Logo
Logo
×

আন্তর্জাতিক

এবিসি নিউজের বিশ্লেষণ

সম্ভাব্য পরমাণু যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে কাশ্মীরিরা!

Icon

ওমর লতিফ মিসগার

প্রকাশ: ০৯ মার্চ ২০১৯, ০৬:২৩ এএম

সম্ভাব্য পরমাণু যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে কাশ্মীরিরা!

ছবি: এএফপি

ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে যখন আদিল ধর বিস্ফোরক বোঝাই একটি যান সেনাবাহিনীর গাড়িবহরে উঠিয়ে দিয়েছিলেন, তখন সেই খবরকে আমি তেমন একটা গুরুত্ব দিইনি।

সে সময় আমি উত্তর ভারতে যাচ্ছিলাম। সংঘাতকবলিত একটি রাজ্যে জন্ম ও বেড়ে ওঠা প্রতিটি তরুণ কাশ্মীরির জীবনকে সংজ্ঞায়িত করলে যা দাঁড়ায়, তা হচ্ছে- সামরিক রক্ষাব্যূহ, বন্দুকযুদ্ধ, কারফিউ, বিস্ফোরণে বসতবাড়ি উড়ে যাওয়া। এছাড়া আমাদের বন্ধু, স্বজন ও পরিচিতদের অঙ্গহানি ও নিহত হওয়ার ঘটনা অহরহ।

কিন্তু ২২ বছর বয়সী কাশ্মীরি তরুণ আদিলের এ হামলার বিশালতা কেবল সংখ্যা ও ছবি দিয়েই আমার ভেতরে আতঙ্কের জন্ম দিয়েছে। ১৯৮০’র দশকে কাশ্মীরে সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু হলে ভারতীয় বাহিনীর ওপর এটা ছিল সবচেয়ে বড় আঘাত।

হামলায় একটি আধাসামরিক বাহিনীর ৪৪ জওয়ান নিহত হয়েছেন। এর পরে একটার পর একটা ঘটনার ধারাবাহিকতা দক্ষিণ এশিয়ার দুই প্রতিবেশী দেশকে সর্বাত্মক পরমাণু যুদ্ধের কিনারে নিয়ে যাচ্ছে।

হামলার ঘটনার পর থেকে ভারতীয় গণমাধ্যম কাশ্মীরের বেসামরিক লোকজনের বিরুদ্ধে উত্তেজনা বাড়িয়ে তুলছে। ভূস্বর্গ বলে খ্যাত উপত্যকাটির লোকজনকে দানবীয় হিসেবে তুলে ধরতে দ্বিগুণ শক্তি খরচ করা হচ্ছে।

কাশ্মীরি বেসামরিক লোকজন, শিক্ষার্থী ও অস্থায়ী ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ক্ষোভে জ্বলছে গোটা ভারত। দেশটির বিভিন্ন রাজ্যে তারা হামলা ও মারধরের শিকার হচ্ছেন। এছাড়া দুই হাজারের মতো কাশ্মীরিকে বিভিন্ন শহর থেকে পালিয়ে চলে যেতে বাধ্য করা হয়েছে।

ভারতীয়দের ক্ষোভের সরাসরি শিকার আমি নিজেও হয়েছি। এক ভারতীয় মুদি দোকানি প্রথমে ভেবেছিলেন, আমি কাশ্মীর থেকে আসিনি। কয়েকটি শিশু পটেটো শিপস কিনতে আসলে তিনি আমার কাছে কাশ্মীরি ক্রেতাদের নিয়ে নিজের ক্ষোভ ঝাড়ছিলেন।

এরপরে যখন বুঝতে পেরেছেন, আমি তার পক্ষে না, তখনই বিব্রতকরভাবে নিজের কথার মোড় অন্যদিকে নিয়ে গেলেন দোকানি।

‘আমি কখনোই এতটা হুমকি অনুভব করিনি’

একজন শিক্ষার্থী হিসেবে আমি ভারতে বসবাস করেছি। এছাড়া ভারতজুড়ে আমি ভ্রমণ করেছি। কিন্তু পুলওয়ামা হামলার পর কাশ্মীরিদের বিরুদ্ধে যতটা আতঙ্ক ছড়ানো হয়েছে, এর আগে আমি কখনোই এতটা হুমকি অনুভব করিনি।

ভারতীয় রাজনীতির মতোই গণমাধ্যমও কাশ্মীরিদের মানবিক অধিকার নাই করে দিয়েছে। কাশ্মীরিদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়িয়ে তাদের অমানবিক করে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। ভারতীয়রা তাদের অবমূল্যায়িত ও তুচ্ছ বলে গণ্য করছে।

ভারতীয় পার্লামেন্টের বিরোধী দল কংগ্রেস উপমহাদেশে ঔপনিবেশিকবিরোধী লড়াইয়ের শেকরের মধ্যে এটার উৎস খুঁজে পেলেও কাশ্মীরিদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ প্রচারের বিরুদ্ধে একটি কথা উচ্চারণের সাহস করেনি। 

গণমাধ্যমের মূলস্রোতের ভেতর নির্বাচনী বিরূপ প্রতিক্রিয়ার ভয়েই তারা এমন আচরণ করছে।

আদিল ধরের হামলার পর বিশ্বের সর্বোচ্চ সামরিক ব্যূহে ঘেরা একটি মহাসড়ক দিয়ে কীভাবে এই বিপুল বিস্ফোরক পরিবহন করা হয়েছে, তা নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলেনি ভারতীয় গণমাধ্যম। কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে হামলার পুরো দায় প্রতিবেশী পাকিস্তানের ওপর চাপাতে বিলম্ব করেনি।

যদিও এখানে গোপনীয় কিছু নেই যে ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে অস্ত্রসরবরাহ ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বিদ্রোহীদের পৃষ্ঠপোষকতা করছে পাকিস্তান। 

কিন্তু ভারতের অধিকাংশ রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কাশ্মীরে কাজ করা সাবেক সেনাকর্মকর্তারা বলছেন, সেখানকার অধিকাংশ বিদ্রোহী স্থানীয়ভাবেই তৈরি হয়েছে। কাঠামোগত হতাশা থেকেই তারা বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে।

গত দুই দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ উত্তেজনা

আদিল ধরের বাবা-মায়ের সাক্ষ্য থেকে জানা গেছে, ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে অমর্যাদাকরভাবে মুখোমুখি হওয়ার পর এই কিশোর বিচ্ছিন্নতাবাদে যোগ দেন।

একদিন বাড়িতে ফেরার পথে আটক করার পর তাকে যাচ্ছেতাইভাবে জেরা করা হয়। এরপর উপুড় হয়ে মাটিতে তার নাক ঘঁষতে বাধ্য করা হয়েছিল। কাশ্মীরের সংস্কৃতিতে যেটা খুবই অপমানজনক কাজ।

ভারতের জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে আর মাত্র কয়েক সপ্তাহ পরেই। এখন ক্ষমতাসীন উগ্র হিন্দুত্ববাদী দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) আলোচনার মধ্যমনি হয়ে থাকতে চাচ্ছে। পাকিস্তানের ভূখণ্ডে বিমান হামলা চালিয়ে নিজের সমর্থকদের শান্ত রাখার কথা ভেবেছিল বিজেপি। 

জবাবে পাকিস্তানের বিমানবাহিনীও ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে বিমান হামলা চালিয়েছে। শুধু তাই না, পাকিস্তানের আকাশে ঢুকে পড়া ভারতীয় একটি যুদ্ধবিমান গুলি করে ভূপাতিত করে সেটির পাইলটকে আটক করেছে।

চারদিকে কেবল আতঙ্ক আর শঙ্কা

একজন সাংবাদিক হিসেবে যুদ্ধকবলিত সুদূর সিরিয়া নিয়ে লিখতে লিখতে আমার মাথায় হঠাৎ একটা চিন্তা খেলে গেল যে যুদ্ধবিমানের প্রচণ্ড শব্দে গভীর রাতে ঘুম ভেঙে যাওয়ার পর বেসামরিক লোকজন ও তাদের সন্তানদের মুখে সারা রাত সজাগ থাকার মর্মবেদনার কথা শুনেছি। কিন্তু এখন আমার জন্মস্থানেই যুদ্ধ এসে হানা দিয়েছে।

এটা ঠিক যে শঙ্কাগ্রস্ত বহু কাশ্মীরিরা যুদ্ধকালীন প্রয়োজনীয় রসদ, খাবার ও জ্বালানি মজুদ করা শুরু করেছেন। এতে সেখানে সরবরাহের একটা মারাত্মক সংকট তৈরি হয়ে গেছে। কাশ্মীরের স্থানীয় সরকারও কর্মকর্তাদের খাবার বিতরণের নির্দেশ দিয়েছে এবং যেকোনো সম্ভাব্য ঘটনার জন্য হাসপাতালগুলোকে প্রস্তুত থাকতে বলেছে।

তবে এ শঙ্কা ও ভয়ের পরিবেশের মধ্যে কাশ্মীরের লোকজন রসিকতাও করছেন। মজা করে তারা বলছেন, যখন একটি পরমাণু ধ্বংসযজ্ঞ এসে দিগন্তে হাজির, তখন সবাই চা ও জ্বালানি মজুদে ব্যস্ত।

যুদ্ধউন্মাদনার মধ্যেও ভারতশাসিত কাশ্মীরে ভিন্নমতের ওপর সরকারের দমনপীড়ন উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ছে। উপত্যকাটিতে তিন শতাধিক লোককে বিনাবিচারে আটক রাখা হয়েছে। বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বাড়িঘরে ভারতীয় সন্ত্রাসবিরোধী বাহিনীর অভিযান চালাচ্ছে।

আসন্ন আঞ্চলিক নির্বাচনে লজ্জাজনকভাবে সর্বনিম্ন ভোট পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমর্থন দেয়ায় ভারত সরকার ইতিমধ্যে জামায়াত-ই-ইসলামিকে নিষিদ্ধ করেছে। দলটিকে কাশ্মীরের সবচেয়ে বড় সামাজিক-ধর্মীয় সংগঠন হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।

কাশ্মীরজুড়ে সংগঠনটি শত শত বিনামূল্যের স্কুল ও এতিমখানা পরিচালনা করে। স্থানীয় রাজনৈতিক দলগুলোও এই নিষিদ্ধের বিরোধিতা করেছে। তাদের যুক্তি, দলটিকে নিষিদ্ধ করায় তারা আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যেতে পারেন। এতে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা আরও শক্তিশালী হবে।

জামায়াত-পরিচালিত বেশ কিছু স্কুল, অফিস বন্ধ ঘোষণা এবং তাদের বহু কর্মীর বাড়ি সিলগালা করা হয়েছে।

সবচেয়ে প্রাণঘাতী দশক

পাক-ভারত উত্তেজনা আস্তে আস্তে প্রশমিত হলেও কাশ্মীরিদের নিহত হওয়ার ঘটনা বাড়ছে। গত এক দশকের মধ্যে গত বছর ছিল সবচেয়ে প্রাণঘাতী। চলতি বছরটিতেও ধ্বংসের মেঘ এসে জড়ো হচ্ছে।

সীমান্তে বন্দুকযুদ্ধ ও গোলায় গত সপ্তাহে ১৫ জন নিহত হয়েছেন। যাদের মধ্যে আটজন বেসামরিক। কাশ্মীরিদের দুর্দশার প্রতি বিশ্বের নজর নেই। আমাদের ভূমি, আমাদের আকাশ এবং আমাদের শরীর সহিংস লড়াই ও ভোটের রাজনীতির দেনদরবারের কেন্দ্র হয়ে থাকবে।

ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ওমর লতিফ মিসগারের লেখাটি এবিসি নিউজ থেকে অনূদিত

কাশ্মীর!

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম