ইরানের জাতীয় সম্প্রচার সংস্থার সদর দপ্তরে হামলা
অল্পের জন্য আমরা বেঁচে গিয়েছি
প্রকাশ: ১৭ জুন ২০২৫, ১১:৪১ পিএম
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
পুরো রাত কেটেছে জেগে। উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা-এই বুঝি আমাদের বাসভবনে ড্রোন হামলা হলো। লাগাতার বিস্ফোরণের শব্দে মাথা যেন ভোঁ ভোঁ করছিল। এমনও হচ্ছিল-কোনো শব্দ নেই, তারপরও যেন হামলার শব্দ শুনতে পাচ্ছি।
অফিসের সরকারি ভবনে বিশ্বের বিভিন্ন মহাদেশের ২০টি সাংবাদিক পরিবার বাস করি। সবাই আমরা ইরানের জাতীয় সম্প্রচার সংস্থার বিশ্বকার্যক্রমের বিভিন্ন ভাষার অনুষ্ঠানে কাজ করি। আমরা সবাই ঝুঁকির মধ্যেই কর্মক্ষেত্র এবং বাসায় থাকছি। যুদ্ধ পরিস্থিতি আর সাংবাদিকতার ঝুঁকিপূর্ণ বাস্তবতা মেনেই আমাদের দিন-রাত কাটছে।
ইরানের জাতীয় সম্প্রচার সংস্থার সদর দপ্তরে হামলা: সোমবার বিকালে অল্প একটুর জন্য আমরা বেঁচে গিয়েছি। ১২টায় অফিসে গিয়ে সবাই যখন গভীর মগ্ন কাজে। যুদ্ধ পরিস্থিতির সর্বশেষ পরিস্থিতির আপডেট নিয়ে ব্যস্ত, তখনই হঠাৎ পৌনে ৬টা নাগাদ জরুরি নির্দেশনা এলো দ্রুত অফিস ভবন ছেড়ে নিরাপদ দূরত্বে সরে যাওয়ার। যে যেভাবে ছিলাম হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
মিনিট দশেকের মধ্যেই ইরানের জাতীয় সম্প্রচার সংস্থার (আইআরআইবি) সদর দপ্তরে ভয়াবহ ড্রোন হামলা হলো। দাউদাউ করে আগুনের লেলিহান শিখা আর ধোঁয়ার কুণ্ডলী আকাশের দিকে ধেয়ে যেতে থাকল। আমাদের নিরাপত্তা গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে নিশ্চুপ হয়ে সেই দৃশ্য দেখতে থাকলাম। ভেতরটা হাহাকার করে উঠল। আমাদের ইরানি সহকর্মীরা প্রায় সবাই সেখানে। অনেকে বের হতে পারেননি।
আইআরজিসি, দমকলবাহিনী ও অন্যান্য নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্যরা নিমিষেই পুরো আইআরআইবির বিশাল কম্পাউন্ড ঘিরে ফেলল। আগুন নেভানো ও উদ্ধার কাজ খুব দ্রুততার সঙ্গে তারা করতে থাকলেন।
আমরা সহকর্মীরা অনেকটা যে যার মতো ভিন্ন ভিন্ন দিকে ছিটকে পড়লাম। আমি আটকে রইলাম আমাদের প্রধান নিরাপত্তা গেটের বাইরে নিরাপত্তাবাহিনীর মধ্যে। অফিসের গাড়ি আমাকে রেখে চলে গেছে ভয়ে। অনন্যোপায় হয়ে পড়লাম। বিদেশি সাংবাদিক হিসাবে আইআরজিসির একজন কর্মকর্তা আমাকে ওই স্থান থেকে নিরাপদ জায়গায় চলে যাওয়ার জন্য তাদের একটি গাড়ির ব্যবস্থা করলেন। কয়েক কিলোমিটার দূরে আমাকে নামিয়ে দিয়ে তারা ঘটনাস্থলে চলে গেলেন। এরপর বড় বড় নিশ্বাস নিয়ে একটু অপেক্ষা করলাম নির্জন রাস্তার ধারে কিছুক্ষণ! সে এক কঠিন সময়!
রাতে হামলার তীব্রতা: এরপর নানাভাবে ভেঙে ভেঙে রাত ৯টা নাগাদ বাসায় ফিরলাম। ভাবলাম, একটু নিশ্চিন্ত হলাম। কিন্তু না, ক্ষণে ক্ষণে আকাশে মেঘের গর্জনের মতো ড্রোন হামলার শব্দ কানে আসতে থাকল। রাত যত গভীর হলো, ততই তেহরানে ইসরাইলি হামলা তীব্রতর হলো। তবে ইরানও রাজধানী তেল আবিব, হাইফাসহ বিভিন্ন কৌশলগত স্থানে প্রতিশোধমূলক ব্যাপক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে।
যদিও ইসরাইলের কঠোর সেন্সরশিপের কারণে সেখানে ক্ষয়ক্ষতির চিত্র সেভাবে পাওয়া যাচ্ছে না। তবে পালটাপালটি মিডিয়ার খবরের ভাষ্য-জ্বলছে তেহরান-জ্বলছে তেল আবিব, হাইফা!
তেহরানজুড়েই বিভিন্ন স্থানে হামলা হলেও ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে নামমাত্র। বেশির ভাগ ড্রোন ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা আকাশেই ধ্বংস করে দিয়েছে। আর সেই ধ্বংস করার শব্দ আরও গভীর ও গাঢ়। বুকের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়।
রাতটা কাটল এভাবে। ভোরে বাইরের পরিস্থিতি দেখতে বেরিয়েছিলাম। কিন্তু যেন শ্মশানপুরীর মতো কোথাও কেউ নেই। মহাসড়ক, ছোট ছোট সড়ক কিংবা লেন-কোথাও কাউকে দেখতে পেলাম না। নামমাত্র দু-চারটা গাড়ি বিদ্যুৎবেগে পাশ কাটিয়ে চলে গেল।
নগরবাসী তেহরান ছাড়ছে: নেতানিয়াহু এবং ডোনাল্ড ট্রাম্প তেহরান ছাড়ার হুঁশিয়ারি দেওয়ার পর এবং তাদের ইরানের অভ্যন্তরে হামলার তীব্রতার কারণে রাজধানী তেহরান শহরের বেশির ভাগ বাসিন্দা অন্যত্র নিরাপদ দূরত্বে চলে গেছেন, অনেকে পথে দীর্ঘ গাড়ির লাইনে আটকে পড়ে আছেন আবার অনেকে যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন।
বিদেশি নাগরিকদের তেহরান ছেড়ে অন্যত্র নিরাপদ জায়গায় যাওয়ার জন্য স্ব স্ব দেশের দূতাবাসগুলো জরুরি নির্দেশনা জারি করেছে। বিদেশি শিক্ষার্থীদের নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। অনেকে সীমান্তপথে নিজ নিজ দেশে চলে গেছেন। উদ্ভ‚ত পরিস্থিতিতে ইন্টারনেট পরিষেবা নিয়ন্ত্রিত। অনেকে যোগাযোগ করতে পারছেন না প্রিয়জনদের সঙ্গে। অনেকে তেহরান ছেড়ে আবার যেতেও পারছেন না!
আজকের তেহরান নীরব নিস্তব্ধ। বাইরে নগরবাসী বের হচ্ছেন না বললেই চলে। একটা গুমোট ভাব বিরোজ করছে। কী হয়, কী হবে-এমন প্রশ্ন সবার! যে রাতটি আসছে তা কেমন হবে, যুদ্ধ কোনদিকে যাচ্ছে-এসব হিসাবনিকাশ কষছে...
তবে ইরানের ঘোষণা, ট্রু প্রমিজ থ্রি অব্যাহত থাকবে এবং আরও কঠোরতর করা হবে। ইরান ইসরাইলকে তাদের আগ্রাসনের উচিত জবাব দেবে। আজও তীব্র হামলা চালানো হবে।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও উপস্থাপক, রেডিও তেহরান, বাংলা অনুষ্ঠান, বিশ্বকার্যক্রম, ইরান

