Logo
Logo
×

আন্তর্জাতিক

যুগান্তরকে আটক ফ্লোটিলা কর্মীদের আইনজীবী

নামাজে বাধা, জোর করে হিজাব খোলা হয় নারীদের

শামীম জোয়ার্দার

শামীম জোয়ার্দার

প্রকাশ: ০৭ অক্টোবর ২০২৫, ১০:৪৯ পিএম

নামাজে বাধা, জোর করে হিজাব খোলা হয় নারীদের

ইসরাইলের হাইফা শহরে আদালাহ’র সদর দফতরের সামনে আইনজীবী হাদিল আবু সালিহ। ছবি সৌজন্যে আদালাহ

‘গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা’র আটক অধিকারকর্মীদের নিয়ে যুগান্তরকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন ইসরাইলের আইনবিষয়ক মানবাধিকার সংস্থা আদালাহর আইনজীবী হাদিল আবু সালিহ। আটক কর্মীদের ওপর ইসরাইলি নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরেছেন তার বর্ণনায় বলেন, নেগেভ মরুভূমিতে ইসরাইলের ‘সবচেয়ে বৃহৎ ও নিকৃষ্ট’ কৎসিওত কারাগারে মানবেতর অবস্থায় রাখা হয়েছে মানবাদিকারকর্মীদের। আশদোদ বন্দর থেকে কারাগারে নেওয়ার পর আটক নারীদের জোর করে হিজাব খুলে ফেলা হয়েছে। বাধা দেওয়া হয়েছে নামাজে। বিছানা ছাড়াই ঘুমাতে দেওয়া হয় মাটিতে। ইসরাইলে হাইফা শহরে অবস্থিত আদালাহর (দ্য লিগ্যাল সেন্টার ফর আরব মাইনরিটি রাইটস ইন ইসরাইল; ইসরাইলের ফিলিস্তিনি ও আরব সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর মানবাধিকার রক্ষা ও আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা) সদর দপ্তরে যোগাযোগ করে সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন যুগান্তরের আন্তর্জাতিক বিভাগের প্রধান শামীম জোয়ার্দার

যুগান্তর: কতজন মানবাধিকারকর্মী এখনো ইসরাইলি কারাগারে বন্দি আছেন?

সালিহ: এ সম্পর্কে আদালাহকে কোনো তথ্য সরবরাহ করছে না ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ। তবে আমাদের হিসাব অনুযায়ী, সোমবার পর্যন্ত ১৩৮ জন শান্তিকর্মী এখনো ইসরাইলের হেফাজতে আছেন। মঙ্গলবার আরও কয়েকজনকে ছেড়ে দেওয়ার কথা রয়েছে। 

যুগান্তর: তাদের জাতীয়তা সম্পর্কে কি আপনার কাছে সঠিক তথ্য আছে?

সালিহ: মানবাধিকারকর্মীরা বিভিন্ন দেশের নাগরিক। তবে কারাগারে এখনো যারা আছেন, তাদের সম্পর্কে সম্পূর্ণ পরিচিতি নিশ্চিত করেনি ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ।

যুগান্তর : ইসরাইলের কোন কারাগারে তারা বন্দি?

সালিহ: বৃহস্পতিবার রাতে এবং শুক্রবার ভোরে মানবাধিকারকর্মীদের আশদোদ বন্দর থেকে ইসরাইলের মিসর সীমান্তবর্তী কৎসিওত কারাগারে স্থানান্তর করা হয়েছে। জেলখানাটি ফিলিস্তিনিদের ওপর নির্যাতনের জন্য কুখ্যাত।

যুগান্তর: সব মানবাধিকারকর্মীই কি একই কারাগারে আছেন? তারা কি কারাপোশাক পরে আছেন?

সালিহ: হ্যাঁ, সব শান্তিকর্মী একই কারাগারে আছেন এবং তাদের কারাগারের পোশাক দেওয়া হয়েছে।


যুগান্তর: কৎসিওত কারাগারে তাদের আটক অবস্থার পরিবেশ সম্পর্কে একটি বিবরণ দিন? 

সালিহ: গত কয়েকদিনে আদালাহ নথিভুক্ত করেছে, গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলার কর্মীরা ইসরাইলি বাহিনীর অবৈধ হস্তক্ষেপের ফলে গুরুতর নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ১ ও ২ অক্টোবর অবৈধভাবে তাদের আটক করে ইসরাইল। কৎসিওত কারাগারে অনুষ্ঠিত ট্রাইব্যুনাল শুনানির সময় প্রায় ৮০ জন অংশগ্রহণকারীর সাক্ষ্য অনুযায়ী, তাদের জরুরি চিকিৎসা ও ওষুধ থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছে। যার মধ্যে উচ্চরক্তচাপ, হৃদরোগ এবং ক্যানসারের মতো জীবনহানিকর রোগের প্রেসক্রিপশনও অন্তর্ভুক্ত ছিল। খাদ্য ও পানি ছিল অত্যন্ত অপর্যাপ্ত। অনেক কর্মীকে একেবারেই খাবার দেওয়া হয়নি। অনেককে আবার মাটিতে ঘুমাতে বাধ্য করা হয়েছে। চুল ধরে টানা-হেঁচড়া, শৌচাগারের পানি পানে বাধ্য করা ছাড়াও অধিকারকর্মীদের ওপর নানাবিধ শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনও করা হয়েছে। হিজাব খুলতে বাধ্য করা হয় কয়েকজন নারীকে। অন্যদের নামাজে বাধা দেওয়া হয়েছে। আইনজীবীর সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগও কঠোরভাবে সীমিত করা হয়েছে। ৮৭ জন কর্মী এখনো আদালাহর আইনজীবীর সঙ্গে দেখা করতে পারেননি। 

যুগান্তর: প্রত্যেক মানবাধিকারকর্মীই ইসরাইলি সেনাবাহিনী ও পুলিশকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের জন্য অভিযুক্ত করেছেন। এটা কতটুকু সত্য?

সালিহ: না, কারাগারে আটক সবার অভিজ্ঞতা এক নয়। তবে অনেকেই নির্যাতনের অভিযোগ করেছেন।

যুগান্তর: ইসরাইল কি গ্লোবাল ফ্লোটিলার মানবাধিকারকর্মীদের নিজেদের আইন অনুযায়ী আটক ও বিচার করেছে? ইসরাইলের এই বিচারব্যবস্থা কতটুকু সমর্থন করে আন্তর্জাতিক আইন?


সালিহ : গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা এবং এতে অংশগ্রহণকারীদের আটক আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। নিরস্ত্র মানবিক জাহাজের আন্তর্জাতিক জলসীমায় চলাচলের স্বাধীনতা রয়েছে। আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের অধীনে রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো ন্যায্য মানবিক সাহায্য কেন্দ্রে পৌঁছে দেওয়া।

চলতি বছরের জুনে জাতিসংঘের ১০ জন মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ ঘোষণা করেন, ‘গাজার মানুষের নিজস্ব জলসীমায় তাদের সাহায্য পাওয়ার অধিকার রয়েছে এবং কোয়ালিশন জাহাজগুলো আন্তর্জাতিক জলসীমায় স্বাধীনভাবে চলতে পারবে। ইসরাইলকে এই স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা যাবে না।’ 

এছাড়া ৯ সেপ্টেম্বর আরও কয়েকজন জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞ ইসরাইলকে সতর্ক করেন, গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলার ওপর কোনো হুমকি দেওয়া যাবে না এবং তাদের মানবিক সাহায্য বিতরণে বাধা দেওয়া যাবে না। আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে, আন্তর্জাতিক জলসীমায় বা ফিলিস্তিনের জলসীমায় জাহাজকে বাধা দেওয়ার বা আটকানোর কোনো এখতিয়ার ইসরাইলের নেই। গাজায় ইসরাইলের দীর্ঘদিনের অবরোধও আন্তর্জাতিকভাবে অবৈধ হিসাবে বিবেচিত। বর্তমান মানবিক সংকটে এই অবরোধ যুদ্ধাপরাধের শামিল। 

যুগান্তর: যদি ইসরাইল আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে, তার শাস্তি কী হতে পারে? ইউরোপীয় বা অন্য কোনো দেশ আইসিসিতে (আন্তর্জাতিক অপরাধ আদলত) ইসরাইলের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারবে কি? সেই দেশগুলোর মামলা করার জন্য কি কোনো আইনগত বাধা আছে? 

সালিহ: এ প্রশ্নটি আদালাহর ম্যান্ডেটের বাইরে। আমাদের কাজ মূলত ইসরাইলি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কাজ করে ফিলিস্তিনি অধিকার রক্ষা করা।

যুগান্তর: মানবাধিকারকর্মীরা দেশে ফেরার পর কি ইসরাইলের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারে?

সালিহ: এ প্রশ্নটিও আদালাহর ম্যান্ডেটের বাইরে।

যুগান্তর: বন্দি শান্তিকর্মীদের জন্য আদালাহ কী ধরনের সহায়তা দেয়? বন্দিদের মুক্তির জন্য আদালতে কী ধরনের প্রমাণ বা যুক্তি দিতে হয়? 

সালিহ: আমরা পুরো প্রক্রিয়ায় আইনগত সহায়তা দিই। আমরা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করি যাতে কারাগারের পরিস্থিতি আইনগত মান এবং মানবাধিকার নীতিমালা অনুযায়ী থাকে। যেমন : জরুরি চিকিৎসা, বিশুদ্ধ পানীয়সহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসের অ্যাক্সেস (প্রবেশ) নিশ্চিত করা। পাশাপাশি আমরা তাদের দ্রুত মুক্তি নিশ্চিত করার জন্যও কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কার্যকরভাবে কাজ করি।


যুগান্তর: আমরা শুনেছি ইসরাইল বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বন্দিদের সঙ্গে দেখা করতে দেয়নি আদালাহকে এবং কেন?

সালিহ: এখানে প্রক্রিয়াগত লঙ্ঘন ঘটেছে। যেমন আইনজীবীর সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ সীমিত রাখা হয়েছে। আদালাহ আশদোদ বন্দরে ৩৩১ জন কর্মীকে এবং কারাগারে প্রায় ১০০ জনের সঙ্গে দেখা করেছে। তবে অধিকাংশ শুনানিতে আইনজীবীর উপস্থিতি নিশ্চিত করা হয়নি এবং সাক্ষাতের অধিকারের সুযোগ অত্যন্ত সীমিত ছিল।

যুগান্তর: আদালাহ কি একা দেখা করতে পারে? নাকি পুলিশ/সেনা তত্ত্বাবধানে দেখা করতে হয়? দেখা করার নির্দিষ্ট সময়সীমা আছে কি?

সালিহ: সাক্ষাতের সময় সাধারণত খুব সংক্ষিপ্ত। প্রায় ৫ মিনিট এবং গোপন বা ব্যক্তিগত পরিবেশে হয়নি। কারাগারে বন্দিদের সাক্ষাৎকারও একইভাবে গোপনীয় বা দীর্ঘ সময়ের ছিল না। 

যুগান্তর: কর্মীদের ফেরত পাঠানোর সময় বিমান ভাড়ার খরচ কে বহন করে?

সালিহ: ইসরাইল যখন মানবাদিকারকর্মীদের নিজ দেশে পাঠায়, তখন বিমান ভাড়া কে বহন করবে, তা নির্ভর করে ইসরাইল ও সংশ্লিষ্ট তৃতীয় দেশের মধ্যে সমঝোতার ওপর। কিছু ক্ষেত্রে বিদেশি সরকার যেমন তুরস্ক ও গ্রিস এই খরচ বহন করেছে।

যুগান্তর: আপনি কি জানেন পরবর্তী মানবাধিকারকর্মীদের কবে মুক্তি দেওয়া হবে?

সালিহ: আশা করা হচ্ছে কয়েকদিনের মধ্যে বাকি সবাই মুক্তি পাবেন।

যুগান্তর: মূল্যবান সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। 

সালিহ: ধন্যবাদ আপনাকেও।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম