Logo
Logo
×

ক্যাম্পাস তারুণ্য

শিক্ষা ও সংস্কৃতির বাতিঘর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

Icon

রাশেদুল ইসলাম

প্রকাশ: ১৯ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

শিক্ষা ও সংস্কৃতির বাতিঘর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের একাংশ। ছবি: সংগৃহীত

শালবনের নীরবতা, দিগন্তজোড়া সবুজ আর হ্রদের জলে ভাসমান নীল আকাশ-সব মিলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় যেন প্রকৃতি আর সংস্কৃতির এক অনন্য মিলনমঞ্চ। স্বাধীনতার ঠিক আগে প্রতিষ্ঠিত এ প্রতিষ্ঠানটি শুধু উচ্চশিক্ষার কেন্দ্রই নয়, বরং সময়ের ধারায় গড়ে ওঠা এক সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যেরও বাহক। ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি থেকে শুরু করে নাটক, গান, সাহিত্য, গণজাগরণ-সবকিছুরই প্রাণস্পন্দন পাওয়া যায় এ ক্যাম্পাসে। ঋতুবৈচিত্র্য, জীববৈচিত্র্য আর ছাত্রজীবনের উচ্ছ্বাস মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টি হয়ে উঠেছে এক বিশেষ আবহের নাম। ইতিহাস, প্রকৃতি ও সংস্কৃতির গৌরবময় এ প্রাঙ্গণ আজও তার সৌন্দর্য ও চেতনাকে নতুন প্রজন্মের হাতে তুলে দিচ্ছে নীরবে, অবিচলভাবে। জানাচ্ছেন দৈনিক যুগান্তরের প্রতিনিধি রাশেদুল ইসলাম। ছবি তুলেছেন অরিত্র সাত্তার

রাজধানী ঢাকা থেকে ৩২ কিলোমিটার দূরে সাভারে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পশ্চিম পাশ ঘেঁষেই ৬৯৭ দশমিক ৫৬ একর জায়গাজুড়ে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান। ঢাকা শহরের মুঘল আমলের নাম ‘জাহাঙ্গীরনগর’ থেকেই ১৯৭০ সালে ‘জাহাঙ্গীরনগর মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। কিন্তু ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশে মুসলিম শব্দটি কেটে নাম রাখা হয় ‘জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়’। ১৯৭১ সালের ৪ জানুয়ারি স্নাতক পর্যায়ে প্রথম ক্লাস শুরু হলেও ১২ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর রিয়ার এডমিরাল এস.এম আহসান।

পরিবেশ ও অবকাঠামো

প্রথম ব্যাচে ১৫০ জন শিক্ষার্থী ও ২১ জন শিক্ষক নিয়ে পরিসংখ্যান, ভূগোল, অর্থনীতি ও গণিত বিভাগ পাঠদান কার্যক্রম শুরু করে। ওই সময় ১৪ জন কর্মকর্তা ও ১২৫ জন কর্মচারী কাজ করতেন। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়টির শ্যামল পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর। বিশ্ববিদ্যালয়ের অসংখ্য জলাশয় একে পরিযায়ী পাখির অভয়ারণ্য হিসাবে পরিণত করেছে। এখন পর্যন্ত এটিই বাংলাদেশের একমাত্র আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে ৬টি অনুষদের অধীনে ৩৪টি বিভাগ চালু আছে। এ ছাড়া ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন টেকনোলজি (আইআইটি), ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ-জেইউ), তুলনামূলক সাহিত্য ও সংস্কৃতি ইনস্টিটিউট, ইনস্টিটিউট অব রিমোট সেন্সিং ও ভাষা শিক্ষা কেন্দ্র রয়েছে। ২১টি আবাসিক হল রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে প্রথমে মাত্র ৪টি বিভাগ নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও সময়ের পরিবর্তনে এখন ৬টি অনুষদের অধীনে ৩৪টি বিভাগ ও ৪টি ইনস্টিটিউটে সাতশ শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে প্রায় সাড়ে ১৪ হাজার শিক্ষার্থীর বসবাস।

গুণিজন সম্মিলন

দীর্ঘ পথপরিক্রমায় এ বিশ্ববিদ্যালয় অসংখ্য জ্ঞানী মানুষের সংস্পর্শ পেয়েছে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অধ্যাপক সুনীল কুমার মুখোপাধ্যায়, লেখক হায়াত মামুদ, লেখক হুমায়ুন আজাদ, নাট্যকার সেলিম আল দীন, কবি মোহাম্মদ রফিক অন্যতম। শিক্ষা ও গবেষণার পাশাপাশি, শিল্প-সাহিত্য, নাটক, সংগীত ও খেলাধুলায় এ বিশ্ববিদ্যালয়কে যারা সম্মান এনে দিয়েছেন, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক মুশফিকুর রহিম ও মাশরাফি বিন মর্তুজা, নাট্যজন হুমায়ুন ফরীদি, শহীদুজ্জামান সেলিম, ফারুক আহমেদ, শুভাশিস ভৌমিক ও সজল, নৃত্যশিল্পী শিবলী মোহাম্মদ, অভিনেত্রী সুমাইয়া শিমু, জাকিয়া বারী মম, মিম মানতাসা ও আফসানা আরা বিন্দু প্রমুখ।

সংস্কৃতির স্বর্গভূমি

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে দেশের সাংস্কৃতিক রাজধানী বলা হয়। ‘মুক্তমঞ্চ’ বাংলাদেশ তো বটেই, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে প্রথম, যা উপাচার্য অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর সময়ে নির্মাণ করা হয়। ১৯৮০ সালে সেলিম আল দীন রচিত ‘শকুন্তলা’ নাটক মঞ্চায়নের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক রাজধানীর তীর্থস্থানখ্যাত এ মুক্তমঞ্চের যাত্রা শুরু হয়। খ্যাতনামা জ্ঞানসাধক ‘আল-বেরুনী’, বিশিষ্ট কথাশিল্পী মীর মশাররফ হোসেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত উপাচার্য আ. ফ. ম. কামালউদ্দিন, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, বাঙালি মুসলিম নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া শাখাওয়াত হোসেন, প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, মুক্তিযুদ্ধের বীরাঙ্গনা ও বীর প্রতীক তারামন বিবি, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের নেত্রী প্রীতিলতা, ভাষা শহীদ সালাম-বরকত ও রফিক-জব্বার, শহীদ জননীখ্যাত জাহানারা ইমাম, বেগম খালেদা জিয়া এবং নারী জাগরণের অন্যতম পথিকৃৎ কবি সুফিয়া কামালের নামে হলের নামকরণের মধ্য দিয়ে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাতন্ত্র্য ও বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে।

মহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশনার আলোকে দেশের মধ্যে প্রথম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েই ‘যৌন নিপীড়নবিরোধী অভিযোগ সেল’ গঠিত হয়। এ ছাড়া বাংলাদেশে পুতুল নাচের ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে গবেষণার জন্য পুতুল নাট্য গবেষণা কেন্দ্র জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম খোলা হয়। এখানে রয়েছে কয়েকটি স্বচ্ছ পানির লেক। শীতের মৌসুমে প্রচুর অতিথি পাখি আসে এখানে। অতিথি পাখিদের শুভেচ্ছা জানাতে লেকগুলোয় ফুটে ওঠে হাজারও লাল শাপলা। তারই মধ্যে পাখিদের ওড়াউড়ি আর জলকেলির দৃশ্য মুগ্ধ করে দেশি-বিদেশি দর্শনার্থীদের।

সংগ্রামের সোনালি অধ্যায়

বাঙালি জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্যকে লালন করে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্মাণ করা হয়েছে দেশের সর্বোচ্চ শহীদ মিনার। ভাষা শহীদদের স্মরণে নির্মিত হয়েছে ‘অমর একুশে’ ভাস্কর্য। স্বাধীনতা যুদ্ধে শত্রুর আঘাতে হাত-পা হারানো দেশের বীর সন্তানদের শ্রদ্ধায় নির্মাণ করা হয়েছে স্মারক ভাস্কর্য ‘সংশপ্তক’। বিভিন্ন জাতীয় ও অভ্যন্তরীণ আন্দোলনে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখে আসছে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে তারা স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ, এরশাদ সরকারের আমলে শিক্ষা আন্দোলন ও ১৯৯০ সালের স্বৈরাচারবিরোধী গণআন্দোলনেও অংশগ্রহণ করেছে। ১৯৯৮ সালে ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতা মানিক ও তার সঙ্গীরা শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে বিতাড়িত হয়। আবার প্রত্যাবর্তন করলে ১৯৯৯ সালে শিক্ষার্থীদের এক অভ্যুত্থানে ওই অভিযুক্তরা অবারও বিতাড়িত হয়। এ আন্দোলন দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম যৌন নিপীড়নবিরোধী আন্দোলন বলে পরিচিত।

সবশেষ জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানকালে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা, দমন-পীড়নের ঘটনার প্রতিবাদে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সমাজ ক্ষোভে ফেটে পড়ে। এরই ধারাবাহিকতায় ক্যাম্পাসজুড়ে গড়ে ওঠে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ ও সাংস্কৃতিক প্রতিবাদ-যা দ্রুত দেশব্যাপী আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল। ১৫ জুলাই দিবাগত রাতেই দেশের প্রথম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসাবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে সম্পূর্ণভাবে ছাত্রলীগমুক্ত করেছিল শিক্ষার্থীরা। ১৬ জুলাই সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকগুলোয় শিক্ষার্থীরা ‘ছাত্রলীগ প্রবেশ নিষেধ’ পোস্টার টাঙিয়ে ক্যাম্পাসের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নেয়। পরে একে একে দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও ছড়িয়ে পড়ে ছাত্রলীগমুক্ত করার আন্দোলন। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক গোলাম রাব্বানী আবৃত্তি করেছিলেন নবারুণ ভট্টাচার্যের বিখ্যাত কবিতা-‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না/ এই জল্লাদের উল্লাস মঞ্চ আমার দেশ না।’ সেসময় মুহূর্তেই ভিডিওটি ভাইরাল হয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আন্দোলনকারীদের নতুন উদ্দীপনা জোগায়। অন্যদিকে বাংলা বিভাগের অধ্যাপক শামীমা সুলতানা ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতন ও নারী শিক্ষক আহত হওয়ার প্রতিবাদে তার কক্ষ থেকে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার ছবি সরিয়ে ফেলেন। তার এ পদক্ষেপ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয় এবং শিক্ষকদের প্রতিবাদের এক উজ্জ্বল উদাহরণ হয়ে ওঠে।

দেশের সর্বোচ্চ শহীদ মিনার

সবুজের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে লাল ইটের এক সুউচ্চ স্তম্ভ। দূর থেকে দেখলে মনে হয় যেন আকাশ ছুঁতে চাইছে। এটি কেবল কোনো স্থাপত্য নয়, বরং বাংলাদেশের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের এক মূর্ত প্রতীক। উচ্চতার দিক দিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) এ শহীদ মিনার বাংলাদেশের সর্বোচ্চ। কলা ও মানবিক অনুষদের সামনে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ও ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের স্মারক হিসাবে দাঁড়িয়ে আছে এ মিনার। মহান স্বাধীনতার প্রতি সম্মান জানিয়ে মিনারটির উচ্চতা নির্ধারণ করা হয়েছে ৭১ ফুট। অন্যদিকে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের স্মরণে এর ভিত্তিমঞ্চের ব্যাস রাখা হয়েছে ৫২ ফুট। শহীদ মিনারের বেদিতে উঠতে যে ৮টি সিঁড়ি ব্যবহার করা হয়েছে, তা ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বাঙালির জাতীয় জীবনের ৮টি উল্লেখযোগ্য আন্দোলন ও মাইলফলকের প্রতীক।

দীর্ঘস্থায়ী বন্ধন

এখানকার শিক্ষার্থীদের মাঝে যে বন্ধন, তা এককথায় অতুলনীয় এবং এ বন্ধন শিক্ষাজীবন শেষে কর্মক্ষেত্রেও পরিলক্ষিত হয়। মূলত ক্যাম্পাসকেন্দ্রিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ড, আবাসিক ক্যাম্পাসনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা, প্রান্তিক, চৌরঙ্গী, ডেইরি গেট, মুক্তমঞ্চ, টিএসসি, ক্যাফেটেরিয়া, কেন্দ্রীয় খেলার মাঠ, লাইব্রেরি, অডিটোরিয়াম এবং বিশ্ববিদ্যালয় পরিবহনকেন্দ্রিক ‘ক্যাম্পাস-ঢাকা-ক্যাম্পাস’ যাতায়াতব্যবস্থা এর অন্যতম কারণ বলে অনেকের ধারণা। এখানকার শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাস জীবন বেশ প্রকৃতিনির্ভর। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন প্রজাতির পাখির কলকাকলি, প্রজাপতি, গুইসাপ, বিড়াল, কুকুর, শিয়াল, কাঠবিড়ালির উপস্থিতি ক্যাম্পাসকে একটি গ্রামীণ শহুরের মিশ্র অবস্থায় দাঁড় করিয়েছে, যা সত্যিই অতুলনীয়। লাল সিরামিক ইটের তৈরি বিল্ডিং ও রাস্তা, প্রচুর গাছগাছালি ও লেক, উঁচু-নিচু রাস্তা ও লাল মাটি, সর্বোপরি এখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশ সহজেই সবার নজর কাড়ে।

সময়ের চাহিদা

এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সফলতার পাশাপাশি রয়েছে কিছু সীমাবদ্ধতা। সময়োপযোগী অনেক বিভাগ এখনো চালু হয়নি। অটোমেশন প্রক্রিয়াও কার্যকর হয়নি, যার ফলে পরীক্ষার ফরম পূরণ করতে এখনো আগের পদ্ধতিতেই শিক্ষার্থীদের পাঁচ জায়গায় দৌড়াতে হয়। তা ছাড়া প্রায়ই দেখা যায়, রাজনৈতিক দলাদলি আর হানাহানি। তবে আশার কথা হলো, গণরুম বিলুপ্ত হয়েছে। নবীন শিক্ষার্থীরা প্রথমবর্ষ থেকেই নিজেদের সিটে থাকতে পারছে। সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও একটি আদর্শ বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় দেশ-বিদেশে তার দৃষ্টান্ত রেখে আসছে। জ্ঞানের শিখা ছড়িয়ে দিচ্ছে বিশ্বজুড়ে।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের প্রথম স্মৃতিস্তম্ভ

২০২৪ সালের জুলাই মাস। সারা দেশ তখন উত্তাল। কোটা সংস্কারের দাবি ক্রমশ রূপ নিচ্ছে স্বৈরাচার পতনের এক দফার আন্দোলনে। ঠিক সেই বারুদসম সময়ে, কারফিউ আর বুলেট উপেক্ষা করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) শিক্ষার্থীরা গড়ে তুলেছিল এক অনন্য প্রতিরোধ। সেই রক্তস্নাত ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে ক্যাম্পাসের জাকসু লেনে, পুরোনো ফজিলাতুন্নেছা হলের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের প্রথম স্মৃতিস্তম্ভ ‘অদম্য ২৪’। ইতিহাসের পাতায় দিনটি ছিল ২০ জুলাই, ২০২৪। সাভারের আকাশে তখন কারফিউর থমথমে পরিবেশ। এর মাঝেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে জাবির শিক্ষার্থীরা ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করে। ঠিক তার এক ঘণ্টা পর, ক্যাম্পাসে ফিরে শিক্ষার্থীরা জুলাই গণহত্যায় নিহতদের স্মরণে তৎক্ষণাৎ একটি প্রতীকী স্তম্ভ নির্মাণ করেন। তখন এর নাম দেওয়া হয়েছিল ‘শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ’। সেই কাঁচা গাঁথুনিই আজ রূপ নিয়েছে স্থায়ী স্থাপত্যে।

স্মৃতিস্তম্ভটির স্থাপত্যশৈলীতে লুকিয়ে আছে গভীর তাৎপর্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থী মো. রাঈদ হোসেনের নকশায় এতে ঠাঁই পেয়েছে তিনটি অগ্নিশিখা। এ আগুন ধ্বংসের নয়, বরং প্রতিবাদের। নকশার সবচেয়ে বড় বিশেষত্ব হলো এর জ্যামিতিক বিন্যাস। তিনটি শিখার মধ্যে দুই প্রান্তের শিখাগুলো ২৪ ডিগ্রি কোণে বাঁকানো, যা ২০২৪ সালের ঐতিহাসিক ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকে নির্দেশ করে। তিনটি শিখা সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ২০২৫ সালের ৩১ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে এর উদ্বোধন করেন গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান। জাবি শিক্ষার্থীদের অকুতোভয় সাহস আর জুলাইয়ের সেই দিনগুলোর এক জীবন্ত দলিল এ স্মৃতিস্তম্ভ। আগামী প্রজন্মের কাছে এটি সাক্ষ্য দেবে কীভাবে চব্বিশের জুলাইয়ে ছাত্র-জনতা তাদের বুকের রক্তে লিখেছিল নতুন বাংলাদেশের ইতিহাস।

স্থাপত্যশৈলীর অনন্য নিদর্শন

সবুজের বুকে ডানা মেলে আছে লাল ইটের এক বিশাল প্রজাপতি। এটি কোনো কাল্পনিক দৃশ্য নয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) স্থাপত্যশৈলীর অন্যতম বিস্ময় ‘মীর মশাররফ হোসেন হল’। প্রখ্যাত স্থপতি মাজহারুল ইসলামের নিপুণ নকশায় ১৯৭৩ সালে নির্মিত এ হলটি ক্যাম্পাসের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সঙ্গে মিশে আছে একাকার হয়ে। ওপর থেকে দেখলে মনে হয়, বিশাল এক প্রজাপতি সবুজের গালিচায় বিশ্রাম নিচ্ছে। তাই তো শিক্ষার্থীদের কাছে এর দাপ্তরিক নামের চেয়ে ‘প্রজাপতি হল’ নামেই এটি অধিক পরিচিত। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পাশেই অবস্থিত চার তলাবিশিষ্ট এ ভবনটি দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৃহত্তম আবাসিক হল হিসাবে খ্যাত। শুরুতে ২নং হল হিসাবে পরিচিত থাকলেও ১৯৭৮ সালে ‘বিষাদ সিন্ধু’র রচয়িতা মীর মশাররফ হোসেনের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা রেখে এর নামকরণ করা হয়। হলের নকশা এমনভাবে করা হয়েছে যে, কোনো কংক্রিটের কলাম ছাড়াই শুধু ইটের গাঁথুনিতে এটি দাঁড়িয়ে আছে অর্ধশতাব্দী ধরে। এর স্থাপত্যশৈলীর অন্যতম বিশেষত্ব হলো, হলের দ্বৈত কক্ষগুলো ৪৫ ডিগ্রি কোণে বিন্যস্ত। ফলে প্রতিটি কক্ষে আলো-বাতাস চলাচলের অবারিত সুযোগ রয়েছে, যা শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি কমায়। দুটি ব্লকে বিভক্ত এ হলে ৪৯০টি কক্ষ ও ৭১৬ জন ছাত্রের আবাসন ব্যবস্থা রয়েছে। এর মধ্যে এক শয্যাবিশিষ্ট ২৬৪ এবং এক দুই শয্যাবিশিষ্ট ২২৬টি কক্ষ। লাল ইটের দালান আর সবুজের মিতালীতে এখানে প্রকৃতি পেয়েছে ভিন্ন রূপ। হলের নান্দনিকতা, বিশালতা আর জ্যামিতিক নকশা দেখতে প্রতিদিনই ভিড় জমান পর্যটকরা; ক্যামেরাবন্দি করতে চান এই ‘দানব’ আকৃতির সৌন্দর্য। শুধু আবাসন নয়, মীর মশাররফ হোসেন হল জাবির হাজারো শিক্ষার্থীর আবেগ, স্মৃতি আর গৌরবের প্রতীক। স্থাপত্যকলা আর প্রকৃতির এমন মেলবন্ধন সত্যিই বিরল।

বিজ্ঞান ও গবেষণা

অনেক শিক্ষক-শিক্ষার্থী দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সম্মাননা, পদক, ফেলোশিপ, অ্যাওয়ার্ড, সেরা গবেষক-বিজ্ঞানী হিসাবে স্বীকৃতি পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে আলোকিত ও সম্মানিত করেছেন। মৌলিক বিজ্ঞানের বিষয়গুলোতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় অত্যন্ত সমৃদ্ধ। দেশের প্রথম প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ স্থাপিত হয় এ বিশ্ববিদ্যালয়ে। এ বিভাগের অধীনে উয়ারী বটেশ্বরে খননকার্য চালানো হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সব বিভাগেই গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হয়। স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের গবেষণালব্ধ থিসিস জমা দিতে হয়। এ ছাড়া শিক্ষার্থীরা এখান থেকে এমফিল ও পিএইচডি গবেষণা করতে পারে। বিজ্ঞান গবেষণার জন্য এ বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে দেশের সর্ববৃহৎ ‘ওয়াজেদ মিয়া বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র’।

ফিরছে পরিযায়ী পাখির কলরব

কুয়াশাচ্ছন্ন ভোর আর রক্তকমল শাপলার বিলে অতিথি পাখির খুনশুটি শীতকালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) চিরচেনা রূপ এটিই। প্রতি বছর সুদূর সাইবেরিয়া আর হিমালয়ের তীব্র শীত থেকে বাঁচতে হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে এ ক্যাম্পাসে আশ্রয় নেয় সরালি, পচার্ড, গার্গেনি, মানিকজোড়সহ নানা প্রজাতির পরিযায়ী পাখি। তবে প্রকৃতির এ অনন্য আয়োজনে এবার ভাটা পড়েছে পরিযায়ীর। কলকাকলিতে মুখর থাকার কথা যে লেকগুলো, সেখানে এবার পাখির সংখ্যা উদ্বেগজনকভাবে কম। মৃতপ্রায় ও অপরিচ্ছন্ন লেক, অপরিকল্পিত উন্নয়ন, যানবাহনের উচ্চ শব্দ এবং ছুটির দিনে দর্শনার্থীদের অসহনীয় কোলাহলই এ সংকটের মূল কারণ। তবে এ নৈরাজ্যের মাঝেও আশার আলো দেখাচ্ছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ (জাকসু)। পাখির অভয়ারণ্য ফিরিয়ে আনতে সম্প্রতি ‘মনপুরা’ লেকে নেওয়া হয়েছে বিশেষ সংস্কার উদ্যোগ। জাকসুর তদারকিতে ভেকু মেশিন দিয়ে লেকের তলদেশ পরিষ্কার, আগাছা দমন এবং পাখিদের বিশ্রামের জন্য বাঁশের মাচা স্থাপনের কাজ চলছে। একইসঙ্গে লেক পাড়ে উচ্চস্বরে গান-বাজনা ও চড়ুইভাতি নিষিদ্ধ করে ব্যানার টানানো হয়েছে।

শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা, মনপুরা লেকের এ সংস্কার এবং দর্শনার্থীদের সচেতনতা বাড়লে জাবি ক্যাম্পাস আবারও তার হারানো ঐতিহ্য ফিরে পাবে। লাল ইটের ক্যাম্পাসের জলাশয়গুলো আবারও মুখর হয়ে উঠবে হাজারো পাখির ডানা ঝাপটানোর শব্দে।

সাফল্যের পথে

স্বপ্নরাজ্যে পা রেখেছিলাম প্রবল সাহসে: নাবিল মোস্তফা

ক্লাস নাইন। সদ্য সায়েন্স-কমার্স-আর্টস সম্পর্কে জানতে শুরু করা এক কিশোর; তখনই কোমর বেঁধে নেমে পড়ি নিজেকে নির্মাতা হিসাবে তৈরি করতে। কী এক নেশায় সিনেমেটগ্রাফি-এডিটসহ যখন যে কাজের সুযোগ পাই করতে থাকি। নিজের জমানো ও বড় দুই বোনের কাছ থেকে টাকা নিয়ে এসএসসি পরীক্ষার আগে তৈরি করি ৩টি শর্টফিল্ম। ২০২১ সালের চিলড্রেন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে অফিসিয়াল সিলেকশন পেয়ে জাতীয় জাদুঘরে প্রদর্শিত হয় আমার এক নির্মাণ, প্রথমবারের মতো নামের আগে ‘নির্মাতা’ শব্দ দেখি! মনে হয় বাঁওড়ের এক মাঝি হয়ে যেন নদীর ঠিকানা পেয়েছি!

শুরু হয় নির্মাতা হিসাবে যাত্রা। একদিকে কমার্শিয়ালি প্রোজেক্ট নামানো চলতে থাকে-শর্টফিল্ম, মিউজিক ভিডিও, ডকুমেন্টারি, সরকারি প্রোজেক্ট; অন্যদিকে সেই ৩টি শর্টফিল্ম আন্তর্জাতিকভাবে পেতে থাকে স্বীকৃতি। ১৮টি দেশের ২৩টি চলচ্চিত্র উৎসবে অফিসিয়াল সিলেকশন, স্পেনের দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং ভারতের জুরি অ্যাওয়ার্ড পাওয়ার পর নিউইয়র্কের এক প্রতিযোগিতায় অনারেবল মেনশন পাই এবং পরের বছর সেখানেই স্টুডেন্ট জাজ হিসাবে কাজ করি কলেজছাত্র থাকাবস্থায়। ২০২২ সালে চলচ্চিত্রের এ অর্জনই আমাকে জায়গা করে দেয় নেপালের ‘গ্লোবাল টিন হিরো’তে বাংলাদেশের ৬ জনের মধ্যে।

কমার্স নিয়ে এইচএসসির প্রস্তুতির পাশাপাশি চলতে থাকে নির্মাণও। টেস্ট পরীক্ষার মাঝেই এফডিসির এক পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে চিত্রগ্রাহক হিসাবে কাজ করি, যদিও সে চলচ্চিত্র আজও মুক্তির পথ দেখেনি! বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ইচ্ছা ছিল না আমার। ইচ্ছা ছিল আন্তর্জাতিক ফিল্ম কোর্স অথবা নিজে টাকা জমিয়ে ভারতের কোনো ফিল্ম ইনস্টিটিউটে পড়াশোনা করার। বর্তমানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের ছাত্র। জাবির জুলাই আন্দোলনের ওপর প্রথম ফিকশন নির্মাণ করেছি, যা এ বছরের ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে জায়গা করে নিয়েছে। প্রথমবর্ষের ছাত্র থাকাকালীনই ‘থারমোলক জেইউ’ নামে জাবিতে নতুন এক চলচ্চিত্র সংগঠনের আহ্বায়ক হিসাবে কাজ করছি। একদা যে স্বপ্নরাজ্যে পা রেখেছিলাম প্রবল সাহসে, সেখানে এখনো অনেক কিছুই নির্মাণাধীন, নিজের জন্য।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম