সাবেক কনস্টেবল মশিউরের প্রতারণা
জমির ভুয়া শেয়ার বেচে নিলেন ১০ কোটি টাকা
ভাড়াটে সন্ত্রাসী দিয়ে প্রাণনাশের হুমকি ও মারধরের অভিযোগ
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) অবসরপ্রাপ্ত কনস্টেবল মশিউর রহমানের বিরুদ্ধে জমির শেয়ার বিক্রির নামে প্রতারণার অভিযোগ উঠেছে। ‘আমার বাড়ি আমার ঘর’ প্রকল্পের ভুয়া শেয়ার বিক্রি করে গ্রাহকদের কাছ থেকে কমপক্ষে ১০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। তার প্রতারণায় নিঃস্ব হয়ে গেছেন ১৭০ জন শেয়ারহোল্ডার। তার বিরুদ্ধে ভাড়াটে সন্ত্রাসী দিয়ে ভয়ভীতি প্রদর্শন, প্রাণনাশের হুমকি ও মারধরের অভিযোগও তুলেছেন ভুক্তভোগীরা।
তাদের দাবি-মশিউর ভুয়া কাগজপত্র ও জাল দলিলের মাধ্যমে প্রতারণা করেছেন। এসব কাজে আনুকূল্য পেয়েছেন স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলের নেতা ও পুলিশের অসাধু কর্মকর্তাদের। এ বিষয়ে অভিযোগ দেওয়া হয়েছে প্রধান উপদেষ্টা, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা, রাজউক চেয়ারম্যান, রিহ্যাব সভাপতি, দুদক চেয়ারম্যান, আইজিপি ও ডিএমপি কমিশনারের কাছে। অভিযোগ অস্বীকার করে মশিউর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ভুয়া কাগজপত্র দেখিয়ে শেয়ার বিক্রি করেছি বলে কিছু লোক আমার বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন করেছিল। তাদের অভিযোগ সঠিক না। আমি কোনো ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করিনি। অতিরিক্ত শেয়ারও বিক্রি করিনি। তিনটি দলিলে মোট ১৫৯টি শেয়ার বিক্রি করেছি। এসব দলিলের খাজনা-খারিজ সবকিছুই আপডেট আছে। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, ২০২৩ সালে রাজধানীর হাতিরঝিলসংলগ্ন পশ্চিম মেরুল বাড্ডা এলাকায় ‘আমার বাড়ি আমার ঘর’ নামের একটি প্রকল্প শুরু করেন পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত কনস্টেবল মশিউর রহমান। ৩৮ কাঠা জায়গায় এ প্রকল্পে যুক্ত করেন ১৪৯ জনকে। তাদের দাবি-জমি রেজিস্ট্রেশন, রাজউক থেকে বিল্ডিংয়ের অনুমোদন, জমি ব্যবহারের ছাড়পত্র এবং প্রকল্পে প্রবেশের রাস্তা প্রশস্ত করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে গ্রাহকদের কাছ থেকে ৭৬ লাখ টাকা নেন মশিউর। এসব কাজ বাস্তবায়ন দূরের কথা, উলটো শেয়ারহোল্ডারদের জায়গা দখল, মারধর, ভয়ভীতি প্রদর্শন ও প্রাণনাশের হুমকি দেন তিনি। আত্মসাৎ করেন মোটা অঙ্কের টাকা।
ভুক্তভোগী ফরহাদ জামিল যুগান্তরকে বলেন, আমি যখন টাকা বিনিয়োগ করি, তখন মশিউর বলেছিলেন ৬ মাসের মধ্যেই কাজ শুরু করবেন এবং ৩ বছরের মধ্যে ফ্ল্যাট হস্তান্তর করবেন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে মতিউর পালটে গেছেন। তিনি আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। আমাদের ঠকিয়ে নিজে অবৈধ অর্থের মালিক হয়েছেন।
শাহজাহান নামের এক শেয়ারহোল্ডার বলেন, মশিউর রহমান একজন দালাল। তিনি দালালি করে অতিরিক্ত শেয়ার বিক্রি করে প্রায় ১০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। তার প্রতারণায় আমরা নিঃস্ব হয়ে গেছি। এখন তিনি আমাদের হুমকি দেন এবং ভয়ভীতি দেখান।
ইলিয়াস নামের এক ভুক্তভোগী যুগান্তরকে বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের সময় মশিউর রহমানের বিরুদ্ধে কথা বলা যেত না। ক্ষমতা দেখিয়ে তিনি আমাদের শেয়ারহোল্ডারদের এই এলাকায় প্রবেশই করতে দিতেন না। আমাদের মারধর করতেন। সরকার পরিবর্তন হলেও মশিউর রহমানের ক্ষমতার পরিবর্তন হয়নি। তার বাহিনীর সদস্যরা কিছুদিন আগেও আমাকে মারধর করেছে। তারা কাজ করতে ১ কোটি টাকা চাঁদা চেয়েছে। নইলে কাজ করতে দেবে না বলে হুমকি দিয়েছে। ‘আমার বাড়ি আমার ঘর’ প্রকল্পে যত শেয়ার আছে, সেগুলোর অতিরিক্ত আরও ২১টি শেয়ার বিক্রির অভিযোগ রয়েছে মশিউর রহমানের বিরুদ্ধে। এসব শেয়ারপ্রতি নিয়েছেন ২৫ লাখ টাকা। সব মিলে ১৭০ জন শেয়ারহোল্ডার মশিউরের প্রতারণার শিকার বলে জানা গেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক শেয়ারহোল্ডার যুগান্তরকে বলেন, জায়গা না থাকার পরও মশিউর আমাদের কাছে অতিরিক্ত শেয়ার বিক্রি করেছেন। অথচ জমি, ল্যান্ড ইউজেস ক্লিয়ারেন্স, ড্রয়িং, ডিজাইন এবং প্ল্যান পাশ ছাড়াই তিনি আমাদের ১৮০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট দেবেন এবং ১৮ তলাবিশিষ্ট বিল্ডিং করার মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এ লক্ষ্যে জাল দলিল তৈরি এবং ভুয়া পাওয়ার অব অ্যাটর্নি নিয়ে নিজেকে জমির মালিক হিসাবে দাবিও করেছিলেন। তবে তিনি আমাদের অর্থ ফেরত দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আমরা টাকা ফেরত পাব বলে অপেক্ষা করছি। এই মুহূর্তে তার বিরুদ্ধে আমরা কিছু বলতে পারব না।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, শেখ হাসিনার সরকারের পতনের আগে নিজেকে আওয়ামী লীগ পরিচয় দিতেন মশিউর রহমান। স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে সখ্য গড়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর মশিউর নিজের ভোল পালটে ফেলেছেন। সম্পর্ক গড়েছেন বড় একটি রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে। তাদের ছত্রছায়ায় এখনো ক্ষমতার অপব্যহার করছেন মশিউর।
