Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

ফেরেনি গুমের শিকার ৩৫০ জন

কেউ জানে না আর কতকাল অপেক্ষা

ইমন রহমান

ইমন রহমান

প্রকাশ: ০১ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

কেউ জানে না আর কতকাল অপেক্ষা

গুমের শিকার ছাত্রদল নেতা পারভেজের পরিবার। ছবি: যুগান্তর

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গুমের শিকার ব্যক্তিদের মধ্যে তিনশ পঞ্চাশ জন এখনো ফিরে আসেননি। নিখোঁজ এসব মানুষের স্বজনদের আশা ছিল-গত বছরের ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের পতনের মধ্য দিয়ে তাদের অপেক্ষার অবসান ঘটবে। কিন্তু পূরণ হয়নি সে প্রত্যাশা। নিখোঁজ ওই সব ব্যক্তি বেঁচে আছেন না মারা গেছেন তা এখনো অজানা। ফলে আজও স্বজনের ফেরার অপেক্ষায় অশ্রুসিক্ত নয়নে প্রহর গুনছেন অনেকে। এদিকে সরকার গঠিত গুমসংক্রন্ত কমিশন অব ইনকোয়ারিও গুম থাকাদের বিষয়ে কোনো তথ্য দিতে পারছে না।

১১ বছর বয়সি শিশু আরাফ হোসেন পৃথিবীর আলো দেখার কয়েক মাস আগে তার বাবা পারভেজ হোসেনকে একদল লোক রাজধানীর শাহবাগ থেকে ডিবি পরিচয়ে তুলে নিয়ে যায়। আরাফ এখন মাতুয়াইল আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ছে। বাবার আদর, স্নেহ কেমন তা জানে না ছোট্ট এই শিশুটি। কান্নাজড়িত কণ্ঠে আরাফ যুগান্তরকে বলে, ‘আমি কখনো বাবাকে দেখিনি। ছবি দেখে বাবাকে অনুভব করি। আমি আর কিছু চাই না। শুধু বাবাকে ফিরে পেতে চাই।’

গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনদের নিয়ে গঠিত সংগঠন ‘মায়ের ডাক’র তথ্য অনুযায়ী, আওয়ামী লীগ আমলে গুম ছিলেন ৭০৫ জন। গত বছরের ৫ আগস্টের পর অনেকেই আয়নাঘর থেকে মুক্তি পেয়েছেন। তবে এখনো প্রায় সাড়ে ৩০০ জন ফেরেননি। সংগঠনটির সমন্বয়ক আফরোজা ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারগুলো অর্থকষ্টে ভুগছে। অনেক পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম লোকটাই নেই। এছাড়া গুমের শিকার যে পরিবারগুলো সচ্ছল ছিল, তারাও স্বজনকে ফিরে পেতে এখানে-ওখানে টাকা দিতে দিতে নিঃস্ব হয়ে গেছে। 

আফরোজা ইসলাম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমরা দেখছি, যারা ফিরে আসছে গুমসংক্রান্ত কমিশনে তাদের নিয়ে বেশি কাজ চলছে। তাদের বিষয়ে কথা বলছে। কিন্তু গত ১২ থেকে ১৩ বছর ধরে মাঠে সংগ্রাম করেও যে পরিবারগুলো এখনো স্বজনহারা, তাদের ব্যাপারে সব ক্ষেত্রে উদাসীনতা দেখছি।

জানতে চাইলে গুমসংক্রান্ত কমিশন অব ইনকোয়ারির সভাপতি অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, ‘যারা আমাদের কাছে অভিযোগ দিয়েছে, তাদের প্রত্যেকটির সুরাহা করছি। যারা এখনো ফিরে আসেনি তাদের বিষয়ে কী করা যাবে বা তাদের কী করা হয়েছে সে বিষয়ে আমরা ফাইনাল রিপোর্টে বলব। এ বিষয়ে অ্যাডভান্স বলা যাবে না।’

জানা গেছে, গুমের শিকার পারভেজ হোসেন বংশাল থানা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তার স্ত্রী ফারজানা আক্তার দুই সন্তানকে নিয়ে বর্তমানে রাজধানীর ওয়ারী থানাধীন যোগীনগর এলাকায় বোনের বাসায় থাকছেন। রোববার (২৬ অক্টোবর) দুপুরে ওই বাসায় গিয়ে কথা হয় পারভেজের স্ত্রী-সন্তানের সঙ্গে। পারভেজ গুমের সময় দুই বছর চার মাস বয়সি মেয়ে আদিবা ইসলাম হৃদি এখন রাজধানীর টিকাটুলির শেরেবাংলা বালিকা মহাবিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ছে। বাবার সঙ্গে ছোটবেলায় তোলা ছবি মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে দিয়ে রেখেছে।

পারভেজের স্ত্রী ফারজানা আক্তার যুগান্তরকে জানান, ২০১৩ সালের ২ ডিসেম্বর দুপুরে শাহবাগ থেকে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে তিন সহযোগীসহ তুলে নেওয়া হয় পারভেজকে। এরপর থেকে আর কোনো হদিস মেলেনি তাদের। গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গুমসংক্রান্ত কমিশনে অভিযোগ করেন তিনি। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালেও মামলা করেছেন। হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করে ফারজানা বলেন, ৫ আগস্টের পর আশায় বুক বেঁধেছিলাম স্বামী ফিরে আসবে। কিন্তু এখনো এলো না। আমি আজও তার ফেরার অপেক্ষায় আছি। আমার বিশ্বাস সে ফিরে আসবে। দুই শিশুকে নিয়ে প্রচণ্ড অর্থকষ্টে আছেন জানিয়ে ফারজানা বলেন, আমাদের জীবন এখন কচুপাতার পানির মতো। পারভেজ কিছুই রেখে যায়নি। ছেলে আরাফ হোসেন জন্ম থেকেই হার্টের রোগী। তার চিকিৎসা খরচ বহনসহ দুই ছেলেমেয়ের পড়ালেখা করানো আমার জন্য অসম্ভব হয়ে পড়েছে। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অনেকের জন্য অনেক কিছু করলেও আজও আমাদের জন্য কোনো সহায়তার ব্যবস্থা করল না।’

রাজধানীর মিরপুরের পল্লবী থানা এলাকা থেকে ২০১৪ সালের ১ জানুয়ারি অপহৃত হন ব্যবসায়ী মো. কুদ্দুসুর রহমান চৌধুরী। রিয়েল এস্টেট কোম্পানির সঙ্গে জমিজমাসংক্রান্ত বিরোধের জেরে সাদা পোশাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোক পরিচয়ে তাকে তুলে নিয়ে যায়। এখনো তিনি ফিরে আসেননি। কুদ্দুসুর রহমানের জমিগুলো বেদখল হয়ে গেছে। তার মেয়ে ফারজানা আক্তার টুম্পা যুগান্তরকে বলেন, আমরা গুমসংক্রান্ত কমিশনে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছি, তাদের বিষয়ে এখনো কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ট্রাইব্যুনালেও অভিযোগ করেছি। এখনো বাবার কোনো সন্ধান পাইনি। আমরা বিভিন্ন জায়গায় দৌড়াদৌড়ি করেও কোনো রেজাল্ট পেলাম না।

রাজধানীর সূত্রাপুর থানার ৭৯ নম্বর ওয়ার্ড (বর্তমান ৪৩ নম্বর) ছাত্রদলের তৎকালীন সভাপতি খালেদ হাসান সোহেল গুমের এক যুগ পার হয়েছে। পাঁচ বছর বয়সে বাবাকে হারায় মো. সাদমান শিহাব আরিয়ান। তার বয়স এখন ১৭। এখনো সে বাবার পথ চেয়ে বসে থাকে। একমাত্র সন্তানকে নিয়ে সোহেলের স্ত্রী সৈয়দা শাম্মি সুলতানার মানবেতর দিন কাটছে। শুধু উপরোক্ত ঘটনাগুলোই নয়, গুমের শিকার প্রতিটি পরিবারই চাপা কষ্ট বুকে নিয়ে দিন পার করছে। বছরের পর বছর কেটে যাচ্ছে স্বজনের অপেক্ষায়।

উল্লেখ্য, গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গুমসংক্রান্ত কমিশন অব ইনকোয়ারি গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার। গুমের শিকার ব্যক্তিদের সন্ধান ও গুমের সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে কাজ করছে কমিশন। কমিশন সূত্রে জানা গেছে, এক হাজার ৯০০-এর মতো অভিযোগ জমা পড়েছে কমিশনে। সেগুলো বিশ্লেষণের কাজ চলমান আছে। অভিযোগগুলোর মধ্যে ২০০ জন এখনো গুম রয়েছেন, যাদের বেশির ভাগই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে গুমের শিকার। আর যারা ফিরেছেন, তাদের সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে গুমের রোমহর্ষক তথ্য। 

সম্প্রতি গুমসংক্রান্ত কমিশন প্রকাশিত তথ্যচিত্রে বলা হয়েছে, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে বাংলাদেশের প্রত্যেকটা বাহিনী জড়িত। তবে এদের মধ্যে মূল ভূমিকায় ছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ছয়টি ইউনিট। সেগুলো হলো-র‌্যাব, বাংলাদেশ পুলিশ, ডিবি, সিটিটিসি, ডিজিএফআই ও এনএসআই। এসব বাহিনীর সদস্যদের তত্ত্বাবধানে গুমের শিকার ব্যক্তিদের দিনের পর দিন আটকে রেখে অমানবিক নির্যাতন করা হয়। তাদের অনেককেই হত্যা করা হয়েছে। প্রথমদিকে গুমের পর হত্যা করে লাশ রাস্তাঘাটে ফেলা হলেও পরবর্তী সময়ে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে লাশ গুম করা হয়েছে।

গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে সংশ্লিষ্টতার কারণে এসব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ৪২ কর্মকর্তার পাসপোর্ট বাতিল করা হয়েছে। এদের বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। সর্বশেষ সাবেক ও বর্তমান মিলে ২৫ সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। এর মধ্যে ১৫ জন বর্তমানে চাকরিরত, ৯ জন অবসরে, ১ জন এলপিআরে। চাকরিরত ১৫ সেনা কর্মকর্তা আত্মসমর্পণও করেছেন।

সূত্র বলছে, এখন পর্যন্ত কমিশনে জমা পড়া ১৯০০ অভিযোগের মধ্যে ২৫০টির অকাট্য প্রমাণ মিলেছে। এদের মধ্যে বিভিন্ন পেশাজীবী ও শ্রেণি-পেশার মানুষ রয়েছে। গুমের শিকার অনেকের রাজনৈতিক পরিচয়ও মিলেছে। তাদের ‘জঙ্গি ট্যাগ’ লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে।

গুমসংক্রান্ত কমিশনের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, গুমের পর ভারতের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে অনেককে। তাদের মধ্যে কারও কারও জেলে যেতে হয়েছে অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ভারত সরকারের কাছে বাংলাদেশি বন্দি যারা আছে, তাদের তালিকা চেয়েছিল গুমসংক্রান্ত কমিশন। কিন্তু তারা যে তালিকা দিয়েছে সেটি অসম্পূর্ণ এবং যে সময়ের অর্থাৎ ২০০৯ সাল থেকে ২০২৪-এর ৫ আগস্ট পর্যন্ত তথ্য চাওয়া হলেও সেই সময়ের তালিকা দেয়নি ভারত।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম