কীভাবে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন সুলতান আব্দুল হামিদ?

সরোয়ার আলম, আঙ্কারা, তুরস্ক থেকে
প্রকাশ: ১০ জুলাই ২০২১, ১২:১৪ পিএম

আমাদের যেমন বাংলা বিহার উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব ছিলেন সিরাজুদ্দোউলা অটোম্যান সম্রাজ্যেরও শেষ স্বাধীন সুলতান ছিলেন আব্দুল হামিদ খান। তিনি ছিলেন যেমন বিচক্ষণ, তেমন কৌশলী এবং তেমনই আপসহীন এক নেতা।
তার সময়ে তিনি উসমানীয় শাসন ব্যবস্থায় প্রচুর সংস্কার নিয়ে আসেন। তিনি মনে করতেন তুর্কিদের তথা উসমানিয়দের ইউরোপ থেকে উচ্চশিক্ষিত হয়ে তাদের প্রযুক্তিগত উন্নয়ন থেকে লাভবান হওয়া দরকার। সে লক্ষ্যেই তিনি মেধাবী তুর্কিদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য ফ্রান্স, ব্রিটেনসহ অন্যান্য ইউরোপীয় দেশে পাঠান। এছাড়াও সরকারের অনেক বড় বড় আমলা এবং কূটনীতিবিদদের আরও বেশি ট্রেনিং নিতে ইউরোপ পাঠানো শুরু করেন।
কিন্তু ওই শিক্ষার্থী এবং কূটনীতিবিদের একটা অংশ তখন অটোম্যান সম্রাজ্যকে আধুনিকীকরণ, ওসমানীয়দের অধীনে বসবাসকারী বিদেশী, সংখ্যালঘু এবং বিধর্মীদের আরও বেশি সুযোগ সুবিধা দেয়া এবং গণতন্ত্র নিয়ে আসার লক্ষ্যে গোপন একটা সংগঠন তৈরি করেন। তাদের নেতৃত্বে মূলত ছিলেন কুর্দি, আলবেনিয়ান, আর্মেনিয়ান, আরব এবং বলকান বংশোদ্ভূত লোকজন; যারা উসমানীয় শাসন ব্যবস্থায় অনেক বড় বড় পদে ছিলেন।
একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তারা গোপনে সালতানাতের বিরুদ্ধে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করে। অল্প সময়ের মধ্যেই তারা বড় একটা সংগঠনে রূপ নেয়।
এদিকে ফ্রান্স এবং ব্রিটেন তখন অটোমান সম্রাজ্যকে ভাঙার এবং নিজেদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারার বিস্তারিত প্লান করতে থাকে। একদিকে সরকার মধ্য থেকে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা সালতানাত বিরোধী একটি গ্রুপ, অন্য দিকে ইউরোপ থেকে উসমানীয়কে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাওয়ার প্লান।
সুলতান এ অবস্থা টের পান এবং বিদেশে থাকা ‘তরুণ তুর্কি’ নামে এই গোপন সংগঠনটির অনেক সদস্যকে দেশে ফিরিয়ে আনেন। সরকারের বিভিন্ন পদে তাদেরকে স্থান দিয়ে নিজের নজরদারিতে রাখেন। কিন্তু তাদের একটা অংশ গোপনে গোপনে সংগঠিত হওয়ার কাজ চালিয়ে যেতে থাকে। আর তারা আবারো সুসংগঠিত হয়।
সরকারের মধ্যের বড় বড় পাশা, উজির, নাজিরসহ অনেকেই তাদের দলে যোগ দেয়। সুলতানকে আরও বেশি ডেমক্র্যাসি নিয়ে আসার জন্য চাপ দিতে থাকে। দেশে বিদেশে বিভিন্ন জায়গায় তারা অটোম্যান তুর্কি, ফরাসি, ইতালি, ইংরেজি ভাষায় পত্রিকা চালু করে। ব্রিটেন, ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া, বুলগেরিয়া, ইতালি, গ্রীস, রোমানিয়া, সুইজারল্যান্ড, ব্রাজিল, বেলজিয়াম, আমেরিকা এবং সাইপ্রাস সহ প্রায় ১৩ টি দেশে ১৫২টিরও বেশি সংবাদপত্র বের করেন এই তরুণ তুর্কিরা। উদ্দেশ্য তাদের পক্ষে দেশে এবং বিদেশে জনমত গড়ে তোলা।
ইউরোপে শিক্ষা গ্রহণ করা অনেক বুদ্ধিজীবীর লেখা তখন এসব পত্রিকায় ছাপানো হয় এবং এগুলো এই "তরুণ তুর্কি"দের পক্ষে জনমত গড়তে প্রচুর প্রোপাগান্ডা চালায়। জন তুর্ক বা ইয়ং তুর্ক নামে পরিচিত এই গ্রুপটি পরবর্তীতে ইত্তিহাদ এবং তেরাক্কি নামে একটু নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করে।
আর এই ইত্তিহাদ তেরাক্কি নামক দলটিতে সালতানাতের বিভিন্ন এলাকা থেকে বিভিন্ন মতাদর্শের লোকজন যোগ দেয়। তাদের মধ্যে পান ইসলামিক চিন্তাধারার লোকজনও থাকে, তেমন থাকে তুর্কি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী, আবার থাকে অটোম্যানিজমে বিশ্বাসী লোকজনও। ইসলামি, তুর্কি, এবং অটোম্যান মতবাদ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতেন এরকম অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ যোগ দেন এই ইত্তিহাদ তেরাক্কি দলে।
তারা তখন সুলতানের ক্ষমতাকে খর্ব করার জন্য একটি সংসদ গঠনের প্রস্তাব দেন। তাদেরকে তখন সরাসরি সাপোর্ট দেয় সরকারের মধ্য থেকে অনেক বড় বড় পদের ব্যক্তিবর্গ এবং সেনাবাহিনীর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সুলতান তাদের চাহিদা মোতাবেক একটি পার্লামেন্ট গঠনের সিদ্ধান্ত নেন। এবং পার্লামেন্টের সদ্যসদ্যের কিছু ক্ষমতাও দেন। চালু হয় সংসদীয় সালতানাত ব্যাবস্থা। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই অকেজো হয়ে পারে এই পার্লামেন্ট। কারণ, পার্লামেন্ট সদ্যসদ্যের মধ্যে যে যেই জাতি এবং মতাদর্শের সে তার নিজস্ব জাতি এবং মতাদর্শের পক্ষে এতো গোঁয়ারতুমি করা শুরু করেন যে ঐকমত্য হয়ে কোনো আইন পাস করা অসম্ভব হয়ে পড়ে।
এ অবস্থায় সুলতান পার্লামেন্টকে স্থগিত করেন। তখন এই ইত্তেহাদ তেরাক্কি গ্রুপটি সেনাবাহিনীর একটি অংশকে ব্যবহার করে বহুবার সুলতান আব্দুল হামিদের বিরুদ্ধে সামরিক এবং গণ অভ্যুত্থান ঘটানোর চেষ্টা চালায়। শেষ পর্যন্ত ১৯০৯ সালের ২৭শে এপ্রিল অটোম্যানদের শেষ স্বাধীন সুলতান আব্দুল হামিদ খানকে জোড় করে ক্ষমতাচ্যুত করে এই ইত্তিহাদ তেরাক্কি নামক সংগঠনটি।
প্রকৃতপক্ষে তখনই সমাধি ঘটে সেই বিশাল ওসমানীয় সম্রাজ্যের! অস্ত যায় দুনিয়ার বুকের সেই উজ্জ্বল নক্ষত্রটি! মুসলমানদের রক্ষার, তাদের পক্ষে হুঙ্কার ছাড়ার সেই শক্তিশালী বাঘটিকে খাঁচায় বন্দি করা হয়! শেষ হয়ে যায় ৬০০ বছরের সেই দাপুটে সম্রাজ, যা দাঁড়িয়ে ছিল আদালত, ন্যাবিচার, এবং সহমর্মিতার ভিত্তির ওপর।
যার ভয়ে ইউরোপে বাঘে মহিষে এক ঘাঁটে জল খেত। যেই উসমানীয় সম্রাজ্যের হুঙ্কারে ইউরোপে রাতে গানের আসর, রঙ্গলিলা বন্ধ করে দেয়া হতো। যেই উসমানীয় সম্রাজের নাম নিলে ইন্দোনেশিয়া থেকে ব্রাজিল পর্যন্ত মুসলমানদের শত্রুরা থরথর করে কাঁপতো, সেই উসমানীয় সম্রাজ্য ধসে পড়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই।
সুলতান আব্দুল হামিদকে ইস্তান্বুল থেকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয় সেলানিকে।এই সেলানিকেই ছিল ইত্তেহাদ-তেরাক্কির মূল অফিস। ক্ষমতাচ্যুত সুলতান আব্দুল হামিদ তাদের সাথে আপস না করলে এই সেলানিক শহরে তাকে গৃহবন্দি করে রাখা হয়। এবং সালতানাতে বসানো হয় আব্দুল হামিদের ভাই সুলতান মেহমেত রেশাত বা পঞ্চম মেহমেতকে। সুলতান রেশাত ছিলেন মূলত এই ইত্তিহাদ-তেরাক্কিদের হাতের পুতুল। ইত্তিহাদ-তেরাক্কিরা তাদের যেকোনো স্বার্থসিদ্ধি করার জন্য এই নামকাওয়াস্তের সুলতানকে ব্যবহার করতো।
আব্দুল হামিদের খমতাচ্যুতির পরে উসমানীয় সৈন্য এবং সালতানাতের কর্মকর্তা কর্মচারীদের মাঝে ব্যাপক দ্বিধা বিভক্তি দেখা দেয়। কিন্তু তখন গ্রীস, সার্বিয়া, বুলগেরিয়া এবং মন্টেনিগ্রো অটোম্যানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। বলকান যুদ্ধ নামে পরিচিত এই যুদ্ধ চলে ৮ই অক্টোবর ১৯১২ থেকে ৩০শে মে ১৯১৩ সাল পর্যন্ত। এই যুদ্ধে প্রায় ৫০ হাজার অটোম্যান সৈন্য নিহত হয় এবং বলকান অঞ্চলের প্রায় সবটুকুই ওসমানিয়দের হাতছাড়া হয়ে যায়।
একদিকে সুলতানের পদচ্যুতি ও গৃহবন্দি, অন্যদিকে বিশাল এক অঞ্চল হাতছাড়া হওয়া এবং বিপুল পরিমাণে সৈন্যের মৃত্যু উসমানীয়দেরকে আর্থিক এবং মানসিকভাবে দুর্বল করে দেয়।
আব্দুল হামিদকে ক্ষমতাচ্যুতির খুশিতে আত্মহারা ইত্তিহাদ তেরাক্কির নেতারা তখনও জানতেন না তাদের সামনে আরও বড় বিপদ অপেক্ষা করছে।
এই সংগঠনটির মূল নেতাদের মধ্যে ছিলেন অনেক পরিচিত মুখ। যেমন মোস্তফা কামাল পাশা, আনোয়ার পাশা, তালাত পাশা, ইসমেত ইনোনু, জালাল বায়ার এবং কাযিম কারাবেকিরসহ আরও অনেকে।
এছাড়াও তুরস্কের জাতীয় কবি মেহমেত আকিফ এরসোয়ও ছিলেন তাদের মধ্যে। যিনি লিখেছেন বর্তমান তুরস্কের জাতীয় সঙ্গীত। আধুনিক তুরস্কে ইসলামি পুনর্জাগরনের পথিকৃৎ হিসেবে যাকে দেখা হয় সেই বদিউজ্জামান সাইদ নুরসিও ছিলেন ইত্তেহাদ তেরাক্কিদের পক্ষে। আরও ছিলেন আধুনিক তুরস্কের বিখ্যাত লেখক, শিক্ষাবিদ ও সমাজবিজ্ঞানী জিয়া গোকআল্প।
এই ইত্তিহাদ তেরাক্কিরাই সুলতানকে না জানিয়ে জার্মানির সঙ্গে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণের চুক্তি করে। আর প্রথম বিশ্বযুদ্ধে শোচনীয়েভাবে পরাজয় নিশ্চিত হওয়ার পর ৮ অক্টোবর ১৯১৮ সালে এই দলটি নিজেকে বিলুপ্ত ঘোষণা করে আর ওই ক্ষমতাধর পাশাদের অনেকেই দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়। কিন্তু ততদিনে যে ক্ষতি উসমানীয় সম্রাজ্যের তথা সারা মুসলিম বিশ্বের হয়েছে তা আর কোনোদিন কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি।