ওহ পেশোয়ার! তুমি যেন কাঁটাগাছে ফুটে ওঠা গোলাপ
প্রকাশ: ১৫ জুলাই ২০২৫, ১২:৩৫ পিএম
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
এখন ভ্রমণপিপাসুদের প্রিয় শহরের তালিকার শীর্ষে থাকে নিউইয়র্ক, দুবাই কিংবা ভিয়েনা। তবে আমার প্রিয় ধুলোমাখা এক স্বর্গের শহর—পেশোয়ার। ওহ পেশোয়ার! যেন রোদের ভেতর ছায়া, কাঁটাগাছে ফুটে ওঠা গোলাপ।
সব শহরই কেবল রাস্তা, দালান আর নীতিমালার জোগাড়গুছান ছক নয়—কিছু শহর হৃদয় দিয়ে গড়া হয়, কিছু শহর মানুষ দিয়ে রচিত হয়। আর পেশোয়ার তেমনই এক শহর—ধুলোমাখা অথচ রৌদ্রমাখা, সরল অথচ গৌরবোজ্জ্বল।
পাহাড়ের কোলে গড়ে ওঠা এই শহরটি যেন স্বপ্নের মতো ধীর। এখানে সকাল নামে মসৃণ ধুলোর চাদরে, আর বিকেল ছড়িয়ে পড়ে ঝলমলে মাটির আলোয়। রাস্তার ধারে শুকনো বাদামের স্তূপ, পাশে তানপুরার মতো হালকা আওয়াজে বাজে আজান। বাতাসে মেশানো থাকে কাবাবের ধোঁয়া আর এলাচ-দারুচিনির ঘ্রাণ। শহরের ঘরে ঘরে এক ধরনের সরলতা, যেন কারো কিছু প্রমাণ করার নেই।
প্রকৃতি এখানে ভঙ্গুর নয়, ধৈর্যশীল। চিরচেনা আধুনিক শহরের মতো নয়, যেখানে কৃত্রিম রঙে আকাশ ঢেকে রাখা হয়। বরং পেশোয়ার আকাশ খোলা, রুক্ষ পাহাড়ের গায়ে যেন স্নিগ্ধতা মাখানো। ঝড় ওঠে না, বরং বাতাস মৃদু হয়ে শহরের গায়ে ঘষে ঘষে চলে। দিনের শেষে রোদ গড়িয়ে পড়ে মসজিদের মিনারে, আর গলির মোড়ে গুটি গুটি পায়ে নামে সন্ধ্যা। এই শহরের সৌন্দর্য শব্দে নয়, ধীরস্থিরতায়।

পেশোয়ারে কী আছে? কৃত্রিম আলোকচ্ছটা, আকাশছোঁয়া উঁচু ইমারত, বিলবোর্ডে ঝলমলে ব্র্যান্ড কিংবা উদ্যম জীবন পেশোয়ারে নেই। কিন্তু আছে এমন কিছু যা আজকের দুনিয়ায় দুর্লভ—আছে হৃদয়, আছে অতিথিপরায়ণতা, আছে এক গহীন মানবতা।
পেশোয়ার যেন ইতিহাসের পাতায় হারিয়ে যাওয়া এক প্রাচীন কাহিনি, অতিথি হয় আত্মীয়, আর ভালোবাসা হয় ভাষাহীন এক অভিব্যক্তি।
খাবার? সে তো এক আলাদা উপাখ্যান। পেশোয়ারের প্রতিটি খাবার যেন ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে আসা কোনো পুরোনো পাণ্ডুলিপি—অভিনব, আত্মমগ্ন আর আবেগময়। শিক কাবাব, শামি কাবাব, নেহারি, রেজালা, বিরিয়ানি—আহা! সব জান্নাতি খাবার। বিভিন্ন গ্লোবাল স্ট্রিট ফুড রিভিউ চ্যানেল যেমন ফুড রেঞ্জার্স, স্ট্রিট ফুড অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড এবং ফুড ব্লগারেরা সবাই পেশোয়ারের প্রতিটি খাবারকে রেটিংয়ে ১০/১০ দিয়েছেন। এটা আর কোনো শহরে হয় নাই। সবাই নাম দিয়েছে-
‘পেশোয়ার, স্ট্রিট ফুড হ্যাভেন!’

কিন্তু পেশোয়ারকে চেনা যায় না শুধু স্বাদের মাধ্যমে। একটি শহরের আত্মা তার মানুষদের মধ্যে লুকানো থাকে। পেশোয়ারে আছে মাটি-ঘেঁষা মানুষ যাদের হৃদয় ভরা আলো। একটা ভিডিওতে দেখলাম—বাংলাদেশ থেকে তিনজন ইউটিউবার পেশোয়ার ঘুরতে গেছেন। রেস্তোরাঁয় খাবার পর যখনই শুনেছে বাংলাদেশি আর বিল নেয় নাই। বাংলাদেশি! মেরি ভাই! ভাইয়ের কাছ থেকে আবার বিল নেয় নাকি!
তারা তিনদিন পেশোয়ার ছিল কিন্তু কোনো রেস্তোরাঁয় জোর করেও বিল দিতে পারে নাই। এই শহরে ভালোবাসা টাকা চায় না, চায় হৃদয়।
এরকম ভালোবাসা কোনো অর্থনীতির মানদণ্ডে মাপা যায় না, কোনো পর্যটনবিষয়ক ওয়েবসাইটেও পাওয়া যায় না। এই ভালোবাসা আসে হৃদয়ের গভীর থেকে। পেশোয়ার আমাদের শেখায় কেমন করে একটা শহর শুধু রাস্তা, খাবার বা ভবন দিয়ে নয়—মানুষ দিয়ে গড়ে ওঠে। শেখায়, অচেনাকেও আপন করে নেওয়া যায় নিঃস্বার্থ ভালোবাসায়।
লেখক: পিএইচডি গবেষক, জর্জিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্র
ইমেইল: sabbirmir@hotmail.com

