গোপন সামরিক শক্তি ব্যবহার করে বিজয়ী হবে ইরান
প্রকাশ: ১৬ জুন ২০২৫, ১০:৪৫ পিএম
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
নির্ঘুম রাত। তেহরানে মুহুর্মুহু বিস্ফোরণের শব্দ। ভবন কেঁপে উঠছে। ড্রোন ও যুদ্ধবিমান থেকে ইসরাইলের হামলা এবং পালটা ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বভারের সক্ষমতায় সেসব ড্রোন ও যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার শব্দ একসঙ্গে মিশে ভয়ানক এক পরিস্থিতি।
ইরানি, বিদেশি আমরা সবাই কখনোবা ছাদে কখনোবা বারান্দায় দাঁড়িয়ে এসব বিস্ফোরণের উৎস খোঁজার চেষ্টা করছি। কখনোবা তীব্র আলোর ঝলকানি দেখতে পাওয়া যাচ্ছে আকাশের বুকচিরে। শুধু রাজধানী তেহরান নয়, ইরানের উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব ও পশ্চিম সব অঞ্চলেই এভাবে ইসরাইলি হামলা ও তা প্রতিহত করার ঘটনা ঘটে।
সেই শুক্রবার ভোর থেকে যার শুরু। ইসরাইল অতর্কিতভাবে শুক্রবার ভোরে রাজধানী তেহরান, তেহরান থেকে ২২৫ কিলোমিটার দূরে নাতাঞ্জ পরমাণু স্থাপনা, ফোরদু পরমাণুকেন্দ্র, তাবরিজ, ইস্ফাহান, আরাক ও কেরমানশাহে হামলা চালায়। সেই হামলায় ইরানের এলিট ফোর্স আইআরজিসির প্রধান, সশস্ত্র বাহিনীর প্রধানসহ ২২ জনের বেশি শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা শহীদ হন। শনিবার ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর জেনারেল স্টাফের আরও দুই সিনিয়র কমান্ডার নিহত হয়েছেন। রোববার রাতে আইআরজিসির গোয়েন্দা প্রধান নিহত হয়েছেন। গোটা ইরানে এক ধরনের নিস্তব্ধতা নেমে আসে ওই ঘটনার পর।
টানা দু’দিন ছুটি ছিল। সেই ছুটির দিনে ইসরাইলের ভয়াবহ হামলায় অপূরণীয় ক্ষতি হলো ইরানের। কেন কীভাবে এমন ঘটনা ঘটাতে পারল সেটি ওয়ান মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন! এর উত্তরও এখন মেলা ভার। তবে আসা যাক বর্তমান যুদ্ধ পরিস্থিতির দিকে।
ইসরাইলি হামলার পর দিনভর থমথমে তেহরান দেখলাম। নিস্তব্ধ নিথর এক জনপদ মনে হলো। তার পরই ইরানের শীর্ষ পর্যায় থেকে ইসরাইলি আগ্রাসনের কঠোর জবাব দেওয়ার বার্তা এলো। জরুরি বৈঠকে দিন শেষে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। যেন সিঁদুর রং ধারণ করল তেহরানের আকাশ। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাতের আঁধার নামতেই সাড়ে ১০টা নাগাদ ইরান একসঙ্গে শুরুতেই শতাধিক ড্রোন হামলা চালাল তেল আবিবকে লক্ষ্য করে। সে সময় ইরানের উচ্চপর্যায়ের বৈঠক চলছিল। তার পরই ঝাঁকে ঝাঁকে ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুটে গেল ইসরাইলের রাজধানী তেল আবিবসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ও কৌশলগত অঞ্চলে। হামলায় বড় বড় ভবনসহ শতাধিক ভবন ধ্বংস কিংবা বিধ্বস্ত হয়। রাতভর ৫ দফায় হামলা চালায় ইরানের সেনাবাহিনী। সেই হামলার সময় ইরানিদের আল্লাহু আকবর ধ্বনি ও উল্লাস দেখলাম। অনেকে রাস্তায় নেমে এলো।
এরপর সময় গড়াতে থাকল। শনিবারও ছুটির দিন। কিন্তু থমথমে পরিস্থিতি কাটল না। ছুটি বাতিল হলো আমাদের অফিসের। রাস্তাঘাট সুনসান-নীরব। ইরানের পক্ষ থেকে আরও জোরালো ভাষায় ইসরাইলি আগ্রাসনের জবাবের কথা আসতে থাকল।
দিনভর থেমে থেমে ইসরাইলও ইরানের বিভিন্ন এলাকায় ড্রোন হামলা চালাল। ইরান তা প্রতিহত করল। দিন শেষে রাত। এবার পালটাপালটি হামলা চলতে থাকল রাতভর। ভোরের আলো ফোটার আগেই আমার বাসার কাছের শাহরান তেল ডিপোতে ইসরাইলি ড্রোন হামলা। সেখানে আগুন ধরে গেল। এর ফলে তেহরান মেট্রোপলিটন সিটির পাঁচ অঞ্চলে তেলের সংকট তৈরি হয়েছে। পেট্রোলপাম্পের সামনে মাইলের পর মাইল গাড়ির লাইন দেখা গেছে। তেল নিতে পারছে না। রোববার সারা দিনও থেমে থেমে তেহরানের বিভিন্ন স্থানে হামলা হয়েছে। পালটা হামলা চালিয়েছে ইরান।
ইরানের জাতীয় সম্প্রচার সংস্থার বিশ্ব কার্যক্রমে আমি কাজ করি। এখানে ইসরাইল হামলা চালাবে এমন খবর ও গুঞ্জন চলছিল। আর সেটা স্থানীয় সময় পৌনে ৩টা নাগাদ ড্রোন হামলার মাধ্যমে বাস্তবে রূপ নিল। আমরা নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাই। তবে সৌভাগ্যক্রমে ড্রোনটিকে আকাশেই ধ্বংস করা হয়। আমরা সবাই নিরাপদে আছি। দিনের মতোই সারা রাতই থেমে থেমে ড্রোন এবং ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইসরাইল। বেশ কয়েকটি গাড়ি বোমা হামলার ঘটনাও ঘটেছে। গ্রিনজোন এলাকা তাজরিসে ড্রোন হামলার ফলে পানির প্রধান লাইন ফেটে যায়।
পরিস্থিতি বেশ গরম। সন্ধ্যা নামার আগেই সর্বশেষ খবর-ইরান ৫০টি ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে তেল আবিবে। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর বাড়ি লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হয়। রাতের পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়। ইরান ভোরে তেল আবিব ও বন্দরনগরী হাইফা লক্ষ্য করে আরও ১০০ ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালে সেখানে বিদ্যুৎকেন্দ্রে আগুন ধরে যায়। ইসরাইল বলেছে, এ যাবতকালের মধ্যে সবচেয়ে বড় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইরান। তেহরানের উত্তরাঞ্চলে ব্যাপক বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে।
তেহরানের বর্তমান পরিস্থিতি
শুক্রবার থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত রাতে দিনে ইসরাইলি এত ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হলো অথচ ইরানিদের মধ্যে বড় ধরনের কোনো আতঙ্ক লক্ষ্য করিনি; তবে উদ্বেগ আছে। খুব বিস্মিত হওয়ার মতো বিষয় হচ্ছে-হামলা এবং বিস্ফোরণের সময় তেহরানে কোনো সাইরেনের শব্দ শুনিনি। মসজিদ থেকে কোনো সতর্কবার্তাও নয়। যেন বিষয়টি এমন-ইসরাইলি হামলা হচ্ছে এটি প্রতিহত করা এবং প্রতিশোধ নেওয়ার দায়িত্ব দেশের সরকার ও নিরাপত্তা বাহিনীর। জনগণ নিশ্চিন্ত যেন। তবে বাস্তবতা জনগণ তো এমন যুদ্ধ পরিস্থিতিতে নিশ্চিন্ত থাকতে পারে না। অফিস আদালত সর্বত্র আলোচনা চলছে যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে। তবে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ইরানিদের বাড়ি থেকে কাজ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ। কারণ শিক্ষা বছরের সেশন শেষ হয়েছে। এখন ছুটি চলছে। তেহরানের রাস্তাঘাট অনেকটাই ফাঁকা। যানবাহন কম চলাচল করছে। বলা চলে অনেকটা থমথমে। তবে পেট্রোলপাম্পগুলোর সামনে দীর্ঘ লাইন। কেউ কেউ রাজধানী তেহরান ছেড়ে অন্য দূরের অন্য শহরে চলে যাচ্ছেন। এমনকি আমাদের সরকারি ভবনের কয়েকটি বিদেশি পরিবার তেহরান ছেড়ে অন্য শহরে চলে গেছেন। সাধারণ মানুষ জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাইরে খুব একটা বের হচ্ছেন না। তবে দোকান, ব্যবসা বাণিজ্য কেন্দ্র খোলা আছে।
ইরান-ইসরাইল যুদ্ধ দীর্ঘ হবে
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক বলেছেন, ইসরাইলের নৃশংস ও ভয়াবহ আগ্রাসনের প্রথম দিন থেকে এখন পর্যন্ত সেনাবাহিনী ইরানের ভূখণ্ড রক্ষার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়েছে। তিনি বলেন, তারা পূর্ণ প্রস্তুতির সঙ্গে ইসরাইলের ওপর কঠোর আঘাত হানতে থাকবে।
তাছাড়া ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী (আইআরজিসির) সিনিয়র কমান্ডার মেজর জেনারেল মোহসেন রেজায়ী বলেছেন, ইরান-ইসরাইল যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হবে। তবে ইরান তার গোপন সামরিক শক্তি ব্যবহার করে বিজয়ী হবে। ইরানের প্রেসিডেন্ট ড. পেজেশকিয়ান ইসরাইলকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, ইরানই এই গল্পের শেষ অধ্যায় লিখবে। ইসরাইলের বোকামিপূর্ণ কাজের জন্য অনুতপ্ত হতে হবে।
আর ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনি বলেছেন, ইহুদিবাদী ইসরাইল বড় ভুল করে ফেলেছে, বড় ত্র“টি করেছে, মারাত্মক ভুল করেছে এবং এর পরিণতিতে (দখলদার ইসরাইল) অসহায় হয়ে পড়বে ইনশাআল্লাহ।
ইরানের জনগণের প্রতিক্রিয়া
ইরানের সাধারণ জনগণের মধ্যে যুদ্ধ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। তবে ইরানিদের জাতীয়তাবাদী চেতনা খুব তীক্ষè। ভিন্ন মত থাকলেও জাতিরাষ্ট্র, ইতিহাস, ঐতিহ্য সংস্কৃতির ওপর কোনো হুমকি এলে সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া গোটা ইরানি জাতি এক। এ বিষয়টি আমি গত ২১ বছরের ইরান জীবনে প্রত্যক্ষ করেছি বিভিন্ন ঘটনায়। এর আগেও ইরাকের চাপিয়ে দেওয়া দীর্ঘ আট বছরের যুদ্ধেও সেটি প্রমাণিত এবং ইরান বিজয়ী হয়েছিল। ইরানের ইসলামী বিপ্লবের পর থেকেই এ দেশ এ জাতি প্রতিমুহূর্তে যুদ্ধের মধ্যে, নিষেধাজ্ঞা-অবরোধের মধ্যে রয়েছে। হাজার রকমের পশ্চিমা হুমকি ধমকি, অবরোধ-নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও তারা এগিয়ে যাচ্ছে অর্থনীতি, সামাজিক ও বৈজ্ঞানিক দিক থেকে। বিশেষ করে সামরিক দিক থেকে শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে গেছে। যেটি এখন যুদ্ধক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে। ইরানের নিজস্ব উদ্ভাবনী শক্তিশালী ড্রোন, বিভিন্ন ধরনের ক্রুজ, ব্যালেস্টিক এবং হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে ইসরাইলে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। তাদের শক্তিশালী আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আইরন ডোম ভেদ করে রাজধানী তেল আবিবসহ গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ও কৌশলগত এলাকায় সফল হামলা চালাতে সক্ষম হয়েছে।
অন্যদিকে ইসরাইল তাদের মোসাদের পেইড এজেন্ট দিয়ে ইরানের অভ্যন্তর থেকে যেসব হামলা চালিয়েছে তাদের অনেকেই এরই মধ্যে গ্রেফতার হয়েছেন। পূর্ণ ফৌজদারি বিচারের পর ইরানে মোসাদের এক গুপ্তচরের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। ইসরাইলের পেইড এজেন্টদের ড্রোন তৈরির কারখানা শনাক্ত হয়েছে। ফলে ধারণা করা হচ্ছে ইরানের অভ্যন্তর থেকে তাদের সহযোগীদের হামলা করার অবস্থা অনেকটা কমে যাবে।
বাংলাদেশিদের অবস্থা
ইরান একটি বিশাল দেশ। বিশাল অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ১০ থেকে ১৫ হাজারের মতো বাংলাদেশি আছেন। তার মধ্যে রাজধানী তেহরানে আছেন হাজারখানেক। তাদের নিরাপত্তার কথা ভেবে তেহরানস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস বিশেষ বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে। এর আগেও সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছিল বাংলাদেশিদের উদ্দেশে। তারা সবরকম সহযোগিতা করার কথা বলেছে।
সর্বশেষ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ইরানে বসবাসরত সব বাংলাদেশি নাগরিকের অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে, বর্তমান উদ্ভূত পরিস্থিতিতে জরুরি প্রয়োজনে যোগাযোগের জন্য দূতাবাস ইরমারজেন্সি হটলাইন স্থাপন করেছে।
অনেক বাংলাদেশি আতঙ্কের মধ্যে আছেন। তবে নিরুত্তাপ ইরানি জাতি। তাদের মধ্যে আলোচনা আছে তবে উদ্বেগ নেই। দীর্ঘকাল যুদ্ধের অভিজ্ঞতা যে জাতির মধ্যে জ্বলজ্বল করছে তারা উদ্বেগে থাকবে না সেটাই স্বাভাবিক। বরং যুদ্ধ যদি দীর্ঘমেয়াদি হয় তাতে যেন সবাই প্রস্তুত এমন মনোভাব লক্ষ করা গেছে। এখন দিন শেষ হতে যাচ্ছে, রাত নামলে কী হবে তার জন্য অপেক্ষা!
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও উপস্থাপক, রেডিও তেহরান, বাংলা অনুষ্ঠান, বিশ্ব কার্যক্রম, ইরান

