মালয়েশিয়ার শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি শিক্ষার্থীদের দাপট
আহমাদুল কবির, মালয়েশিয়া
প্রকাশ: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০১:৪৬ এএম
ছবি: যুগান্তর
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
মালয়েশিয়ার শীর্ষ পাঁচটি পাবলিক রিসার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা এখন দেশীয় চীনা শিক্ষার্থীদের ছাড়িয়ে গেছে। এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন কেদাহ এডুকেশন এক্সকো প্রফেসর ড. হাইম হিলম্যান আবদুল্লাহ। সম্প্রতি সিনচেউ-এর এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে আসে।
২০২৪ সালের উচ্চশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের (এমওএইচই) ডেটা অনুযায়ী, ইউনিভার্সিটি মালায়া (ইউএম), ইউনিভার্সিটি সাইন্স মালয়েশিয়া (ইউএসএম), ইউনিভার্সিটি কেবাংসান মালয়েশিয়া (ইউকেএম), ইউনিভার্সিটি টেকনোলজি মালয়েশিয়া (ইউটিএম) এবং ইউনিভার্সিটি পুত্রা মালয়েশিয়ায় (ইউপিএম) বর্তমানে মোট শিক্ষার্থীর ২১.৩ শতাংশই আন্তর্জাতিক। এই পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৮,৩৮৮ জনে। এর মধ্যে শুধু চীন থেকেই এসেছে ৩০,৭১৪ জন। এরপর রয়েছে ইন্দোনেশিয়া (৪,১৪৫), ইরাক (২,০৯৮), বাংলাদেশ (প্রায় ১,২০০), এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে মাত্র ৯১ জন। তুলনামূলকভাবে, জাতীয় পর্যায়ে ২০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর গড় হার মাত্র ৮.৭২ শতাংশ।
বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের অবস্থান:
প্রায় ১,২০০ বাংলাদেশি শিক্ষার্থী বর্তমানে এই পাঁচটি শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করছেন, যা দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশের তরুণরা চিকিৎসা, প্রকৌশল, ব্যবসা এবং আইটি-সংক্রান্ত কোর্সে বেশি ভর্তি হচ্ছেন।
ইউএম-এ ব্যবসায় প্রশাসনের এক বাংলাদেশি শিক্ষার্থী বলছেন, ‘মালয়েশিয়ার ডিগ্রির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আছে, খরচও ইউরোপ বা অস্ট্রেলিয়ার তুলনায় অনেক কম। সেই জন্যই আমি এখানে এসেছি।’
ইউপিএম-এর কৃষি বিজ্ঞানের এক শিক্ষার্থী বলছেন, ‘এখানে গবেষণার ভালো সুযোগ আছে, তবে বিদেশি শিক্ষার্থী হিসেবে আমাদের জন্য আবাসন আর খন্ডকালীন কাজের সুযোগ সীমিত। এগুলো একটা বড় চ্যালেঞ্জ।’
ইউটিএম-এর আইটি বিভাগের শিক্ষার্থী রাশেদুল ইসলাম জানান, মালয়েশিয়ার পরিবেশ ও সংস্কৃতি আমাদের কাছাকাছি, তাই মানিয়ে নিতে সহজ। তবে টিউশন ফি এবং জীবনযাত্রার খরচ অনেকের জন্যই চাপের।
শিক্ষার্থীদের মতে, মালয়েশিয়ায় পড়াশোনার আকর্ষণ থাকলেও সীমিত বৃত্তি ও চাকরির বাজারে অনিশ্চয়তা ভবিষ্যতে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে।
বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা নিয়ে ভিন্নমত রয়েছে। ২০২৫ সালের আগস্টে বেশ কিছু সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয় যে মালয়েশিয়ায় প্রায় ১০,০০০ বাংলাদেশি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছেন। দাবি করা হয়, বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এবং মালয়েশিয়ার উচ্চশিক্ষামন্ত্রীর বৈঠকে এই সংখ্যাটি উল্লেখ করা হয়েছিল।
তবে মালয়েশিয়ার উচ্চশিক্ষা মন্ত্রণালয় এই দাবি অস্বীকার করেছে। মন্ত্রী জাম্ব্রি আবদ কাদির স্পষ্ট করে জানান, এমন কোনও সংখ্যা বা চুক্তি আলোচনায় ছিল না। স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থীদের কর্মসংস্থান নিয়ে ১০,০০০ জনকে গ্রহণের খবরকে তিনি ‘ভুল ব্যাখ্যা’ বলে উল্লেখ করেন।
অন্যদিকে, এডুকেশন মালয়েশিয়া গ্লোবাল সার্ভিসেস (ইএমজিএস) জানিয়েছে, ২০১৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে ১৩,০০০-এরও বেশি আবেদন জমা পড়ে। গ্লোবাল স্টুডেন্ট লিভিং-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, শুধু ২০২৪ সালেই বাংলাদেশ থেকে নতুন আবেদন আসে ৬,৯১৭টি।
করদাতাদের টাকায় বিদেশীদের আসন নয়:
ড. হাইম হিলম্যান প্রশ্ন তুলেছেন, সরকার বিপুল অর্থায়নে পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিদেশি শিক্ষার্থীরা কেন বেশি অগ্রাধিকার পাচ্ছে। তার ভাষায়, ‘এই সুযোগ বিদেশীদের জন্য নয়, মালয়েশিয়ানদের জন্য। করদাতাদের অর্থে পরিচালিত আসন অবশ্যই আমাদের জনগণ মালয়, চীনা, ভারতীয় কিংবা আদিবাসীদের জন্য অগ্রাধিকার পাবে।’
তিনি আরও উল্লেখ করেন, মালয়েশিয়ার জনসংখ্যায় চীনা সম্প্রদায়ের হার ২০ শতাংশ হলেও শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তাদের ভর্তি মাত্র ১৩ শতাংশ।
প্রতিযোগিতার ঝুঁকি:
ড. হাইম সতর্ক করেন, আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরা স্নাতক শেষে মালয়েশিয়ায় কাজের অনুমতি চাইতে পারে, যা শিক্ষা ও কর্মসংস্থান উভয় ক্ষেত্রেই প্রতিযোগিতা বাড়াবে। বিশেষ করে চীনের ৩০ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী স্থানীয় চাকরির বাজারে চাপ তৈরি করতে পারে বলে তার আশঙ্কা।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস প্রস্তাব করেছেন মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি স্নাতকদের কর্মসংস্থানের সুযোগ দেওয়ার, যা বাস্তবায়িত হলে সংকট আরও বাড়তে পারে।
নীতিমালা সংস্কারের আহ্বান:
এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় ড. হাইম সরকারের প্রতি তিনটি আহ্বান জানিয়েছেন। ১. প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক ভর্তির হার সর্বোচ্চ ৫%-এ সীমাবদ্ধ রাখা। ২. ভর্তি প্রক্রিয়ার স্বচ্ছ তথ্য প্রকাশ্যে আনা। ৩. ভর্তি তদন্তে একটি রাজকীয় কমিশন গঠন।
তার মতে, স্থানীয় প্রতিভা লালন এবং উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার মাধ্যমেই মালয়েশিয়ার ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করা সম্ভব।
