Logo
Logo
×

আন্তর্জাতিক

ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৪ জুন ২০২৫, ১১:৩৬ এএম

ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?

ছবি : সংগৃহীত

১৯৭৮ সালের অক্টোবর মাস, ইরানের ব্রিটিশ সমর্থিত শাহ বিরোধী আন্দোলনের দুই নেতা প্যারিস শহরতলির নেফল-লে-শাতোতে সাক্ষাৎ করেন। তাদের এ সাক্ষাৎ ছিল বিপ্লবের চূড়ান্ত পর্যায়ের পরিকল্পনার জন্য। এ বিপ্লবগত ৪৬ বছর ধরে নানা নাটকীয়তা ও নিষ্ঠুরতার মধ্য দিয়ে চলেছে।

নেফল-লে-শাতোতে সাক্ষাতে অংশ নেওয়া দুই নেতার মধ্যে মিল ছিল শুধু জাতীয়তা, বয়স ও শাহকে অপসারণের দৃঢ় সংকল্পে। এ দুজনের মধ্যে একজন কারিম সানজাবি। তিনি ছিলেন একজন সেক্যুলার লিবারেল ও ন্যাশনাল ফ্রন্ট দলের নেতা।

অপরজন আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনি, যিনি ১৯৬০-এর দশক থেকে ইরানি রাজতন্ত্রের প্রধান শিয়াবিরোধী ছিলেন। সাক্ষাতের সময় তাদের দুজনের বয়স ছিল ৭০-এর ওপরে।

সানজাবি প্যারিসে আসেন একটি বিপ্লবী ঘোষণাপত্রের খসড়া নিয়ে। এতে লেখা ছিল, বিপ্লব হবে দুটি মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে; গণতন্ত্র ও ইসলাম। তবে সানজাবি পরে ইতিহাসবিদদের জানান, সেই বৈঠকে খোমেনি নিজ হাতে একটি তৃতীয় মূলনীতি যোগ করেন, স্বাধীনতা।

এ স্বাধীনতার দাবি ছিল উপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে। ইরানে উপনিবেশিক শোষণের ইতিহাস থেকে যার উৎপত্তি। এ শোষণই বর্তমানে রূপ নিয়েছে জেদে। এ জেদ থেকেই ইরান বলছে, তারা ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করবে।

২০০০ সালের পর থেকে বিভিন্ন সময় ইরান ও পশ্চিমাদের মধ্যে আলোচনা হয়েছে। তবে, এসব আলোচনা ভেস্তে গেছে ইউরেনিয়াম ইস্যুতে। অবশেষে ওবামা প্রশাসনের আমলে ২০১৫ সালে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে  যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও চীনের একটি চুক্তি হয়, যা জেসিপিওএ নামে পরিচিত।

অনেক মার্কিনির ধারণা, ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ পারমাণবিক বোমা বানানোর গোপন উদ্দেশ্যের ফল। যদিও ইরানের সর্বোচ্চ নেতা একাধিকবার পারমাণবিক অস্ত্রের বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করেছেন। তবে যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিতে তা নিছক ধোঁয়াবাজি।

মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সও গত সপ্তাহে সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে লেখেন, ‘নাগরিকেরা পারমাণবিক শক্তি চাই, এটা এক জিনিস। আর ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধিকরণ আরেক জিনিসি। ইরান গোপানে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধি করে  বাধ্যবাধকতা লঙ্ঘন করছে। তারা পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে চাই।’

পারমাণবিক শক্তির ক্ষেত্রে তিন দশমিক ৬৭ শতাংশ ইউরেনিয়াম যথেষ্ট। তবে অস্ত্র তৈরি করতে হলে  ৯০ শতাংশ ইউরেনিয়ামের প্রয়োজন। ইরান ৬০ শতাংশ পর্যন্ত ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করেছে, যেটা ৯০তে পৌঁছাতে খুব বেশি সময় লাগে না।

ইরান যুক্তি দেয়, তাদের এ সমৃদ্ধিকরণ কোনো গোপন উদ্দেশ্য নয় বরং ডোনাল্ড ট্রাম্পের ২০১৮ সালে জেসিপিওএ থেকে একতরফা সরে যাওয়ার জবাব। এ সিদ্ধান্ত ইরানকে বহু নিষেধাজ্ঞার মুখে ফেলেছে। মার্কিন প্রশাসনের জন্য অনেকেই তেহরানের সঙ্গে বাণিজ্য করতে পারে না। এ কারণেই ইরানের রাজনৈতিক নেতারা গত এক দশকে বারবার বলেছে, আমেরিকানরা বিশ্বাসযোগ্য নয়। তারা বলছে, পশ্চিমা বিশ্ব কথা রাখেনি। অন্যদিকে, ইসরাইল অনবরত পশ্চিমাদের সাহায্য পাচ্ছে যা ইরানিদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি করেছে।

এত কিছুর মধ্যে একটি প্রশ্ন উঠে—ইরানের মতো তেলসমৃদ্ধ দেশ কেন নিজস্ব পারমাণবিক শক্তির জন্য এত মরিয়া?

মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ ভালি নাসর ‘ইরান গ্র্যান্ড স্ট্রেটেজি’ নামে একটি গবেষণাপত্র লিখেছেন। সেখানে ইরানের পারমাণবিক শক্তির জন্য মরিয়া হয়ে উঠার কথা স্পষ্ট করা হয়েছে। তিনি বলছেন, তেহরানের মরিয়া হওয়ার প্রশ্নের উত্তর নিহিত আছে ইরানের উপনিবেশিক ইতিহাস ও স্বাধীনতা আকাঙ্ক্ষায়।

উনিবিংশ শতকে ইরান ব্রিটিশ ও রুশ সাম্রাজ্যের মাঝে চাপে পড়ে। আর বিশ শতকে ব্রিটিশ কোম্পানিগুলো ইরানের তেল শোষণ করে। ১৯৪১ ও ১৯৫৩ সালে ইরানের নেতারা পশ্চিমাদের হস্তক্ষেপে ক্ষমতা হারান। বিশেষ করে মোহাম্মদ মোসাদ্দেকের পতন (১৯৫৩), যিনি তেল নিয়ন্ত্রণের দাবিতে সিআইএয়ের ষড়যন্ত্রে অপসারিত হন।

ইরানের পারমাণবিক শক্তির বিষয়টি এসেছে পশ্চিমাদের হাত ধরেই। ‘অ্যাটম ফর পিস’  কর্মসূচির মাধ্যমে ব্রিটিশ ও আমেরিকানরাই পারমাণবিক প্রযুক্তি ইরানে নিয়ে আসে। শাহের আমলে ২৩টি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা করেছিল তারা। কিন্তু, ১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লবের পর খোমেনি এসব কর্মসূচিকে ‘পশ্চিমা বিলাসিতা’ বলে বাতিল করেন।

বিদ্যুৎ সংকট ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির চাপে ইরান সরকার আবার গোপনে পারমাণবিক কর্মসূচি চালু করে। ইরান-ইরাক যুদ্ধে ইরাকে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের অভিজ্ঞতা, আন্তর্জাতিক মহলে ইরানের কণ্ঠরোধ এবং অসম্পূর্ণ প্রকল্প নিয়ে ইউরোপীয় কোম্পানিগুলোর সঙ্গে দীর্ঘ মামলাবাজি—এসব মিলেই তৈরি হয় ‘পারমাণবিক জাতীয়তাবাদ’।

১৯৯০ সালে ইরানের পারমাণবিক কর্তৃপক্ষ ঘোষণা দেয়, ২০০৫ সালের মধ্যে দেশের ২০ শতাংশ বিদ্যুৎ পারমাণবিক শক্তি থেকে আসবে।

তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রফসানজানি বারবার ইরানি বিজ্ঞানীদের দেশে ফিরে পারমাণবিক কর্মসূচি এগিয়ে নিতে অনুরোধ করেন। তখন পারমাণবিক শক্তি দেশপ্রেমের প্রতীকে রূপ নেয়।

২০০২ সালে একটি ভিন্নমতাবলম্বী গোষ্ঠীর ফাঁস করা তথ্যে জানা যায়, ইরানে দুটি গোপন ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র রয়েছে। এরপর শুরু হয় দীর্ঘ কূটনৈতিক টানাপোড়েন।

২০০৩ সালে তেহরান ঘোষণা ও ২০০৪ সালের প্যারিস চুক্তিতে ইরান অস্থায়ীভাবে সমৃদ্ধকরণ স্থগিত করে। কিন্তু ২০০৫ সালে মাহমুদ আহমাদিনেজাদ নির্বাচিত হলে আবার দৃঢ়ভাবে বলেন, পারমাণবিক প্রযুক্তি ইরানি যুবকদের বৈজ্ঞানিক সাফল্য।

জাতিসংঘের পরিদর্শক মোহাম্মদ এলবারেদি বলেছিলেন, ‘ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি সম্মান ও আঞ্চলিক প্রভাব প্রতিষ্ঠার এক মাধ্যম।’ রুহানিও বলেন, ‘পারমাণবিক শক্তি ও জ্বালানি বৈচিত্র্য আমাদের জাতীয় পরিচয়ের অংশ।’

ইরানের লক্ষ্য যদি সত্যিই নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা হয়, তাহলে তারা এ কর্মসূচির কারণে অনেক মূল্যও দিয়েছে—অনেক সময় হয়তো আত্মঘাতী সিদ্ধান্তও।

ঘটনাপ্রবাহ: ইরান-ইসরাইল সংঘাত


আরও পড়ুন

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম