ফ্রান্সের সেন্ট-ম্যাক্সিম: ভূমধ্যসাগরের বুকে নীল জলরাশির শহর
হাসান ইলিয়াস তানিম, প্যারিস (ফ্রান্স) থেকে:
প্রকাশ: ১৫ জুন ২০২৫, ১০:৪১ এএম
ছবি: সংগৃহীত
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ভূমধ্যসাগরের নীল জলরাশি আর সোনালি বালুর মাধুর্যে মোড়ানো এক ছোট্ট শহর সেন্ট-ম্যাক্সিম (Sainte Maxime)। দক্ষিণ ফ্রান্সের রিভিয়েরার বুকে অবস্থিত এই শহর যেন প্রকৃতির অপূর্ব এক উপহার, যা দেখলে মুহূর্তেই হৃদয় মেতে ওঠে। নদীর মতো প্রবহমান ইতিহাস, সংস্কৃতির ঘ্রাণ আর অপূর্ব প্রাকৃতিক দৃশ্যের এক মেলবন্ধন এই শহরকে পরিণত করেছে এক স্বপ্নিল গন্তব্যে, যেখানে এসে ভ্রমণকারীর মন খুঁজে পায় নিঃশব্দ প্রশান্তি।
ইতিহাসের নির্মল রেখা
ষোড়শ শতকের মাঝামাঝি সমাজে সেন্ট-ম্যাক্সিম একটি ছোট মাছ ধরার পল্লি হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিল। জলদস্যুদের হাত থেকে শহর রক্ষায় নির্মিত পাথরের দুর্গ আজও সেই অতীতের গর্ব ধরে রেখেছে। শহরের বিখ্যাত গির্জা এগ্লিজ সেন্ট-ম্যাক্সিম তার শতাব্দী পেরোনো ইতিহাসের সাক্ষী; রঙিন কাঁচের জানালা ও প্রাচীন ভাস্কর্যগুলো সেই ইতিহাস জীবন্ত করে তোলে। শহরের সরু পাথুরে গলিপথ, পুরোনো ঘরবাড়ি, প্রতিটি সিঁড়ি আজও ইতিহাসের নিঃশব্দ পায়ের ছাপ বহন করে।
প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য
সেন্ট-ম্যাক্সিম এক অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের নাম। শহরের উদ্ভিদ উদ্যান এ নানা রঙের ফুলের সৌরভ আর পাহাড়ি রাস্তার ছায়া মিলে তৈরি করে এক স্বপ্নময় দৃশ্যপট। শহরের সেরা দুটি সৈকত প্লাজ দ্য লা নার্তেল ও প্লাজ দেজ এলেফঁ—ঢেউয়ের শব্দে, সূর্যাস্তের সোনালি আলোয়, হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়ার মতো দৃশ্য তৈরি করে।
পাহাড় বেয়ে নামা মনোরম প্রাকৃতিক পথ হেঁটে বা হালকা আরোহণে যারা প্রকৃতির সঙ্গে সময় কাটাতে ভালোবাসেন, তাদের জন্য এ যেন স্বর্গস্বরূপ।
সংস্কৃতি ও জীবনধারা
সেন্ট-ম্যাক্সিম-এর সংস্কৃতি বহুবর্ণিল ও জীবন্ত। শহরের প্রাণকেন্দ্র মার্শে প্রোভঁসাল—স্থানীয় কৃষক ও কারিগরের তৈরি নানা খাদ্যপণ্য, সুগন্ধি, জলপাই তেল ও হস্তশিল্পে ঠাসা এই বাজার। প্রতিটি গলিতে যেন ফরাসি জীবনের ছোঁয়া লেগে আছে।
এখানে প্রতিবছর হয় ফেত দ্য লা মের (সমুদ্র উৎসব) ও ফেত দ্য লা মিউজিক (সঙ্গীত উৎসব)। উৎসবকালে শহরের অলিগলি সঙ্গীত, নাচ আর রঙে ভরে ওঠে। স্থানীয় ও ভিনদেশি পর্যটক মিলেমিশে এক প্রাণবন্ত পরিবেশ তৈরি করে।
শিল্পপ্রেমীদের জন্য শহরে রয়েছে অনেক চিত্রপ্রদর্শনী কেন্দ্র—যেখানে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক শিল্পীদের সৃষ্টি প্রদর্শিত হয়। কিংবদন্তি চলচ্চিত্র নির্মাতা আলফ্রেদ হিচক তার বিখ্যাত সিনেমা টু ক্যাচ আ থিফ–এর বেশ কিছু দৃশ্য এখানেই ধারণ করেন।
বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব ও গৌরবময় স্মৃতি
সেন্ট-ম্যাক্সিম যেন বিশ্ববিখ্যাত ব্যক্তিদের পছন্দের গন্তব্য। পপ সংগীতের রাজা মাইকেল জ্যাকসন এই শহরের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে একাধিকবার নিভৃতে এখানে সময় কাটিয়েছেন। ফরাসি কবি পল ক্লোদেল এবং শিল্পী লুই মারতিন তাদের সৃষ্টিশীল জীবনের অনেকটা সময় কাটিয়েছেন এখানেই। সুইডিশ রাজপরিবারের প্রিন্স বের্তিল-এর দীর্ঘ বন্ধুত্বপূর্ণ উপস্থিতিও শহরের ইতিহাসে স্মরণীয়।
এই শহরের হৃদয়ে আছেন এক অনন্য মানুষ—ফ্রাঁসোয়া ফোলে। প্রায় ৭০ বছর বয়সি এই ক্যাথলিক স্বেচ্ছাসেবক মানুষটি শুধু সেবামূলক কাজেই নিজেকে নিয়োজিত রাখেননি, বরং বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশের প্রতি তার ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও বন্ধন অবাক করে দেয়। স্থানীয় একমাত্র বাংলাদেশি নাগরিকের সঙ্গে তার সম্পর্ক যেন আত্মার আত্মীয়তার এক অনন্য নজির।
আধুনিক বিলাসিতা ও সমৃদ্ধ জীবন
বর্তমান সেন্ট-ম্যাক্সিম আধুনিকতা আর ঐতিহ্যের এক মনোরম মিলনস্থল। শহরে রয়েছে বিলাসবহুল রিসোর্ট (বিশ্রামাগার), আরামদায়ক হোটেল, উৎকৃষ্ট মানের খাবার ঘর এবং প্রাণবন্ত রাত্রিকালীন আনন্দ। ফরাসি সুগন্ধি, হস্তশিল্প আর স্থানীয় বাজার যেন পর্যটকদের জন্য এক স্বর্ণখনি।
প্রতিটি সকাল শুরু হয় নতুন আলোয়, প্রতিটি রাত যেন এক নতুন গল্পের জন্ম দেয়। সেন্ট-ম্যাক্সিম কেবল একটি শহর নয়—এটি একটি অনুভব, এক হৃদয়ছোঁয়া ভালোবাসার ঠিকানা। এখানে আসলে আপনি কেবল প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখবেন না—আপনি অনুভব করবেন ইতিহাস, সংস্কৃতি আর মানুষের নিঃশব্দ হৃৎস্পন্দন।
আপনি যদি ভ্রমণপ্রেমী হন আর এমন এক গন্তব্য খুঁজে থাকেন, যেখানে অতীত ও বর্তমানের সেতুবন্ধনে তৈরি হয় স্বপ্নিল ভবিষ্যৎ, তবে সেন্ট-মাক্সিম-ই হতে পারে আপনার পরবর্তী গন্তব্য।
সরদার হাসান ইলিয়াস তানিম
প্যারিস, ফ্রান্স
১৪ জুন ২০২৫
