প্রজন্মকে চিন্তাশীল, দায়িত্বশীল ও ধর্মনিষ্ঠ নাগরিক হিসাবে গড়ে তুলছে। যুগের সঙ্গে বদলে যাওয়া সমাজে সঠিক নৈতিক ও ধর্মীয় নেতৃত্ব গঠনে এ শিক্ষাব্যবস্থা অপরিহার্য ভূমিকা পালন করছে। কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার ঐতিহ্য, গৌরব ও সম্ভাবনার চিত্র তুলে ধরেছেন শরীফুল ইসলাম
ইতিহাসের সূচনা
কওমি মাদ্রাসা হলো ভারতীয় উপমহাদেশের ইসলামিক শিক্ষার এক স্বতন্ত্র ধারা, যার জন্ম হয় মুসলিম সমাজের ধর্মীয় পরিচয় ও স্বকীয়তা রক্ষার প্রয়োজনে। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের পর ব্রিটিশদের শিক্ষা সংস্কারের প্রতিক্রিয়ায় ১৮৬৬ সালে ভারতের দেওবন্দে প্রতিষ্ঠিত হয় দারুল উলুম দেওবন্দ-যেখান থেকেই কওমি শিক্ষার যাত্রা শুরু। এ প্রতিষ্ঠান সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা না নিয়ে জনগণের অর্থে পরিচালিত হতো, তাই এর নাম হয় ‘কওমি’ অর্থাৎ জনগণের মাদ্রাসা। দেওবন্দের শিক্ষাপদ্ধতির মূল লক্ষ্য ছিল ইসলামি জ্ঞান-বিশেষ করে কুরআন, হাদিস, তাফসির, ফিকাহ ও আরবি ভাষার শিক্ষা এবং মুসলিম সমাজের নৈতিক উন্নয়ন। অল্প সময়ের মধ্যেই এ পদ্ধতি উপমহাদেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।
বাংলাদেশে কওমি শিক্ষার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে চট্টগ্রামের আল-জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম (১৯০১) ও ঢাকার জামিয়া কুরআনিয়া আরাবিয়া লালবাগসহ (১৯৫০) আরও উল্লেখযোগ্য অনেক কওমি মাদ্রাসা। ব্রিটিশ শাসনামলে ধর্মীয় পরিচয় রক্ষার পাশাপাশি কওমি মাদ্রাসাগুলো ব্রিটিশবিরোধী চেতনা জাগ্রত করতেও ভূমিকা রাখে। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে এসব মাদ্রাসার সংখ্যা দ্রুত বাড়ে। বর্তমানে দেশে ১৯ হাজারের বেশি কওমি মাদ্রাসা রয়েছে, যেখানে প্রায় ২০ লাখ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। আল হাইআতুল উলয়া লিল জামিআতিল কওমিয়া বাংলাদেশ এবং এর অন্তর্ভুক্ত ছয়টি বোর্ড দেশের হাজারো কওমি মাদ্রাসার পাঠ্যসূচি, পরীক্ষা ও সনদ প্রদানের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ ও সমন্বয় করছে। ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা বিস্তারে কওমি মাদ্রাসাগুলো এক বিশেষ স্থান ধরে রেখেছে।
ধর্মীয় ও জাতীয় ক্ষেত্রে অবদান
কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা আজ ধর্মীয় ও জাতীয় উভয় ক্ষেত্রেই তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখছেন। ধর্মীয় ক্ষেত্রে তারা ইসলামের সঠিক ব্যাখ্যা ও প্রচারে নিবেদিত থেকে সমাজে নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। মসজিদে ইমাম বা খতিব হিসাবে তারা জুমার খুতবা, ধর্মীয় আলোচনা ও নৈতিক দিকনির্দেশনার মাধ্যমে মানুষের চিন্তাজগতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছেন। তরুণ প্রজন্মকে ইসলামি আদর্শে উদ্বুদ্ধ করা, ধর্মীয় বিভ্রান্তি দূর করা এবং সমাজে ধর্মীয় সচেতনতা গড়ে তোলাতেও তারা সক্রিয় ভূমিকা রাখছেন।
জাতীয় ক্ষেত্রেও কওমি শিক্ষার্থীরা সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নয়নে অবদান রাখছেন। তারা দারিদ্র্য বিমোচন, শিক্ষার প্রসার, স্বাস্থ্যসচেতনতা ও সামাজিক শান্তি প্রতিষ্ঠায় অংশ নিচ্ছেন। দুর্যোগের সময় স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রম, এতিমখানা ও দাতব্য প্রতিষ্ঠান পরিচালনা এবং অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর মাধ্যমে তারা সমাজসেবার অগ্রভাগে রয়েছেন। বিশেষত শিক্ষা, ধর্ম ও সামাজিক কল্যাণমূলক ক্ষেত্রে তাদের অংশগ্রহণ ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। আন্তর্জাতিক পরিসরেও কওমি শিক্ষার্থীরা ইসলামি গবেষণা, কুরআন প্রতিযোগিতা, দাওয়াতি কার্যক্রম ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশের কওমি শিক্ষার গৌরব ও মান বিশ্ব দরবারে তুলে ধরছেন। সব মিলিয়ে, কওমি শিক্ষাব্যবস্থা আজ শুধু ধর্মীয় শিক্ষার ধারক নয়, বরং সমাজ, রাষ্ট্র ও মানবকল্যাণের এক গুরুত্বপূর্ণ শক্তিতে পরিণত হয়েছে।
কওমি মাদ্রাসার প্রাচীন ঐতিহ্য
কওমি মাদ্রাসা মুসলিম সমাজের ধর্মীয়, নৈতিক ও জ্ঞানচর্চার এক প্রাচীন ঐতিহ্য। ইতিহাসের দীর্ঘ পরিক্রমায় মুসলিম সমাজের আত্মপরিচয়, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় চেতনা টিকিয়ে রাখার অন্যতম বাহক হলো কওমি মাদ্রাসা, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ইসলামি জ্ঞান, নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধের শিক্ষা ছড়িয়ে দিয়েছে। এর শিকড় নবী যুগের ‘সুফ্ফা’ ব্যবস্থায়, যেখানে সাহাবিরা মসজিদে বসে কুরআন ও হাদিস শিক্ষা গ্রহণ করতেন। পরবর্তী সময়ে ইসলামি সাম্রাজ্যের বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে বাগদাদ, কায়রো ও আন্দালুসে প্রতিষ্ঠিত হয় বহু মাদ্রাসা, যা ইসলামি শিক্ষার কেন্দ্র হয়ে ওঠে। ভারতীয় উপমহাদেশে এ ধারার পূর্ণ বিকাশ ঘটে ১৮৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত দারুল উলুম দেওবন্দের মাধ্যমে। ব্রিটিশ শাসনের ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষার বিপরীতে এ প্রতিষ্ঠান ইসলামি জ্ঞান, নৈতিকতা ও আত্মনির্ভরতার আদর্শে শিক্ষাদান শুরু করে। জনগণের অনুদানে পরিচালিত এ শিক্ষাব্যবস্থাই ‘কওমি’ নামে পরিচিত হয়। বাংলাদেশে হাটহাজারী, পটিয়া ও অন্যান্য অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসাগুলো সেই ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। শতাব্দী পেরিয়ে আজও এ মাদ্রাসাগুলো ইসলামি জ্ঞান ও নৈতিকতার আলোকবর্তিকা হয়ে টিকে আছে, যা প্রমাণ করে-কওমি শিক্ষা শুধু অতীতের ঐতিহ্য নয়, বরং বর্তমান ও ভবিষ্যতের নৈতিক দিকনির্দেশকও।
ক্যারিয়ার সম্ভাবনা
বাংলাদেশের কওমি মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা দীর্ঘদিন ধরে দেশের ধর্মীয় শিক্ষার এক শক্তিশালী ভিত্তি হিসাবে পরিচিত। ধর্মীয় জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি তারা এখন সমাজের বিভিন্ন পেশায় নিজেদের স্থান করে নিতে পারছে, যা তাদের ব্যক্তিগত এবং সামাজিক জীবনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। কওমি মাদ্রাসা থেকে পড়াশোনা সম্পন্ন করে শিক্ষার্থীদের দেশের নানা ক্ষেত্রে চাকরির সুযোগ রয়েছে। শিক্ষার্থীরা ইসলামিক শিক্ষা ও দাওয়াতি কার্যক্রমে নিবেদিত থেকে দেশের গ্রাম-শহরের অসংখ্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, মসজিদ ও মাদ্রাসায় শিক্ষক, খতিব বা ইসলামিক স্কলার হিসাবে কর্মজীবন শুরু করতে পারেন। এ ছাড়া স্কুল, কলেজ ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগেও তারা যোগ দিতে পারেন। বিশেষ করে যদি তারা সাধারণ শিক্ষার কিছু স্তরও সম্পন্ন করেন। পাশাপাশি তারা ইসলামি ব্যাংকিং ও অর্থনীতি, হালাল প্রোডাক্ট সার্টিফিকেশন, ইসলামি আইন ও ফিকহ সংক্রান্ত পরামর্শদাতা হিসাবে বিভিন্ন সংস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম।
কওমি শিক্ষার্থীদের পেশাজীবনের সুযোগও বহুমুখী হয়েছে। অর্থনীতি, সাংবাদিকতা, মিডিয়া, ইসলামিক গবেষণা এবং সাহিত্যচর্চা-সব ক্ষেত্রেই নিজেকে প্রমাণের সুযোগ রয়েছে। উদ্যোক্তা হিসাবেও কওমি শিক্ষিত তরুণরা হালাল ব্যবসা, ইসলামিক পণ্য ও সেবার মাধ্যমে অর্থনৈতিক দিক থেকে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। আইন ও বিচার ক্ষেত্রে ফিকহ ও ইসলামিক আইন বিশেষজ্ঞ হিসাবে তারা পারিবারিক ও শরিয়াহ আইন প্রয়োগে সহায়ক। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করা, ইসলামিক সম্মেলন ও সংলাপে অংশ নেওয়া-সব ক্ষেত্রেই তাদের দক্ষতা কাজে লাগছে। সুতরাং, কওমি মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা বর্তমানে একটি গতিশীল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যা শিক্ষার্থীদের জন্য এক উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ এবং বহুমুখী কর্মজীবনের সুযোগ তৈরি করছে।
শিক্ষা কারিকুলাম ও পাঠদান প্রক্রিয়া
বাংলাদেশের কওমি মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা, যা দারুল উলুম দেওবন্দের শিক্ষাদর্শন ও কারিকুলামের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে। বর্তমানে আল হাইআতুল উলয়া লিল জামিআতিল কওমিয়া বাংলাদেশ এবং এর অন্তর্ভুক্ত ছয়টি বোর্ড দেশের হাজারও কওমি মাদ্রাসার পাঠ্যসূচি, পরীক্ষা ও সনদ প্রদানের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ ও সমন্বয় করছে। কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা কারিকুলাম মূলত ধর্মীয় জ্ঞানকেন্দ্রিক। শিক্ষার্থীরা প্রথমে নুরানী, নাজেরা ও হিফজ বিভাগে শিক্ষা গ্রহণ করে, যেখানে কুরআন তিলাওয়াত, তাজবিদ এবং মুখস্থ করার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এরপর তারা কিতাব বিভাগে প্রবেশ করে, যা বিভিন্ন ধাপে বিভক্ত-ইবতেদায়ি (প্রাথমিক), মুতাওয়াসসিতা (নিম্ন মাধ্যমিক), সানাবিয়া উলইয়া বা ফাজিল (উচ্চ মাধ্যমিক বা স্নাতক) এবং দাওরায়ে হাদিস (মাস্টার্স)।
ইবতেদায়ি বা প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার্থীদের আরবি বর্ণমালা, তাজবিদসহ কুরআন পাঠ, প্রাথমিক গণিত, বাংলা ও ইংরেজি ভাষার মৌলিক জ্ঞান শেখানো হয়। পাশাপাশি ইসলামি আকিদা, আমল ও নৈতিকতার প্রাথমিক ধারণা প্রদান করা হয়, যাতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি অনুরাগ ও শৃঙ্খলা গড়ে ওঠে। মুতাওয়াসসিতা বা নিম্ন মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার্থীরা আরবি ভাষা ও ব্যাকরণ (নাহু ও সরফ), ফিকাহের প্রাথমিক কিতাব-যেমন কুদুরি, হাদিসের প্রাথমিক গ্রন্থ, আরবি সাহিত্য, উসুলে ফিকাহ, মানতিক (যুক্তিবিদ্যা) ইত্যাদি বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করে। একইসঙ্গে বাংলা, ইংরেজি, গণিত ও বিজ্ঞানসহ আধুনিক জ্ঞানের কিছু অংশও অন্তর্ভুক্ত থাকে। এরপর আসে সানাবিয়া উলইয়া বা ফাজিল স্তর, যা কওমি শিক্ষাব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়। এ স্তরে শিক্ষার্থীরা ফিকাহের মূল গ্রন্থ যেমন হেদায়া, উসুলে ফিকাহ, উসুলে তাফসির, হাদিসের ব্যাখ্যাগ্রন্থ, আরবি সাহিত্য ও অলঙ্কারশাস্ত্র (বালাগাত), আকাঈদ ও কালামশাস্ত্র, ফার্সি ভাষা ও সাহিত্য, ইসলামের ইতিহাস ইত্যাদি পাঠ করে।
পেশাগত সাফল্যে কওমি শিক্ষার্থীরা
বাংলাদেশের কওমি মাদ্রাসাগুলো এক সময় শুধুই ধর্মীয় শিক্ষার কেন্দ্র হিসাবে বিবেচিত হতো। কুরআন-হাদিস, ফিকহ, আরবি ব্যাকরণ-এসবই ছিল শিক্ষার মূল ধারা। কিন্তু সময় বদলেছে। আধুনিক সমাজের চাহিদা, তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশ এবং জ্ঞানভিত্তিক কর্মক্ষেত্রের প্রসার কওমি শিক্ষার্থীদেরও নতুন ভাবনার দিকে নিয়ে গেছে। আজ কওমি পটভূমি থেকে উঠে আসা তরুণরা সাংবাদিকতা, শিক্ষকতা, গবেষণা, লেখালেখি এমনকি আন্তর্জাতিক ফোরামেও নিজেদের দক্ষতা ও মননশীলতা দিয়ে আলো ছড়াচ্ছে।
শিক্ষকতায় দৃঢ় অবস্থান
কওমি শিক্ষাব্যবস্থার মূল ভিত্তিই শিক্ষকতা। ফলে এ ক্ষেত্রটিতে তাদের প্রভাব সবচেয়ে গভীর ও ঐতিহ্যবাহী। তবে সাম্প্রতিক সময়ে কওমি পটভূমির শিক্ষার্থীরা শুধু মাদ্রাসার গণ্ডিতে নয়, সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও শিক্ষকতা করছেন। স্কুল, কলেজ, ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি বিদেশের ইসলামি ইনস্টিটিউটগুলোতেও দেখা যায় কওমি সনদধারী তরুণ শিক্ষকরা পাঠদান করছেন। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়-মাওলানা হাফিজুল ইসলাম, যিনি দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করে বর্তমানে মালয়েশিয়ার ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটিতে (আইআইইউএম) অতিথি শিক্ষক হিসাবে কাজ করছেন। তার মতে, ‘কওমি শিক্ষার ভিত আমাকে জ্ঞানের প্রতি ভালোবাসা শিখিয়েছে, যা আন্তর্জাতিক পরিসরেও সমানভাবে কাজে লাগে।’ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কওমি শিক্ষার্থীদের শিক্ষকতায় প্রবেশের সুযোগ আরও বিস্তৃত হচ্ছে। অনেকে স্কুল ও কলেজে ইসলামি স্টাডিজ, আরবি সাহিত্য এবং তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব বিভাগে লেকচারার হিসাবে কর্মরত। এর মাধ্যমে তারা ধর্মীয় জ্ঞানকে আধুনিক গবেষণার কাঠামোর সঙ্গে সংযুক্ত করছেন।
সাংবাদিকতায় নতুন স্বর
সাংবাদিকতা এখন কওমি শিক্ষার্থীদের এক উজ্জ্বল উপস্থিতির ক্ষেত্র। ইসলামি দৃষ্টিকোণ ও সমাজবোধের গভীরতা তাদের সংবাদ উপস্থাপনে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, ঢাকার জামিয়া কুরআনিয়া লালবাগের সাবেক ছাত্র মাওলানা লিয়াকত আলী বর্তমানে দৈনিক নয়া দিগন্ত’র সিনিয়র সহসম্পাদক হিসাবে কাজ করছেন। তার লেখা বিশ্লেষণধর্মী কলামগুলোতে দেখা যায় ধর্মীয় মূল্যবোধের সঙ্গে সমসাময়িক সামাজিক বিশ্লেষণের চমৎকার মেলবন্ধন।
অন্যদিকে রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি বিদ্যাপীঠ জামেয়া শারইয়্যা মাদ্রাসার সাবেক ছাত্র মাওলানা তানজিল আমির বর্তমানে দৈনিক যুগান্তরের অনলাইন বিভাগে সহসম্পাদক। পুরোদস্তুর কওমি শিক্ষিত এ আলেম বিস্তৃত পরিসরে কাজের সুবাদে পা রেখেছেন সংবাদ ও সাংবাদিকতার জগতে। এ ধারাবাহিকতারই অংশ সময়ের আলোর সহসম্পাদক মাওলানা রায়হান রাশেদ কওমি শিক্ষা শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স-মাস্টার্স করে বর্তমানে আধুনিক সংবাদ পরিবেশনার সঙ্গে যুক্ত। তাদের মতো আরও অনেক তরুণ এখন অনলাইন পোর্টাল, টেলিভিশন ও প্রিন্ট মিডিয়ায় যুক্ত হয়ে পেশাদার সাংবাদিক হিসাবে কাজ করছেন।
গবেষণা ও লেখালেখিতে বুদ্ধিবৃত্তিক উত্থান
কওমি শিক্ষার্থীরা গবেষণা ও লেখালেখির ক্ষেত্রেও ধীরে ধীরে নিজেদের জায়গা করে নিচ্ছেন। এক সময় যাদের লেখালেখি ছিল শুধু ধর্মীয় ম্যাগাজিন বা ইসলামি পত্রিকায় সীমিত, এখন তারা জাতীয় দৈনিক, অনলাইন প্ল্যাটফর্ম, এমনকি একাডেমিক জার্নালেও লিখছেন। ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ বিভিন্ন অঞ্চলে কওমি শিক্ষার্থীদের গঠিত গবেষণা সংগঠন ও লার্নিং সার্কেলগুলো ইসলামি আইন, সমকালীন সমাজনীতি এবং শিক্ষা-সংস্কার বিষয়ে গবেষণা করছে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়-‘আরবি উইকিপিডিয়া ও বাংলা উইকিপিডিয়ায় ইসলামি পরিভাষার সঠিক অনুবাদে কওমি শিক্ষার্থীদের অবদান ক্রমেই বাড়ছে।’ তারা অনলাইন প্ল্যাটফর্মে ধর্মীয় জ্ঞানকে বিশ্বায়িত ভাষায় রূপান্তর করছে, যা এক নতুন জ্ঞানচর্চার দ্বার খুলে দিয়েছে। তা ছাড়া ‘মাসিক মুঈনুল ইসলাম’, ‘রাহমানী পয়গাম’, ‘আল-বয়ান’, ‘আল-কাউসার’ প্রভৃতি পত্রিকায় নিয়মিত লেখছেন কওমি তরুণ লেখকরা। ধর্মীয় ভাবনা থেকে শুরু করে সামাজিক সংকট, নারী শিক্ষা, নৈতিক উন্নয়ন-নানা বিষয়ে তাদের বিশ্লেষণ সমাজে ইতিবাচক চিন্তার জোয়ার তৈরি করছে।
বিশ্বজুড়ে উচ্চশিক্ষার নতুন সম্ভাবনা
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কওমি মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের জন্য বিদেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। সরকারের স্বীকৃত ‘দাওরায়ে হাদিস’ সনদ এখন বহু আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে, বিশেষত ইসলামিক স্টাডিজ, আরবি ভাষা, দাওয়াহ, শিক্ষা ও মানবিক শাখায়। মালয়েশিয়া, তুরস্ক, সৌদি আরব, কাতার, মিশর বিভিন্ন নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে কওমি শিক্ষার্থীরা বৃত্তি ও স্বনির্ভর উভয়ভাবেই পড়াশোনা করছে।
আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয় : মিশরের প্রাচীন ও বিশ্বখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয় ইসলামি জ্ঞানের পাশাপাশি আধুনিক শিক্ষার এক অনন্য কেন্দ্র। শুধু শরিয়াহ বা আরবি ভাষা নয়-এখানে চিকিৎসা, প্রকৌশল, কৃষিবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞানসহ নানা বিষয়ে পড়াশোনার সুযোগ রয়েছে।
মদিনা ও উম্মুল কুরা বিশ্ববিদ্যালয় : মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো বিশেষ করে সৌদি আরব কওমি শিক্ষার্থীদের জন্য উচ্চশিক্ষার সুবর্ণ সুযোগ সৃষ্টি করেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ দুটি প্রতিষ্ঠান হলো মদিনা ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় এবং উম্মুল কুরা বিশ্ববিদ্যালয়। মদিনা ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের পূর্ণ বৃত্তিতে পড়ার সুযোগ দেয়-যেখানে হাদিস, তাফসির, শরিয়াহ ও দাওয়াহবিষয়ক ডিগ্রি প্রদান করা হয়।
কাতার বিশ্ববিদ্যালয় : কাতার বিশ্ববিদ্যালয় সাম্প্রতিক সময়ে ইসলামি উচ্চশিক্ষার অন্যতম আধুনিক কেন্দ্র হিসাবে পরিচিতি পেয়েছে। এর শরিয়া ও ইসলামি গবেষণা, আধুনিক প্রযুক্তি, আন্তর্জাতিক মানের পাঠদান এবং গবেষণাভিত্তিক শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের যুগোপযোগীভাবে গড়ে তোলে।
দেওবন্দ ও নদওয়া : ভারতের উত্তর প্রদেশের ঐতিহাসিক শহর দেওবন্দে অবস্থিত দারুল উলুম দেওবন্দ কওমি মাদ্রাসা। এখান থেকেই বাংলাদেশের কওমি শিক্ষাব্যবস্থার বিকাশ ঘটেছে। সেখানে তারা কুরআন, হাদিস, ফিকহ, তাফসির ও আরবি সাহিত্যে গভীর দক্ষতা অর্জন করেন। আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষক, সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার ও গবেষণার পরিবেশ শিক্ষার্থীদের যোগ্য আলেম হিসাবে গড়ে তোলে।
পথিকৃতের ভূমিকায় যেসব প্রতিষ্ঠান
বাংলাদেশে কওমি মাদ্রাসা ইসলামি জ্ঞান ও সংস্কৃতি চর্চার এক প্রাচীন ও জীবন্ত ধারক। যুগ যুগ ধরে এসব প্রতিষ্ঠান ধর্মীয় ও সামাজিক জীবনে গভীর প্রভাব রেখে আসছে। কুরআন, হাদিস ও ইসলামি আইনশাস্ত্রে জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র হিসাবে এগুলো গড়ে তুলেছে অসংখ্য আলেম ও গবেষক। চলুন, পরিচিত হওয়া যাক এসব ঐতিহ্যবাহী কওমি মাদ্রাসার সঙ্গে।
আল-জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম
১৯০১ সালে চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে প্রতিষ্ঠিত উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন ও বৃহৎ ইসলামি বিদ্যাপীঠ; যা আব্দুল ওয়াহেদ বাঙালি, হাবিবুল্লাহ কুরাইশি, সুফি আজিজুর রহমান ও আব্দুল হামিদের উদ্যোগে দারুল উলুম দেওবন্দের অনুকরণে যাত্রা শুরু করে। ‘দ্বিতীয় দারুল উলুম দেওবন্দ’ ও ‘উম্মুল মাদারিস’ নামে খ্যাত এ প্রতিষ্ঠানেই দেশে প্রথম দাওরায়ে হাদিস চালু হয়। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি শিশুশ্রেণি থেকে শুরু করে তাফসির, হাদিস, ফিকহ (ইসলামি আইন ও গবেষণা) এবং আরবি সাহিত্যসহ উচ্চতর গবেষণা বিভাগ পর্যন্ত শিক্ষাদান করে। মাদ্রাসাটি দেশের প্রধান কওমি শিক্ষাবোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের অন্যতম কেন্দ্রীয় শক্তি হিসাবেও কাজ করে। তা ছাড়া জ্ঞান ও আদর্শের এ কেন্দ্রটি তার প্রকাশনা বিভাগ থেকে নিয়মিতভাবে ‘মাসিক মুঈনুল ইসলাম’ পত্রিকা প্রকাশ করে, যার মাধ্যমে ধর্মীয় জ্ঞান সমাজের সর্বস্তরে পৌঁছে দেওয়া হয়।
জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম মাদানিয়া
ঢাকার দক্ষিণে যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তাসংলগ্ন এলাকায় অবস্থিত জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম মাদানিয়া দেশের অন্যতম প্রাচীন ও স্বনামধন্য কওমি মাদ্রাসা। সমাজসংস্কারক রহম আলী সাহেব ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে অশিক্ষা দূরীকরণের লক্ষ্যে নিজ জমি ওয়াকফ করে নুরানি মক্তব ও হিফজ বিভাগ দিয়ে এর যাত্রা শুরু করেন। দারুল উলুম দেওবন্দের পাঠক্রম ও আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আদর্শে পরিচালিত এ প্রতিষ্ঠান বর্তমানে শিশু শ্রেণি থেকে দাওরায়ে হাদিস পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা প্রদান করে। তা ছাড়া গবেষণামূলক উচ্চতর ডিগ্রির জন্যও রয়েছে একাধিক অনুষদ, যেখানে মেধাবী আলেমরা ইসলামি জ্ঞানচর্চা ও গবেষণার মাধ্যমে জাতিকে যোগ্য ও বিচক্ষণ নেতৃত্ব দিতে প্রস্তুত হন। কুরআন, হাদিস, ফিকহ, তাফসিরের পাশাপাশি বাংলা, ইংরেজি, গণিত, ইতিহাস, ভূগোল, অর্থনীতি ও বিজ্ঞানের মতো বিষয়ও পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত।
জামিয়া কুরআনিয়া আরাবিয়া
জামিয়া কুরআনিয়া আরাবিয়া, লালবাগ ঢাকার অন্যতম প্রাচীন ও মর্যাদাপূর্ণ কওমি মাদ্রাসা। ১৯৫০ সালে হাফেজি হুজুর, মুফতি দীন মুহাম্মদ খান, জাফর আহমদ উসমানী ও মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরীর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত এ প্রতিষ্ঠান প্রথমে কুরআন হিফজের ক্লাস দিয়ে যাত্রা শুরু করে। বর্তমানে এখানে কিন্ডারগার্টেন থেকে দাওরায়ে হাদিস পর্যন্ত শিক্ষা প্রদান করা হয়। জামিয়ায় স্নাতকোত্তর পর্যন্ত সাতটি বিভাগ চালু রয়েছে, যেখানে কুরআন, হাদিস, ফিকহ, তাফসির ও আরবি ভাষাসহ ইসলামি জ্ঞানের সব শাখায় শিক্ষা প্রদান করা হয়। মাদ্রাসার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এর সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার, যেখানে প্রায় ২২০০ বই সংরক্ষিত আছে। পাশাপাশি ‘ফতোয়া-ই-জামিয়া’ বিভাগ সমাজের বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক বিষয়ে ইসলামি রায় প্রদান করে, যার ১২ খণ্ড ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। যা ইসলামি আইনচর্চায় এক মূল্যবান সংযোজন। মাদ্রাসাটি বর্তমানে প্রায় ৭০০ কওমি প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধান ও পরামর্শদানে নিয়োজিত থেকে জাতীয় পর্যায়ে ইসলামি শিক্ষার মান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া
জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া, বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার মোহাম্মদপুরে অবস্থিত একটি সুপরিচিত কওমি মাদ্রাসা। ১৯৮৬ সালে জামিয়া মুহাম্মাদিয়া নামে অস্থায়ীভাবে এর কার্যক্রম শুরু হয় এবং ১৯৮৮ সালে স্থায়ী ক্যাম্পাসে স্থানান্তরের পর জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া নামে পূর্ণাঙ্গ কার্যক্রম শুরু করে। দারুল উলুম দেওবন্দের শিক্ষা দর্শনে পরিচালিত এ মাদ্রাসা বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের অধিভুক্ত এবং প্রাথমিক স্তর থেকে দাওরায়ে হাদিস পর্যন্ত শ্রেণিভিত্তিক পাঠদান চলে, পাশাপাশি গবেষণামূলক কার্যক্রমও পরিচালিত হয়। এই মাদ্রাসা থেকে প্রকাশিত ‘মাসিক রাহমানি পয়গাম’ একটি জনপ্রিয় ইসলামি পত্রিকা, যা ১৯৯৮ সালে শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হকের উদ্যোগে প্রকাশ শুরু হয়। ইসলামি জ্ঞান, সাহিত্য ও সমাজ সংস্কারে অবদানের জন্য মাদ্রাসাটি কওমি শিক্ষার এক গুরুত্বপূর্ণ ও আলোচিত প্রতিষ্ঠান হিসাবে পরিচিত।
