ভারতীয় সাংবাদিকের বিশ্লেষণ
বাংলাদেশি তাড়াতে হলে শেখ হাসিনাকে তাড়ান
অনিকেত চট্টোপাধ্যায়
প্রকাশ: ২৪ আগস্ট ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরশাসক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ফাইল ছবি
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
মালদা ও মুর্শিদাবাদের দরিদ্র বাংলাভাষী ভারতীয়দের বিভিন্ন রাজ্য থেকে জোর করে ধরে এনে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী নো-ম্যানস ল্যান্ডে ছেড়ে দিয়ে আসা হচ্ছে। কেন্দ্রীয় সরকার যদি ভারত থেকে অবৈধ বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের বিতাড়িত করতে চায়, তাহলে তাদের পদচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দিয়েই সে কাজ শুরু করা যায়, করা উচিত। এমআইএম সাংসদ আসাউদ্দিন ওয়েসি সাহেব এই কথা বলেছেন। তার সঙ্গে আমি সব ব্যাপারে একমত না; কিন্তু এই যে কথাটা বলেছেন, সেটা খুব ভুল তো বলেননি।
এত পুলিশ লাগিয়ে, খোঁচর লাগিয়ে অশিক্ষিতের মতো কথাবার্তা বলে, ভাষা আর খাবার দেখে বাংলাদেশি খুঁজে বের করার যে কাজটা, সেটা চিহ্নিত এক বাংলাদেশিকে দিয়েই শুরু হোক না কেন! আবার এমনও তো নয় যে, তিনি আমাদের রাষ্ট্রীয় অতিথি। না, তেমন কোনো ঘোষণা করা হয়নি। সরকার বলেনি যে, শেখ হাসিনাকে ভারত আশ্রয় দিচ্ছে এবং তিনি এই ভূখণ্ডে বসেই রাজনীতি চালিয়ে যাবেন।
হ্যাঁ, এরকমটা বলতেই পারে। লুকানোর কী আছে? আগে কি এমন হয়নি? বাংলাদেশ থেকে চলে আসা যুবকদের মিলিটারি ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে। এই কলকাতাতে বসে স্বাধীন বাংলাদেশ বেতার কেন্দ্র চালানো হয়েছে। কিন্তু সেসব বুক-বাজিয়ে করার জন্য একজন ইন্দিরা গান্ধী দরকার। একজন ৫ ফুট ৬ ইঞ্চির ভীরু কাপুরুষকে দিয়ে সেই কাজ তো হবে না। বিবিসির সাংবাদিক অমিতাভ ভট্টশালী জানাচ্ছেন, কলকাতায় আওয়ামী লীগের দপ্তর খোলা হয়েছে। আনন্দবাজারের সাংবাদিক সুনন্দ ঘোষ আওয়ামী লীগ কর্মী যারা এই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আশ্রয় নিয়েছেন, তাদের সঙ্গে কথা বলছেন, সেসব ছাপা হয়েছে। এটা এখন ওপেন সিক্রেট। তো তারা কি সব বর্ধমানের লোক, দিল্লির লোক, গুজরাটের লোক? তারা বাংলাদেশি নয়?
প্রতিবেশী দেশের সরকার বলছে, তাদের সাবেক প্রধানমন্ত্রী একজন অভিযুক্ত, তার নামে মামলা রুজু হয়েছে। দুর্নীতি-খুন সব ধরনের মামলা নিয়ে তিনি (শেখ হাসিনা) বসে আছেন ভারতে। এখানে বসে তার দল চালাচ্ছেন; তাকে ফেরত দিন। কিন্তু সরকার চুপ। কেন? একদিকে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি, অসম-ত্রিপুরার বাঙালিদের ধরে ধরে বাংলাদেশি বলে পেলডারে করে ছুড়ে দেওয়া হচ্ছে। সেখানে চিহ্নিত বাংলাদেশিদের অবৈধ আশ্রয় দিয়ে রাখা হয়েছে ভারতে।
বাংলাদেশ সরকার যাকে বিচারের জন্য ফেরত চাইছে, সেই শেখ হাসিনাকে ভারত পরম যত্নে রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়েছে এবং সেটাও ঘোষিত আশ্রয় নয়। কিসের জন্য, কোন রাজনীতির জন্য তিনি আমাদের দেশে বসে থাকলে ভারতের কোন্ স্বার্থ সিদ্ধি হবে, কোন্ লাভটা হবে? একজন নিজের দেশের নাগরিক হয়েও শুধু বাঙালি হওয়ার অপরাধে দেশছাড়া হয়, অন্যজন ভিনদেশের নাগরিক হয়ে গুরুতর অভিযোগে অভিযুক্ত হওয়া সত্ত্বেও এই দেশে আশ্রয় পায়।
এই চরম বৈপরীত্য একটাই প্রশ্ন তুলে দেয়-আসলে হচ্ছেটা কী? এই ঘটনাগুলো কি বিচ্ছিন্ন, নাকি এর পেছনে লুকিয়ে আছে এক গভীর রাজনৈতিক চক্রান্ত এবং বাংলা ও বাঙালির বিরুদ্ধে একটা সুচিন্তিত দ্বৈতনীতি, একটা ডাবল স্ট্যান্ডার্ড।
এতে বোঝা যাচ্ছে, কিছু মানুষের জন্য নাগরিকত্ব আর আইনি অধিকার নয়, বরং তার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার দয়ার ওপর নির্ভরশীল এক ঠুনকো অস্তিত্ব মাত্র। বাঙালিরা দয়ায় বেঁচে থাকবে। আজকে আন্দামানে গিয়ে সেলুলার জেলের সামনে যে ফলক রয়েছে, সেই ফলকে যারা দেশের জন্য সেখানে জেলে গেছেন, কালাপানি পার করে সেই জেলে পচে মরেছেন, সেই লিস্টের দিকে তাকিয়ে দেখুন-কারা পড়ে। তারা রাষ্ট্রের দয়ায় বেঁচে থাকবে ভারতবর্ষে? কিছুদিন আগে মালদার এক শ্রমিককে রাজস্থানে আটক করে উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়ি সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়ার এই যে দীর্ঘ প্রক্রিয়া, তা আদতে এক সর্বভারতীয় প্রাতিষ্ঠানিক ষড়যন্ত্রের দিকে ইঙ্গিত করছে। এটা একটা ষড়যন্ত্র, কন্সপিরেসি।
একদল বাংলাদেশি রাজনীতি করছেন, তারা রাষ্ট্রের প্রশ্রয়ে বসে রয়েছেন, খানাপিনা করছেন, ঘুরছেন-ফিরছেন আর এখানকার বাঙালি যারা, তাদেরকে বাংলাদেশি বলে ধরে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে, পুশব্যাক করা হচ্ছে। উলটো এই বহিষ্কার প্রক্রিয়াকে আরও দ্রুত করার জন্য মোদি সরকার ১৯৫০ সালের এক আইন ব্যবহার করার কথা ভাবছে, যা দিয়ে বিচার বিভাগীয় প্রক্রিয়াকে এড়িয়ে যাতে বিদেশি বহিষ্কার করা সম্ভব হয়। এটা আসলে রাষ্ট্র দ্বারা পরিচালিত এক বিচারবহির্ভূত বহিষ্কার অভিযানের সরাসরি নোংরা স্বীকারোক্তি। এই নীতির শিকার হওয়া মানুষগুলোর অভিজ্ঞতা ভয়াবহ। তাদের দুই দেশের জন্যই বিদেশি বানিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
এই প্রক্রিয়া আসলে ডিপোর্ট বা নির্বাসন নয়। এটা ডিপোর্টেশনের নিয়ম নয়। কারণ কোনো আইনি প্রক্রিয়াই মানা হচ্ছে না। অন্য দেশ তাদের গ্রহণ করছে না। এর আসল উদ্দেশ্য হলো একটা নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীকে রাষ্ট্রহীন বানিয়ে তাদের সব অধিকার কেড়ে নেওয়া এবং বাকিদের মনে ভয় ঢুকিয়ে দেওয়া। ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায় যারা বেআইনিভাবে কম পয়সায় কাজ করছেন, ভয়ে ভয়ে থাকছেন কখন পুলিশ এসে ধরে, তাদের কোনো রাষ্ট্র নেই। তারা গেছেন পেটের দায়ে কিছু রোজগার করার জন্য। সেটা আলাদা। আর এখানে কী হচ্ছে? সেই এইরকমভাবে নিজ দেশের লোকই এখানে ভয়ে থাকছে। একজন বাংলাদেশি, একজন ভারতীয়, একজন পাকিস্তানি ফ্রান্সে গিয়ে অবৈধভাবে থাকার কারণে লুকিয়ে বসে রয়েছে।
বোঝা গেল, একজন ভারতীয় যে বাংলায় কথা বলে, সে লুকিয়ে থাকবে। কিন্তু রাষ্ট্র এখানে আইন প্রয়োগের নামে নিজের আইন নিজে ভাঙছে। এই রাষ্ট্রহীন মানুষ তৈরি করাটা আসলে এক রাজনৈতিক কৌশল, যার মাধ্যমে এক সম্প্রদায়কে নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে তাদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করার চেষ্টা চলছে।
ভারতীয় রাষ্ট্রের কাছে এখন নাগরিকত্ব কোনো জন্মগত অধিকার নয়, বরং একটা রাজনৈতিক হাতিয়ার। ভারতের নাগরিক আমির শেখ রাজনৈতিকভাবে অবাঞ্ছিত, তার নাগরিকত্ব কেড়ে নিতে রাষ্ট্র দুবার ভাবছে না, অন্যদিকে বিদেশি শেখ হাসিনা, যিনি সম্ভবত কৌশলগতভাবে দরকারি, তাকে সবরকম সুরক্ষা দিতে রাষ্ট্র প্রস্তুত। রাষ্ট্রের কাছে জাতীয় সুরক্ষার অর্থ বদলে গেছে। একজন গরিব বাঙালি শ্রমিককে এখন দেশের জনবিন্যাসের জন্য বিপজ্জনক বলে মনে করা হয়; কিন্তু একজন অভিযুক্ত বিদেশি শাসককে আশ্রয় দেওয়াটা নিছক বিদেশনীতির অংশ হিসাবে দেখা হচ্ছে। একটা বিশাল পরিকল্পনা নিয়েই এগোচ্ছে আরএসএস বিজেপি।
তাদের মূল উদ্দেশ্য হলো ভারতের বাঙালি জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে মুসলমানদের কোণঠাসা করা। তাদের নাগরিক অধিকার কেড়ে নেওয়া। তার জন্য এক বিষাক্ত সমীকরণ তৈরি করা হচ্ছে। গতকাল ছিল আমির শেখের পালা। আগামীকাল যে আপনার পালা আসবে না, তা কি আপনি হলফ করে বলতে পারেন?
বাংলা বাজার ইউটিউব চ্যানেলের সৌজন্যে
অনিকেত চট্টোপাধ্যায় : ভারতীয় সাংবাদিক ও বিশ্লেষক

