ইউরোপে উচ্চশিক্ষা ও ক্যারিয়ার সম্ভাবনা
শরিফুল ইসলাম
প্রকাশ: ২৬ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
শ্রেণিকক্ষে লেকচার শুনছেন সিইউবি’র শিক্ষার্থীরা -ছবি : সংগৃহীত
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
উচ্চশিক্ষা ও ক্যারিয়ার সম্ভাবনার ক্ষেত্রে ইউরোপ আজ বিশ্বের অন্যতম আকর্ষণীয় গন্তব্য। সমৃদ্ধ গবেষণাধর্মী শিক্ষা, আধুনিক প্রযুক্তি, বহুসাংস্কৃতিক শিক্ষার পরিবেশ এবং স্কলারশিপের বিস্তৃত সুযোগ এ মহাদেশকে তরুণদের জন্য স্বপ্নময় করে তুলেছে। অক্সফোর্ড, ক্যামব্রিজ, ইউরোপীয়ান রিসার্চ সেন্টারসহ শতাধিক বিশ্বমানের প্রতিষ্ঠানে পড়ার সুযোগ খুলে দেয় আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার ও প্রফেশনাল নেটওয়ার্কের নতুন দরজা। উচ্চমানের ডিগ্রি, দক্ষতা ও চাকরির সুযোগ সব মিলিয়ে ইউরোপ আজ ভবিষ্যৎ গড়ার এক উজ্জ্বল সম্ভাবনার কেন্দ্র। এ নিয়ে বিস্তারিত জানাচ্ছেন শরিফুল ইসলাম
বৃত্তি নিয়ে বিদেশে উচ্চশিক্ষার প্রক্রিয়া বেশ দীর্ঘ। তাড়াহুড়া করলে সুযোগ পাওয়ার সম্ভাবনা কমে যাবে। একদিকে যেমন পড়াশোনার প্রস্তুতির প্রয়োজন, অন্যদিকে কাগজপত্র ও প্রক্রিয়াসংশ্লিষ্ট নানা বিষয়ও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। শুরুতে একটি বছরভিত্তিক পরিকল্পনা নেওয়া ভালো। তারপর ভাষাসংশ্লিষ্ট দক্ষতার ক্ষেত্রে দরকার আইইএলটিএস, যা প্রতিযোগিতামূলক ও সম্মানজনক বৃত্তিগুলোর জন্য দরকার। এক্ষেত্রে তারা ৭.০ বা ৭.৫ আইইএলটিএস স্কোর গ্রহণ করে থাকেন। অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক বৃত্তিগুলোতে ৬.৫ স্কোরও গ্রহণ করা হয়। আবার অনেক ক্ষেত্রে এসবের কিছুই লাগে না। প্রস্তুতির অংশ হিসাবে শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ, নম্বরপত্র ইত্যাদি জোগাড় করে ফেলতে হবে। হালনাগাদ পাসপোর্টও হাতে রাখুন।
বৃত্তির খোঁজখবর ও আবেদন
দেশ ও বিশ্ববিদ্যালয়ভেদে আবেদন প্রক্রিয়া ভিন্ন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য বেশ কার্যকর। হালনাগাদ সরকারি বৃত্তির তথ্য পাওয়া যায় সব সময়। বিভিন্ন দূতাবাসের শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিভাগের ওয়েবসাইট ও ফেসবুক পেজেও বৃত্তির তথ্য প্রকাশ করা হয়। এ ছাড়া চোখ রাখতে পারেন পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট থেকে নিয়মিত তথ্য পাওয়ার সুযোগ আছে।
টিউশন ফি ও স্কলারশিপ
ইউরোপে উচ্চশিক্ষার খরচ ও স্কলারশিপ সুযোগ দেশ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ভেদে ভিন্ন হতে পারে। পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোতে, যেমন-জার্মানি, অস্ট্রিয়া এবং ইতালির মতো দেশগুলোর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের জন্য টিউশন ফি প্রায় নেই বললেই চলে; শুধু নামমাত্র ‘সেমিস্টার কন্ট্রিবিউশন’ দিতে হয়। অন্যদিকে, যুক্তরাজ্য, নেদারল্যান্ডস, আয়ারল্যান্ড ও স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোতে শিক্ষার্থীদের জন্য খরচ তুলনামূলক বেশি। তবে শিক্ষার্থীদের জন্য আশার খবর হলো, প্রায় প্রতিটি দেশে মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য আংশিক বা সম্পূর্ণ বৃত্তির সুযোগ রয়েছে। শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তি কাঠামোটি মূলত দুটি প্রধান উৎসে ভাগ করা যায় : সরকারি অনুদান এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব স্কলারশিপ। ব্রিটেনের চেভেনিং, জার্মানির DAAD, ফ্রান্সের আইফেল এক্সিলেন্স প্রোগ্রাম বা সুইডেনের গ্লোবাল প্রফেশনালস স্কলারশিপের মতো সরকারি বৃত্তিগুলো শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি ছাড়াই মাসিক ভাতা, বিমান ভাড়া, বিমা এবং গবেষণার সুযোগ দেয়। এ ছাড়া ক্যামব্রিজ, অক্সফোর্ড, আমস্টারডাম বা লিডেন, র্যাডবউডের মতো শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও শিক্ষার্থীর একাডেমিক যোগ্যতা, দক্ষতা ও সম্ভাবনার ভিত্তিতে বৃত্তি প্রদান করে। ফলে অর্থনৈতিক বাধা ছাড়াই শিক্ষার্থীরা মানসম্মত উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে পারে।
স্কলারশিপের যোগ্যতা
ইউরোপের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিন্ন ভিন্ন সরকারি বৃত্তির সুযোগ পান শিক্ষার্থী। এসব বৃত্তির ক্ষেত্রে আবেদনের যোগ্যতাও ভিন্ন ভিন্ন। তবে যে বৃত্তির জন্যই আবেদন করুন না কেন, বাংলাদেশে আপনি কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়েছেন, ফলাফল কেমন, এগুলো বিবেচনা করা হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন সহশিক্ষামূলক কার্যক্রমে যুক্ততা, গবেষণায় সংশ্লিষ্টতাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ভেদে ভিন্ন ভিন্ন আইইএলটিএস স্কোরকে ন্যূনতম যোগ্যতা হিসাবে বিবেচনা করা হয়। তবে অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ই আইইএলটিএসে তন্তত ৬.৫ স্কের চায়।
সেমিস্টার
ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়ে বছরে দুইবার শিক্ষার্থী ভর্তি নেওয়া হয়। এর মধ্যে প্রধান হলো অটাম বা ফল সেমিস্টার, যার ক্লাস সেপ্টেম্বর বা অক্টোবরে শুরু হয় এবং এতেই সর্বাধিক বিষয় ও স্কলারশিপের সুযোগ থাকে। দ্বিতীয়টি হলো স্প্রিং বা সামার সেমিস্টার, যা সাধারণত জানুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে শুরু হয়, তবে এ সেশনে সীমিত সংখ্যক বিষয়ে ভর্তির সুযোগ দেওয়া হয়।
কী কী প্রস্তুত থাকতে হবে
* অন্তত ৬ মাসের মেয়াদ থাকা পাসপোর্ট।
* ৬ থেকে ৭.৫ আইইএলটিএস স্কোর।
* অন্তত ৫টি ইউরোপীয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন।
* পুলিশ ক্লিয়ারেন্স।
* ডকুমেন্ট নোটারি করে নিতে হবে।
* টিউশন ফি, বিশ্ববিদ্যালয়ভেদে কমবেশি হয় বাংলাদেশি টাকায় এক সেমিস্টারের খরচ কমপক্ষে তিন লাখ টাকা।
* অফার লেটার।
* স্টাডি পারমিটের আবেদনপত্র।
* এসএসসি ও এইচএসসি বা সমমান পরীক্ষার সনদ।
* স্বাস্থ্য পরীক্ষা সনদ।
কাজের সুবিধা
ইউরোপে আন্ডারগ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থীদের কাজের সুযোগ সীমিত। বেশির ভাগ দেশে প্রথম ৬-১২ মাস পড়াশোনার পর অফ-ক্যাম্পাস ওয়ার্ক পারমিট দিয়ে সীমিত সময়ের কাজ করা যায়। তবে পোস্টগ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থীরা তুলনায় বেশি সুযোগ পান। তারা টিচিং বা রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসাবে কাজ করতে পারেন। অনেক ক্ষেত্রে ইন্টার্নশিপের জন্য অতিরিক্ত কোর্স বা পরীক্ষা দিতে হতে পারে। শিক্ষার্থীরা মাসে গড়ে প্রায় ৬০০-৮০০ ডলার থাকা-খাওয়ার খরচ সামলাতে পারেন, যা রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসাবে কাজ করলে অনেকটা কমানো যায়।
আবাসন ব্যবস্থা
ইউরোপে উচ্চশিক্ষার জন্য যাওয়ার আগে শিক্ষার্থীদের সবচেয়ে বড় যে চ্যালেঞ্জটির মুখোমুখি হতে হয়, তা হলো আবাসন বা থাকার জায়গা খুঁজে পাওয়া। ইউরোপের বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজস্ব ডর্মিটরি বা ছাত্রাবাস থাকে, যা খরচের দিক থেকে বেশ সাশ্রয়ী। তবে চাহিদার তুলনায় সিট সংখ্যা কম হওয়ায় আগে থেকেই আবেদন করতে হয়। ডর্মিটরি না পাওয়া গেলে ‘শেয়ারড অ্যাপার্টমেন্ট’ বা ‘স্টুডিও ফ্ল্যাট’ ভাড়া নিয়ে থাকার সুযোগ রয়েছে। জার্মানি, ফ্রান্স বা ইতালির মতো দেশগুলোতে শিক্ষার্থীরা সাধারণত কয়েকজন মিলে একটি ফ্ল্যাট ভাড়া করে থাকে, এতে খরচ অনেকটাই কমে আসে।
ক্যারিয়ার সম্ভাবনা
ইউরোপে উচ্চশিক্ষা শুধু ডিগ্রি নয়; এটি পেশাগত ভবিষ্যৎ গড়ার এক গুরুত্বপূর্ণ পথ। শিক্ষার্থীরা এখানে আসে মানসম্মত শিক্ষা, আধুনিক গবেষণা সুবিধা এবং পড়াশোনা শেষে চাকরির বাস্তব সম্ভাবনার জন্য। পড়াশোনা শেষে চাকরির সুযোগ দেশভেদে কিছুটা আলাদা হলেও জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, ফ্রান্স, সুইডেন ও ফিনল্যান্ডের মতো দেশে, আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের দীর্ঘমেয়াদি কর্মসংস্থানের সুযোগ আছে। বিশেষ করে STEM বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, ইঞ্জিনিয়ারিং ও গণিতের ক্ষেত্রে দক্ষ জনবলের চাহিদা থাকায় বিদেশি গ্র্যাজুয়েটদের জন্য সুযোগ উজ্জ্বল। তা ছাড়া প্রযুক্তি খাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, সাইবার নিরাপত্তা, সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং ও ডেটা সায়েন্সে বিশেষজ্ঞদের চাহিদা দ্রুত বাড়ছে। স্বাস্থ্যসেবা খাতেও নার্স, ফার্মাসিস্ট, থেরাপিস্ট ও মেডিকেল রিসার্চারের চাহিদা রয়েছে। ব্যবসা, ফাইন্যান্স, ইকোনমিক্স ও লজিস্টিকসের ক্ষেত্রেও আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য ইউরোপের চাকরি বাজার উন্মুক্ত। বিশেষ করে ইংরেজিতে কাজ করা দেশগুলো- নেদারল্যান্ডস, জার্মানি, ডেনমার্ক, আয়ারল্যান্ড চাকরির আরও সুযোগ দেয়। এ ছাড়া পরিবেশবিজ্ঞান, পুনর্নবীকরণযোগ্য জ্বালানি ও সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্টেও কাজের সুযোগ আছে।
সীমানা ছাড়িয়ে স্বপ্নের পথে
আপনি যদি ইউরোপে উচ্চশিক্ষার পরিকল্পনা করে থাকেন, তবে মহাদেশটির উল্লেখযোগ্য দেশগুলো সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকা জরুরি।
যুক্তরাজ্য : ইংরেজিভাষী দেশ হওয়ায় এবং শিক্ষার মান অত্যন্ত উঁচুতে থাকায় আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের পছন্দের শীর্ষে থাকে এই দেশ। অক্সফোর্ড, ক্যামব্রিজসহ বিশ্বের অনেক নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় এখানে অবস্থিত, যার ডিগ্রি বিশ্বজুড়ে অত্যন্ত সম্মানজনক।
জার্মানি : বিশ্বমানের গবেষণা এবং উচ্চশিক্ষার নিশ্চয়তা পেতে জার্মানি হতে পারে আপনার প্রথম পছন্দ। বার্লিন, মিউনিখ, কোলন কিংবা ফ্রাঙ্কফুর্টের মতো শহরগুলোতে রয়েছে বিশ্বের সর্বোচ্চ র্যাংকিংধারী সব বিশ্ববিদ্যালয়।
ফ্রান্স : সত্যিকারের বোহেমিয়ান জীবনযাত্রার অভিজ্ঞতা পেতে ফ্রান্সের বিকল্প নেই। প্যারিস, বোর্দো কিংবা মার্সেই শহরের জনাকীর্ণ পরিবেশ, জাদুঘর এবং ক্যাফে কালচার শিক্ষার্থীদের মুগ্ধ করে। আন্তর্জাতিক র্যাংকিংয়ে ফরাসি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থান বেশ ওপরে। ফরাসি বিজনেস স্কুলগুলো তাদের ব্যতিক্রমী শিক্ষাশৈলীর জন্য প্রশংসিত। আর আপনি যদি ফ্যাশনে আগ্রহী হন, তবে ফ্রান্স আপনার জন্য তীর্থস্থান।
নেদারল্যান্ডস : প্রতিবছর বিপুলসংখ্যক আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীকে স্বাগত জানানোর জন্য এ দেশটি ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। এখানকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো তাদের আধুনিক কারিকুলাম এবং ইংরেজি ভাষায় পাঠদানের জন্য বেশ জনপ্রিয়।
অস্ট্রিয়া : আপনি কি বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ দেশে বসবাস করে পড়াশোনা করতে চান? তবে অস্ট্রিয়া আপনার জন্য সেরা গন্তব্য। জার্মান, ইতালীয় এবং হাঙ্গেরিয়ান সংস্কৃতির এক অনন্য মিশ্রণ দেখা যায় এ দেশটিতে। অস্ট্রিয়াতে টিউশন ফি অত্যন্ত কম, অনেক ক্ষেত্রে নেই বললেই চলে।
স্পেন : বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ, উষ্ণ জলবায়ু এবং সাশ্রয়ী জীবনযাত্রার খরচের জন্য স্পেন শিক্ষার্থীদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়। বিশেষ করে যারা স্প্যানিশ ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি দুর্বল, তাদের জন্য স্পেন এক স্বপ্নের দেশ। এখানকার টিউশন ফিও অন্যান্য ইউরোপীয় দেশের তুলনায় বেশ কম।
ইতালি : পর্যটন এবং পড়াশোনা-এ দুইয়ের সমন্বয় ঘটাতে চাইলে আপনার গন্তব্য হওয়া উচিত ইতালি। দেশটি কলা, স্থাপত্য এবং বিশ্ব ইতিহাসের এক জীবন্ত জাদুঘর। আপনি যদি এসব বিষয়ে আগ্রহী হন, তবে ইতালি আপনাকে দেবে হাতে-কলমে শিক্ষার সুযোগ। রোম, ফ্লোরেন্স বা মিলানের মতো ঐতিহাসিক শহরগুলোতে পড়াশোনা আপনার অভিজ্ঞতার ঝুলি সমৃদ্ধ করবে। এছাড়া পোল্যান্ড, পর্তুগাল ও সুইজারল্যান্ডের মতো ইউরোপীয় দেশগুলোর যে কোনোটিকেই আপনি বেছে নিতে পারেন উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন পূরণের ক্ষেত্র হিসেবে।
সবচেয়ে কম খরচ লিথুয়ানিয়ায়
বিদেশে পড়াশোনার ক্ষেত্রে খরচ একটা গুরুত্বপূর্ণ। একদিকে বিদেশে পড়াশোনার স্বপ্ন, অন্যদিকে খরচের জটিল সমীকরণ। ভাষাগত দক্ষতার দিকটিও বিবেচনায় রাখতে হয় বিদেশগামী শিক্ষার্থীদের। তবে সব জটিলতারই নিরসন করেছে ইউরোপের দেশ লিথুয়ানিয়া। বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য এবার লিথুয়ানিয়া হতে পারে উচ্চশিক্ষার এক নতুন দিগন্ত। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য এ দেশটিতে মিলবে কম খরচে বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সুযোগ। আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা, নিরাপদ ও আধুনিক জীবনযাপনের পরিবেশ, সবকিছুই নিশ্চিত করে দেশটি। সবচেয়ে ভালো দিক হলো, সেখানে পড়তে জানতে হবে না সেই দেশের ভাষা। ইংরেজি মাধ্যমেই পড়াশোনার সুযোগ রয়েছে ইউরোপের এ দেশটিতে। অর্থাৎ ভাষার বাধা ছাড়াই ইউরোপীয় শিক্ষায় অংশ নেওয়া সম্ভব। শিক্ষার্থীদের জন্য আরেকটি বড় আকর্ষণ হলো শেনজেন ভিসা। এ ভিসায় লিথুয়ানিয়ায় পড়াশোনার পাশাপাশি ইউরোপের ২৬টি দেশে ভ্রমণের সুযোগ মিলবে। পড়াশোনার পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা চাইলে এ দেশগুলো ঘুরে দেখতে পারবেন, যা তাদের আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতাকে আরও সমৃদ্ধ করবে।
আইইএলটিএস ছাড়াই আবেদন : আইইএলটিএস ছাড়া বিদেশে পড়াশোনার কথা যেখানে ভাবাই যায় না, সেখানে লিথুয়ানিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বর্তমানে ব্যাচেলরস ও মাস্টার্স, দুই স্তরেই ভাষাগত দক্ষতার এ বিশেষ সনদপত্র ছাড়াই আবেদন করতে পারবেন বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা। অনার্সের জন্য আবেদনকারীরা শুধু একটি ইংরেজি টেস্ট দিয়েই ভর্তির সুযোগ পাবেন। আর মাস্টার্স হলে তো কথাই নেই। শিক্ষার্থীরা তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের এমওআই (মিডিয়াম অব ইনস্ট্রাকশন) সার্টিফিকেট দেখিয়ে আবেদন করতে পারবেন।
টিউশন ফি কত : লিথুয়ানিয়ায় ব্যাচেলর প্রোগ্রামের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য বছরে প্রায় ১ হাজার থেকে ৫ হাজার ৩০০ ইউরো (প্রায় ১ লাখ ৪১ হাজার থেকে ৭ লাখ ৪৭ হাজার টাকা) পর্যন্ত খরচ হতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় ও বিষয়ভেদে এ খরচ কমবেশি হয়। আর মাস্টার্স প্রোগ্রামের ক্ষেত্রে বছরে ২ হাজার ৩০০ থেকে ৮ হাজার ইউরো পর্যন্ত খরচ হতে পারে। বিশেষ কিছু কোর্স বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে এ খরচ আরও বেশি হতে পারে। প্রযুক্তি, প্রকৌশল, স্থাপত্য বা ডিজাইনের মতো বিষয়ের ফি সাধারণ বিষয়গুলোর তুলনায় কিছুটা বেশি হয়।
চাকরির সুযোগ : লিথুয়ানিয়া আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা শেষে ‘পোস্ট-স্টাডি ওয়ার্ক পারমিট’ দেয়। যার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা দেশটিতে চাকরি খুঁজতে পারেন। পড়াশোনা শেষে এক বছর পর্যন্ত লিথুয়ানিয়ায় থেকে চাকরি খোঁজার সুযোগ থাকে। পড়াশোনার সময়ই শিক্ষার্থীরা প্রতি সপ্তাহে ২০ ঘণ্টা পর্যন্ত পার্ট-টাইম কাজ করতে পারেন। তাছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্য দেশেও (শেনজেন অঞ্চলে) চাকরির সুযোগ পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
স্থায়ী হওয়ার সুযোগ : চাকরি পাওয়ার পর শিক্ষার্থীরা ওয়ার্ক ভিসা বা অস্থায়ী আবাসনের অনুমতি (টেম্পোরারি রেসিডেন্সি পারমিট)-এর জন্য আবেদন করতে পারেন। এর মাধ্যমে তারা সেখানে থেকে কাজ করতে পারবেন এবং পরবর্তীতে স্থায়ী হওয়ার সুযোগও মিলবে।
ঐতিহ্যবাহী পাঁচ বিশ্ববিদ্যালয়
বলা হয়ে থাকে, ইউনিভার্সিটি বা বিশ্ববিদ্যালয় ধারণাটির উদ্ভব হয়েছিল ইউরোপের মাটিতে। এটাও বলা হয়, বিশ্বের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছিল ইউরোপে। এখানে হাজার বছরের প্রাচীন বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। আজও সেগুলো সমান দ্যুতি ছড়াচ্ছে, আলোকিত করছে জগৎ। বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাও এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখার সুযোগ পাচ্ছেন এখন।
বোলোগনা বিশ্ববিদ্যালয় : ইতালির বোলোগনায় অবস্থিত এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়েছিল ১০৮৮ সালে। বলা হয়, ইউরোপের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় এটি। আজও একটি মর্যাদাপূর্ণ শিক্ষালয় হিসাবে বিবেচিত হয়ে থাকে বোলোগনা বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৮০ হাজার। রেডিওর আবিষ্কারক মার্কনি এবং স্কুডেরিয়া ফেরারির প্রতিষ্ঠাতা এনজো ফেরারি এ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ছিলেন।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় : ইউরোপের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম করলে এ প্রতিষ্ঠানকে মোটেই এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। যতটুকু জানা যায়, ১০৯৬ সাল থেকে পরিচিতি লাভ করে আজও একটি মর্যাদাপূর্ণ বিদ্যাপীঠ হিসাবে সুনাম অক্ষুণ্ন রাখতে সক্ষম হয়েছে অক্সফোর্ড। টাইমস হায়ার এডুকেশনের বিবেচনায়, ২০১৭ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত একনাগাড়ে সাত বছর বিশ্ববিদ্যালয়টি বিশ্বে প্রথম স্থান অধিকার করে আছে। বর্তমানে অক্সফোর্ডে ১৬০টি দেশের প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছেন। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেছেন ২৮ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী, ৩০ আন্তর্জাতিক নেতা, ৫৫ নোবেল পুরস্কার বিজয়ী এবং ১২০ অলিম্পিক পদক বিজয়ী।
সালামানকা বিশ্ববিদ্যালয় : স্পেনের এ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয় ১১৩৪ সালে। জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চার এমন উজ্জ্বল পাদপীঠকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে ২৮ হাজার ইনস্টিটিউট। দেশ-বিদেশের বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী-গবেষক সালামানকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যস্ত সময় কাটান জ্ঞানচর্চা করে। এ প্রতিষ্ঠানে পড়া অনেক গুণী শিক্ষার্থীর অন্যতম পানামার প্রেসিডেন্ট অ্যারিস্টিডেস রায়ো।
প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় : এ প্রাচীন বিদ্যাপীঠ ফ্রান্সের প্যারিসে স্থাপিত হয়েছিল ১১৬০ সালে। মধ্যযুগ থেকেই ধর্মতত্ত্ব ও দর্শনচর্চার তীর্থ ছিল প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়। তবে ১৭৯৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয়টি বন্ধ হয়ে যায়। প্রায় এক শতাব্দী পর ১৮৯৬ সালে আবার চালু হয় এটি। ১৯৭০ সালে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে ১২টি স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভক্ত করা হয়। বিভিন্ন দেশের প্রায় ৫২ হাজার ছাত্রছাত্রী এবং ৪ হাজার ৫০০ শিক্ষক-গবেষক এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন মেরি এবং পিয়েরে কুরি। এ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা অর্জন করেছেন ৪৯টি নোবেল পুরস্কার।
পাদোয়া বিশ্ববিদ্যালয় : এটি ইতালির আরেকটি প্রাচীন বিদ্যাপীঠ। স্থাপিত হয়েছিল ১২২২ সালে। এর দৃষ্টিনন্দন ক্যাম্পাস মুখর হয় দেশ-বিদেশের শিক্ষার্থী, পণ্ডিত, গবেষকদের দৃপ্ত পদচারণে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৫৮ হাজার। শতাব্দীর পর শতাব্দী ইউরোপের গণ্ডি ছাড়িয়ে এ প্রতিষ্ঠানের দীপ্তি ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বব্যাপী। বিশ্ব বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী নিকোলাস কোপার্নিকাস ছিলেন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।
১০ শীর্ষ বৃত্তি ও সুযোগ-সুবিধা
১. নেদারল্যান্ডস ইনস্টিউট ফর অ্যাডভান্স স্টাডি সেফ হ্যাভেন ফেলোশিপ (২০২৬)
ধরন : ফেলোশিপ। সুবিধা : প্রতি মাসে ৩,৫০০ ইউরো স্টাইপেন্ড, ভ্রমণ খরচ, আবাসনের ভর্তুকি, লাইব্রেরি সুবিধা ও গবেষণা সহায়তা। ডেডলাইন : ৩১ ডিসেম্বর, ২০২৫
২. ইন্টারপোল ইন্টার্নশিপ ২০২৬ (ফ্রান্স)
ধরন : পেইড ইন্টার্নশিপ। সুবিধা : মাসে ৭০০ ইউরো ভাতা, হাউজিং ও ট্রান্সপোর্ট ভর্তুকি, আন্তর্জাতিক সংস্থায় কাজের অভিজ্ঞতা।
৩. সার্ন রিচার্স ফেলোশিপ ২০২৬ (সুইজারল্যান্ড)
ধরন : ফেলোশিপ। সুবিধা : মাসিক ৬,৯১১-৭,৩২৬ সুইস ফ্রাঁ ভাতা, স্বাস্থ্যবিমা, পেনশন ফান্ড, ভ্রমণ ভাতা।
৪. ওইসিডি ইন্টার্নশিপ ২০২৬ (ফ্রান্স)
ধরন : পেইড ইন্টার্নশিপ। সুবিধা : মাসিক প্রায় ১,০০০ ইউরো ভাতা, আন্তর্জাতিক পরিবেশে কাজ, হাইব্রিড বা রিমোট কাজের সুযোগ।
৫. ম্যাক্স প্লাঙ্ক সোসাইটি ইন্টার্নশিপ ২০২৬ (জার্মানি)
ধরন : সম্পূর্ণ অর্থায়িত ইন্টার্নশিপ
সুবিধা : স্টাইপেন্ড, আবাসন ও ভ্রমণ খরচ, আন্তর্জাতিক গবেষণায় অংশগ্রহণের সুযোগ।
৬. মোপগা ফেলোশিপ ২০২৬ (ফ্রান্স)
ধরন : পেইড ফেলোশিপ
সুবিধা : মাসিক ২,৫০০ ইউরো ভাতা, ৫০০ ইউরো রিলোকেশন ইউরো খরচ, স্বাস্থ্যবিমা ও ফরাসি সরকারের বৃত্তিধারীর মর্যাদা।
ডেডলাইন : ১২ ডিসেম্বর, ২০২৫
৭. ফেসপি ফেলোশিপ ২০২৬ (জার্মানি ও পোল্যান্ড)
ধরন : ফেলোশিপ। সুবিধা : বিমানভাড়া, থাকা, খাবার ও প্রোগ্রাম ফি সম্পূর্ণ কভার। ডেডলাইন : ৪ জানুয়ারি, ২০২৬
৮. ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ভলান্টিয়ারিং প্রোগ্রাম ২০২৫ (ইউরোপ)
ধরন : ভলান্টিয়ারিং। সুবিধা : খাবার ও দৈনিক ভাতা, যাতায়াত খরচ, বাসস্থান ও প্রশিক্ষণের সুযোগ।
৯. ইকলো পলিটেকনিক এক্সিলেন্স ফেলোশিপ (সুইজারল্যান্ড)
ধরন : মাস্টার্স ফেলোশিপ। সুবিধা : প্রতি সেমিস্টারে ১০,০০০ সুইস ফ্রাঁ, রুম সংরক্ষণ ও সার্টিফিকেট অব এক্সিলেন্স।
১০. সার্ন টেকনিক্যাল স্টুডেন্ট প্রোগ্রাম ২০২৬ (সুইজারল্যান্ড)
ধরন : সম্পূর্ণ অর্থায়িত ইন্টার্নশিপ
সুবিধা : মাসিক ৩,৪৭২ সুইস ফ্রাঁ ভাতা, ভ্রমণ খরচ, স্বাস্থ্যবিমা, ছুটির সুযোগ। এ প্রোগ্রামগুলোর মাধ্যমে ইউরোপে একটা লম্বা সময় পড়াশোনা ও থাকার সুবিধা রয়েছে। যা একজন শিক্ষার্থীর ভবিষ্যতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান হয়ে থাকতে পারে। এ ছাড়া আরও কিছু বৃত্তি রয়েছে যেগুলোর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি অর্জন করতে পারেন।
