Logo
Logo
×

আন্তর্জাতিক

যে কারণে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো ভূমিকম্পপ্রবণ

Icon

বিবিসি বাংলা

প্রকাশ: ০৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৩:৪৬ পিএম

যে কারণে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো ভূমিকম্পপ্রবণ

ফাইল ছবি।

চলতি মাসের ৪ তারিখ সকালে ঢাকাসহ আশপাশের এলাকায় আবারও ভূমিকম্প অনুভূত হয়। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল চার দশমিক এক, যা এর আগের ভূমিকম্পের তুলনায় কিছুটা হালকা মাত্রার। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সকাল ৬টা ১৪ মিনিট ৪৫ সেকেন্ডে এ ভূমিকম্প হয়, যার উৎপত্তিস্থল ছিল নরসিংদীর শিবপুরে।

ঢাকার আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা কেন্দ্র থেকে ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থলের দূরত্ব ছিল ৩৮ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে।

ইউরো-মেডিটেরিয়ান সিসমোলজিক্যাল সেন্টারের তথ্যানুযায়ী, ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল গাজীপুরের টঙ্গী থেকে ৩৩ কিলোমিটার উত্তর-উত্তরপূর্বে এবং নরসিংদী থেকে তিন কিলোমিটার উত্তরে এবং এর গভীরতা ছিল ৩০ কিলোমিটার।

তবে বাংলাদেশের ইতিহাসে ঘটে যাওয়া সবচেয়ে বড় ভূমিকম্পটি হয় ২১ নভেম্বর। রিখটার স্কেলে পাঁচ দশমিক সাত মাত্রার এই ভূমিকম্পে সারা দেশ কেঁপে উঠেছিল সেদিন। এতে ১০ জন নিহত হওয়ার পাশাপাশি বহু মানুষ আহত হন এবং অনেক ভবন ও স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর পরের ৩১ ঘণ্টার মধ্যে ঢাকায় এবং আশপাশে আরো চারবার ভূমিকম্প হয়েছে।

২৭ নভেম্বর বিকেল ৪টা ১৫ মিনিট ঢাকায় চার মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এর উৎপত্তিস্থল ছিল নরসিংদীর টঙ্গীতে। ওই দিন ভোরে সিলেট ও কক্সবাজারের টেকনাফে দুই দফা কম্পন অনুভূত হয়।

এ ছাড়া ২ ডিসেম্বর সোমবার রাত ১২টা ৫৫ মিনিটে বাংলাদেশের দক্ষিণে চট্টগ্রাম জেলায় চার দশমিক নয় মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়। ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল ছিল মায়ানমারের মিনজিনে। চট্টগ্রামসহ পার্শ্ববর্তী এলাকায় এই কম্পন অনুভূত হয়। 

সম্প্রতি আফগানিস্তানেও দুই দফার ভূমিকম্পে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সবশেষ গত নভেম্বরে আফগানিস্তানের উত্তরাঞ্চল, মাজার-ই-শরীফের কাছে একটি শক্তিশালী ছয় দশমিক তিন মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়।

এর দুই মাস আগে পূর্ব আফগানিস্তানে ছয় মাত্রার ভূমিকম্পে ২,২০০-এর বেশি মানুষ নিহত হন। যা দেশটির সাম্প্রতিক ইতিহাসের অন্যতম প্রাণঘাতী ভূমিকম্প হিসেবে রেকর্ড হয়েছে।

এই সময়ের মধ্যে আরো কয়েকটি হামলা ও মাঝারি মাত্রার কম্পন অনুভব করেছেন দেশটির মানুষ। এই পরপর দুর্যোগগুলো আবারও একটি বিষয় স্পষ্ট করেছে যে এই অঞ্চল ভূমিকম্পের প্রতি কতটা সংবেদনশীল। দক্ষিণ এশিয়াকে বিশ্বের অন্যতম ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল হিসেবে সবসময়ই চিহ্নিত করা হয়েছে।

দক্ষিণ এশিয়ায় এত ঘন ঘন ভূমিকম্প কেন হয়?

এক দশক আগে ২০১৫ সালের নেপাল ভূমিকম্পে প্রায় নয় হাজার মানুষ নিহত হন এবং ২০২৫ সালের মার্চে মায়ানমারে সাত দশমিক সাত মাত্রার ভূমিকম্পে তিন হাজারের বেশি মানুষ মারা যায়। এই অঞ্চলে শুধু গত এক দশকে বেশ কয়েকটি প্রাণঘাতী ভূমিকম্প হয়েছে, যাতে প্রাণহানি এবং ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও কম নয়। কিন্তু এমনটা কেন হয়? দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো কি ভূমিকম্পপ্রবণ?

এর উত্তর লুকিয়ে আছে এই অঞ্চলের ভূপৃষ্ঠের অনেক অনেক গভীরে— যেখানে রয়েছে জটিল টেকটোনিক প্লেটের বিন্যাস। এই প্লেটগুলো ক্রমাগত সরতে থাকায় বারবার ভূমিকম্প হয়। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো বহু টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থিত। যেমন ভারতীয় প্লেট, ইউরেশিয়ান প্লেট, ইন্দো-অস্ট্রেলিয়ান প্লেট, সুন্দা প্লেট, বার্মিজ প্লেট এবং প্যাসিফিক প্লেট।

ভারতীয় প্লেট প্রতি বছর প্রায় পাঁচ সেন্টিমিটার করে উত্তর দিকে সরছে এবং ইউরেশিয়ান প্লেটের সঙ্গে ধাক্কা খাচ্ছে। এমন সংঘর্ষ থেকেই যেমন এক সময় হিমালয় পর্বতমালার সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি এখন প্রচণ্ড ভূ-ভৌগোলিক চাপ সৃষ্টি করছে এবং প্রাচীন ফল্ট লাইনগুলোকে পুনরায় সক্রিয় করে তুলছে।

দক্ষিণ এশিয়ায় ভূমিকম্প এত বিধ্বংসী কেন?

দক্ষিণ এশিয়ার ভৌগোলিক রূপ বেশ জটিল। এখানে আছে উঁচু উঁচু পাহাড় ও গভীর উপত্যকা, সেইসঙ্গে আছে নরম পলি বা বালুকাময় মাটি, বিশেষ করে ভারত ও বাংলাদেশে। এই ভৌগোলিক রূপ ভূমিকম্পের তীব্রতা আরো বাড়িয়ে দেয়।

এ অঞ্চলে টেকটোনিক প্লেটগুলোর অবস্থানও অগভীর ভূমিকম্পের সৃষ্টি করে, যা আরো বেশি ধ্বংসাত্মক, কারণ এতে বিস্তৃত এলাকার পৃষ্ঠ তীব্রভাবে কেঁপে ওঠে। এছাড়া এই অঞ্চলের বেশিরভাগ ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা ঘনবসতি হওয়ায় হতাহতের সংখ্যাও বেশি হয়।

কাবুল, ইসলামাবাদ, দিল্লি, কাঠমান্ডু এবং ঢাকার মতো বড় শহরগুলোর অবস্থান মূল ফল্ট সিস্টেমের কাছাকাছি হওয়ায় এখানকার কোটি কোটি মানুষ ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্যে বসবাস করছে। দ্রুত নগরায়ন এবং নিরাপত্তা মানদণ্ড না মেনে করা নির্মাণকাজও এ অঞ্চলের ভবন ও স্থাপনাগুলোকে বিপজ্জনক করে তুলেছে।

উদাহরণস্বরূপ, আফগানিস্তানের গ্রামীণ অঞ্চলের অধিকাংশ বাড়ি কেবল মাটি ও পাথরের তৈরি, ফলে মধ্যম মাত্রার ভূমিকম্পেও বহু মানুষ হতাহত হয়।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর কেমন পরিস্থিতি?

ভারতে বেশ কয়েকটি সক্রিয় ফল্ট সিস্টেম রয়েছে এবং সেখানে ইন্ট্রাপ্লেট ভূমিকম্প অর্থাৎ একটি টেকটোনিক প্লেটের মধ্যে যে ভূমিকম্প হয়, তাও অনুভূত হয়েছে, যা অনেক সময় প্রাচীন ফল্ট লাইনের পুনরায় সক্রিয় হওয়ার কারণে ঘটে।

ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় দ্রুত নারায়ণও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরো বাড়ি দিয়েছে। বাংলাদেশও একাধিক ফল্ট লাইনের ওপর অবস্থিত, যেমন ডাউকি ফল্ট, সিলেট ফল্ট এবং চেরদাং ফল্ট, যেগুলো সাম্প্রতিক সময়ে সক্রিয় হয়েছে এবং ভূমিকম্প দেখা যাচ্ছে।

তবে দক্ষিণ এশিয়ার ভৌগোলিক অবস্থান ঝুঁকি আরো বাড়িয়ে দিয়েছে এবং ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগের ক্ষেত্রে সংবেদনশীল করে তুলেছে, কারণ বিশ্বের সবচেয়ে বড় নদী ডেল্টা, সুন্দরবন ডেল্টা বাংলাদেশের বিশাল এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। পাকিস্তানেও বেশ কিছু প্রধান ফল্ট লাইন রয়েছে, যেমন চামান ফল্ট এবং মেইন ম্যান্টল থ্রাস্ট বিশেষভাবে সক্রিয়।

খাইবার পাখতুনখাওয়া, গিলগিত-বালতিস্তান এবং বেলুচিস্তানে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গভীর এবং অগভীর—উভয় ধরনের ভূমিকম্প হয়েছে। তবে ২০০৫ সালে কাশ্মীরে সাত দশমিক ছয় মাত্রার ভূমিকম্পটি এ অঞ্চলের সবচেয়ে ভয়াবহ ছিল, যেখানে ৮০ হাজারেরও বেশি মানুষ মারা যায়। পাকিস্তানেও বেশ কয়েকটি প্রধান ফল্ট রয়েছে বিশেষত চামান ফল্ট এবং মেইন মান্টল থ্রাস্ট সক্রিয়। তবে, দক্ষিণ এশিয়ায় ভয়াবহ ভূমিকম্পের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে নেপালে।

কারণ দেশটি সরাসরি ভারতীয় প্লেট ও ইউরেশিয়ান প্লেটের সংঘর্ষসীমার ওপর অবস্থিত এবং এখানে বড় বড় ফল্ট সিস্টেম রয়েছে। এখানকার পাহাড়ি ভূপ্রকৃতি ভূমিধস এবং হিমবাহ হ্রদ উপচে বন্যার ঝুঁকি আরো বাড়িয়ে দেয়।

সময়ের সঙ্গে কি পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে?

মানুষ ও পরিবেশগত কারণ, সেইসঙ্গে এ অঞ্চলের অনন্য ভূতাত্ত্বিক গঠন মিলিয়ে ভবিষ্যতে দক্ষিণ এশিয়ায় তীব্র ভূমিকম্পের আশঙ্কা রয়েছে, যেখানে ধ্বংসযজ্ঞ ভয়াবহ হতে পারে।

শত শত বছর ধরে জমে থাকা টেকটোনিক চাপ বড় এবং আরো শক্তিশালী ভূমিকম্পের সৃষ্টি করতে পারে। যদিও প্যাসিফিক রিং অব ফায়ার অঞ্চলের দেশগুলোতে ভূমিকম্প বেশি হয় এবং সেগুলো শক্তিশালী মাত্রার হয়। তবু হিমালয় অঞ্চল শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সঞ্চিত প্রচণ্ড টেকটোনিক চাপের কারণে সবচেয়ে বিপজ্জনক ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলের একটি।

বিজ্ঞানীরা সতর্ক করেছেন যে নেপাল, ভারত, ভুটান এবং পাকিস্তানজুড়ে বিস্তৃত হিমালয় অঞ্চলে আট বা তার বেশি মাত্রার ‘বড় হিমালয়ান ভূমিকম্প’ হতে পারে। প্রাচীন এবং নিষ্ক্রিয় ফল্ট লাইনগুলোর পুনরায় সক্রিয় হয়ে ওঠাও ভূমিকম্পের প্রবণতাকে আরো বাড়িয়ে তুলছে, যা প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম