মারওয়ান বারঘুতি: বিভক্ত ফিলিস্তিনিদের ঐক্যবদ্ধ করতে পারেন যে ব্যক্তি
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ০১ নভেম্বর ২০২৫, ০৬:৪২ পিএম
ফিলিস্তিনি নেতা মারওয়ান বারঘুতি। ফাইল ছবি
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ইতিহাস গঠনে ব্যক্তির ভূমিকা নিয়ে নানা তত্ত্ব রয়েছে। তবে রুশ দার্শনিক জর্জি প্লেখানভই সবচেয়ে কার্যকরভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন কিভাবে ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া ও ব্যক্তির প্রভাব একে অপরের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করে।
আজ সেই ভারসাম্যের প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে ফিলিস্তিনি নেতা মারওয়ান বারঘুতির ক্ষেত্রে, যার মুক্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রকাশ্যে আগ্রহ দেখিয়েছেন।
এ নিয়ে এক বিশ্লেষণমূলক নিবন্ধ প্রকাশ করেছে মিডল ইস্ট আই।
ট্রাম্পের মন্তব্যে আবারও আলোচনায় উঠে এসেছে বারঘুতির ভূমিকা—যিনি দীর্ঘদিন ধরে ফিলিস্তিনি রাজনীতিতে ঐক্য ও নেতৃত্বের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত।
দুই দশক আগে মাহমুদ আব্বাসের জয়ে শেষ হওয়া প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বারঘুতি প্রার্থী ছিলেন, তবে সহকর্মীদের পরামর্শে সরে দাঁড়ান। ২০২১ সালের নির্বাচনেও তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ভোট বাতিল করা হয়। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, তার জয় আশঙ্কা করেই ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ ভোট স্থগিত করেছিল।
ঐক্যের প্রতীক বারঘুতি
বারঘুতি শুধু একজন বন্দি নন; জীবনের এক-তৃতীয়াংশ কারাগারে কাটালেও তিনি ফিলিস্তিনি রাজনীতিতে এক অনন্য অবস্থান গড়ে তুলেছেন। বহু বছরের বন্দিজীবন সত্ত্বেও তিনি ফিলিস্তিনিদের ঐক্যের প্রতীক হয়ে উঠেছেন—যেখানে বিভাজনই রাজনীতির প্রধান বাস্তবতা।
তার নৈতিক দৃঢ়তা, আজীবন সংগ্রাম ও বুদ্ধিবৃত্তিক গভীরতা তাকে এমন এক নেতায় পরিণত করেছে, যিনি মুক্তি ও ন্যায়ের প্রশ্নে বাস্তবতার সঙ্গে আদর্শের সমন্বয় ঘটাতে জানেন।

বারঘুতি বলেছিলেন, ‘স্বদেশ একটি চিরন্তন মূল্যবোধ, আর রাষ্ট্র হলো তার রাজনৈতিক প্রকাশ। একাধিক পরিচয় একসঙ্গে ধারণ করা সম্ভব—আমাদের জনগণকে সেটা শেখাতে হবে।’
এই দৃষ্টিভঙ্গিই তাকে ‘ফিলিস্তিনি ম্যান্ডেলা’ হিসেবে খ্যাতি এনে দিয়েছে। যেমনভাবে ইয়াসির আরাফাতের মাথায় থাকা কেফিয়াহ ফিলিস্তিনি পরিচয়ের প্রতীক হয়েছিল, তেমনি বারঘুতি আজ প্রতিরোধ ও শান্তির সমন্বয়ের প্রতীক।
শান্তি ও প্রতিরোধ—দুই ধারার সংমিশ্রণ
বারঘুতি এমন এক নেতা, যিনি ন্যায়সঙ্গত শান্তির জন্য লড়তে জানেন, আবার দমন-নিপীড়নের সময় প্রতিরোধের নেতৃত্ব দিতেও পিছপা হন না। অসলো চুক্তির মাধ্যমে যেমন তিনি শান্তির সম্ভাবনা দেখেছিলেন, তেমনি আশা ভঙ্গ হলে নেতৃত্ব দেন দ্বিতীয় ইন্তিফাদার।
রাজনৈতিকভাবে তিনি একমাত্র ব্যক্তি, যিনি আরাফাতের মতোই ফিলিস্তিনিদের এক রাজনৈতিক পথের পেছনে ঐক্যবদ্ধ করতে পারেন।

বিভক্ত রাজনীতির মাঝে ঈর্ষা
দীর্ঘ বন্দিজীবনেও বারঘুতি মানুষের আস্থা ও আশা জাগিয়ে রেখেছেন। কিন্তু তাঁর জনপ্রিয়তা অনেক নেতার মধ্যে ঈর্ষা তৈরি করেছে। ২০১৭ সালে তিনি ও তার সহবন্দিরা যে অনশন কর্মসূচি শুরু করেছিলেন, সেটির বিরোধিতাও এসেছিল ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের কিছু অংশ থেকে।
সহবন্দি আবদেলকাদের বাদাউই, যিনি বারঘুতির কাছেই উচ্চশিক্ষা নিয়েছিলেন, বলেন, ‘কিছু নেতা সক্রিয়ভাবে তার মুক্তি ঠেকানোর চেষ্টা করেছেন, কারণ তাঁকে তারা কখনো টেক্কা দিতে পারবে না।’
ইসরাইলের আশঙ্কা
বারঘুতির মুক্তি নিয়ে ইসরাইলের কট্টর ডানপন্থিরা আপসহীন। তাদের আশঙ্কা—বারঘুতি মুক্ত হলে ফিলিস্তিনের অভ্যন্তরীণ বিভাজন কমে যাবে, যা ইসরাইল দীর্ঘদিন ধরে বজায় রাখতে চায়।
বিশ্লেষকদের মতে, নেতানিয়াহুর সরকার দুই দশক ধরে ফিলিস্তিনি রাজনীতিকে বিভক্ত রাখার কৌশল নিয়েছে। কারণ ঐক্যবদ্ধ ফিলিস্তিন মানেই ইসরাইলের জন্য শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ।
কিন্তু ইসরাইল যা বুঝতে পারছে না, তা হলো—এই বিভাজন আরও গভীর হলে অগণিত অসংগঠিত সশস্ত্র গোষ্ঠী তৈরি হবে, যারা কোনো রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই সহিংসতায় জড়াবে।
শান্তির সম্ভাবনা
এই প্রেক্ষাপটে বারঘুতির মতো একজন ঐক্যবদ্ধকারী নেতার মুক্তি কেবল ফিলিস্তিনের নয়, বরং ইসরাইল ও গোটা অঞ্চলের শান্তির জন্যও প্রয়োজন হতে পারে।
যেমন আরাফাতের সময় তার নেতৃত্বই ছিল শান্তি আলোচনার একমাত্র পথ, তেমনি এখন বারঘুতি সেই ভূমিকা নিতে পারেন।
তার অব্যাহত বন্দিজীবন শুধু ফিলিস্তিনিদের ক্ষতি নয়, বরং মধ্যপ্রাচ্যে স্থায়ী শান্তি ও স্থিতিশীলতার পথে এক বড় বাধা হয়ে থাকবে।
