Logo
Logo
×

আন্তর্জাতিক

যুদ্ধবিরতির খবরে মনে হলো বেঁচে গেলাম

ইরানে ১৩ জুনের সেই হঠাৎ হামলার ভয়ংকর গল্প শোনালেন তেহরানের আলজাহরা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাকিস্তানি শিক্ষার্থী ফাতিমা ইয়ুমনা। হোয়াটসঅ্যাপের ঘণ্টাজুড়ে আলাপে যুগান্তরকে ইসরাইলি হামলার বিভীষিকাময় সেই দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করেন ২২ জুন। পরে ২৪ জুন দুপুরে বলেন তার যুদ্ধবিরতি অনুভূতি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শামীম জোয়ার্দ্দার-

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৭ জুন ২০২৫, ১১:১৩ পিএম

যুদ্ধবিরতির খবরে মনে হলো বেঁচে গেলাম

ফাতিমা ইয়ুমনা

স্কুল বেলার অভ্যাস। ফজরের আগেই ঘুম ভাঙে। সেদিনও (২৪ জুন) জেগে উঠলাম আগেই। পাশ ফিরেই বালিশের পাশের মোবাইলটা হাতে নিলাম। খবরপাড়ায় ঢুকতেই একটা স্বস্তির ঝটকা রাখল শরীরে। যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। মুহূর্তেই চনমনে হয়ে উঠল সকালটা। টের পেলাম একটা চাপা আতঙ্ক নেমে গেল শিরদাড়া বেয়ে। ফুরফুরে হয়ে গেল শরীরটা। মনে হলো যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। দৌড়ে ছুটে গেলাম আম্মির কাছে (এ সময়টা তিনি ব্যালকনিতে বসে চা খান)। গলা জড়িয়ে ধরে বললাম-বেঁচে গেছি আম্মি! যুদ্ধ শেষ। আমার গলার আওয়াজে ঘুম ঘুম চোখেই ছুটে এলেন পাপা। দুজনেই থ হয়ে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে সম্বিৎ ফিরে পেলাম আমিও। টুঁ-শব্দ না করে মুখ বুজে চলে এলাম আমার রাজ্যে (ঘরে)। আসতে আসতেই ভাবলাম-বাড়ি ফিরেছি সেই কবে! এক সপ্তাহ হয়ে গেল! এখনো আমি ট্রমায় ছিলাম! যুদ্ধবিরতি হয়েছে ইরানে। আর আমি এখন পাকিস্তানে। অথচ কি আনন্দ আমার নিঃশ্বাসে! কত হালকা লাগছে নিজেকে! নিজের ভেতরের গুমোট ভাবটাও আর খুঁজে পাচ্ছি না কোথাও! সত্যিই কি তাহলে বেঁচে গেলাম আমিও! এতদিনও আমি আতঙ্কে ছিলাম!

আমি ফাতিমা ইয়ুমনা। গত ১০ মাস ধরে ইরানে ফার্সি শিখছি। তেহরানের ভানাক শহরের আলজাহরা বিশ্ববিদ্যালয়ে। হোস্টেলে তৃতীয় ফ্লোরে আমার কক্ষ। জুনের ১৩ তারিখের সেই ভোর! ফজরের সময়। রাত তখন প্রায় ৩টা। ঘুমের ঘোরেই মনে হলো জোরে শব্দ শুনতে পেলাম। প্রথমে আমাকে একটু ভয় পাইয়ে দেয়। একটু চোখটা খুললাম। দেখি লাইট জ্বলছে। আমার রুমমেট জেগে। ব্যস ওইটুকুই। আবার ঘুমিয়ে পড়লাম। কয়েক মিনিটের মধ্যেই আবার সেই বিকট শব্দ। কানে এলো হোস্টেলের ছাত্রীদের চিৎকার। দৌড়ে নিচতলায় যাওয়ার শব্দ শুনতে পেলাম। চমকে গেলাম এবার। ধড়ফড় করে উঠে পড়লাম। ততক্ষণে গায়ে দেওয়াল ভাঙা ধাক্কা দিচ্ছে আমার বান্ধবীও (রুমমেট)। আমিও ভয় পেয়ে গেলাম। দুজনে ভোঁ-দৌড়ে ছুটে গেলাম নিচতলায়। বুঝতে গেলাম এত গোলমালের কারণটা কি? দেখলাম-সবাই কাঁপছে। সবার মুখে আতঙ্ক। কারও চোখে পানি। নিচতলা বিরাট হলরুমের দেওয়ালে দেওয়ালে তখন চাপা কান্নার প্রতিধ্বনি। কি যেন একটা অসঙ্গতি মনে হলো-পায়ের দিকে তাকাতেই ধরে ফেললাম কারণটা। দুই পা-ই কাঁপছে সমানতালে। অন্যদের মতো ঠকঠক করে না হলেও কাঁপছিল। সাহস বাড়াতে বান্ধবীর যে হাতটা শক্ত করে চেপে রেখেছিল আমাকে-দেখলাম সেটাও কাঁপছে! 

আমি ভাবতে থাকি-যুদ্ধে কোনো বিরতি নেই। তুমি বিশ্রামের পরিকল্পনা করতে পারো না। তুমি জানো না পরবর্তী আক্রমণ কখন আসবে। তুমি জানো না পরের দিন তুমি জাগবে কিনা। সেই রাত আমাকে বুঝতে সাহায্য করেছিল যে সবকিছু কতটা ভঙ্গুর। সংঘাতের সময়, সবচেয়ে বড় শত্রু  শুধু বাইরের জিনিস নয়-এটি হলো ভয় যা তোমার ভেতরে স্থায়ী হয়। চলে যেতে অস্বীকার করে। 

থেমে থেমেই বিস্ফোরণের শব্দ শুনেছিলাম। আমাদের ছাদের উপর দিয়ে যাচ্ছিল। আতশবাজির মতো উড়ছিল আমাদের মাথার উপরে। মনে হচ্ছিল-‘মৃত্যু মাত্র কয়েক হাত উপরে। যে কোনো সময় আকাশ ভেঙে পড়বে।’ ভয়ংকর সে শব্দ। এর আগে কখনো শুনিনি কেউই। কাল্পনিক নয়। দৃশ্যটা ছিল এবোরেই বাস্তব। কিন্তু আমি শান্ত থাকার চেষ্টা করলাম। ভেবেছিলাম সেই রাতে আমি সবকিছু বেশ ভালোভাবেই সামলাচ্ছি। কিন্তু তারপর...! আরও জোরে বোমা বিস্ফোরিত হলো!! খুব কাছেই কোথাও মনে হলো আমার। এত জোরে যে হলের মেয়েরা সবাই একসঙ্গে চিৎকার করে উঠল! ঠিক তখনই আমার ধীরতা ও নিস্তব্ধতা হারিয়ে ফেললাম আমিও। কিছু একটা নড়ে গেল সেই মুহূর্তেই। আমি অনুভব করতে পারলাম সজাগ হয়ে ওঠা সাহসের সীমানা ভেঙে ভয় আমার শরীরের গভীরে ঢুকে গেল। আমার হাড় জমে গেছে। ঠান্ডা ঘামের ঢেউ উঠল। অনুভূতি মাত্র কয়েক সেকেন্ড স্থায়ী ছিল। কিন্তু এর আবেশ আঁকড়ে ছিল অনেকক্ষণ। আমরা অপেক্ষা করছিলাম। শুধু অপেক্ষা করছিলাম। প্রতিটি মিনিট ভারী হতে থাকে। পাহাড়ি পাথরের মতো। ভেজা চোখে অনিশ্চয়তার ঘোর। চিরকালের মতো ছিল পরের ‘দুই ঘণ্টা’। মনে হচ্ছিল অবিরাম চলবে। কখনো শেষ হবে না। আর বুঝি সকাল দেখা হবে না আমাদের। প্রিয় এই হোস্টেলেই থেকে যাবে জীবনের শেষ নিঃশ্বাস। স্বপ্নের আলজাহরা বিশ্ববিদ্যালয়েই গণসমাধি হবে আমাদের। বাড়ির কথা মনে হচ্ছিল। আম্মিকে খুব মনে পড়ছিল।

 বিশ্ববিদ্যালয়ের বান্ধবীদের সঙ্গে ফাতিমা ইয়ুমনা।  

ভোর ৫টা ৩০ মিনিটের দিকে শান্ত হলো ইসরাইল। আমরা আমাদের রুমে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। আমি অত্যন্ত ক্লান্ত ছিলাম, দিশেহারাও ছিলাম। সম্পূর্ণরূপে। আমার শরীর তখনও হতবাক। ঘুমানোর চেষ্টা করছিলাম। ঘুম আসে না! শরীরে অবশিষ্ঠ শক্তিটুক সব একসঙ্গে করে জোরে চোখ বন্ধ করলাম। পরপর কয়েকবার। হলো না-প্রতিবার যখন আমি ঘুমাতে শুরু করি, জেগে উঠছিলাম। চকিত ভাঙছিল। আবার ঝিমিয়ে পড়ছিল। কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছিলাম। যেন ক্ষেপণাস্ত্রের বিজলি বয়ে গেছে শরীরে। মনে হচ্ছিল যেন এক সেকেন্ডের জন্যও বিশ্রাম নিতে রাজি নয় আমার শরীর। অবশেষে কখন যেন আমি ঘুমিয়ে পড়ি। ঘণ্টাখানেকের ঘুম। সকালে উঠতেই মনে হয়েছিল আমি বদলে গেছি। আমার ভেতরে কিছু স্থায়ীভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। আমি ভাবতে থাকি-যুদ্ধে কোনো বিরতি নেই। তুমি বিশ্রামের পরিকল্পনা করতে পারো না। তুমি জানো না পরবর্তী আক্রমণ কখন আসবে। তুমি জানো না পরের দিন তুমি জাগবে কিনা। সেই রাত আমাকে বুঝতে সাহায্য করেছিল যে সবকিছু কতটা ভঙ্গুর। সংঘাতের সময়, সবচেয়ে বড় শত্র“ শুধু বাইরের জিনিস নয়-এটি হলো ভয় যা তোমার ভেতরে স্থায়ী হয়। চলে যেতে অস্বীকার করে।


আমরা মানিয়ে নিয়েছিলাম। সবারই থাকার একটা কারণ ছিল। সেটা পড়াশোনা, নিরাপত্তা, অথবা অন্য কোথাও যাওয়ার জায়গা না থাকায় যাই হোক না কেন। হাস্যরস আমাদের মোকাবিলার কৌশল হয়ে উঠল। আমরা হেসে ফেলতাম, মিম শেয়ার করতাম, আমাদের জীবনের অযৌক্তিকতা নিয়ে রসিকতা করতাম। ভয় কমানোর জন্য যে কোনো কিছু করতাম। আমাদের মধ্যে কারও কারও প্যানিক অ্যাটাক হয়েছিল।

কিন্তু কোনোভাবে, সেই শব্দগুলোর প্রতি সংবেদনশীল হয়ে পড়েছিলাম। আমরা মানিয়ে নিয়েছিলাম। সবারই থাকার একটা কারণ ছিল। সেটা পড়াশোনা, নিরাপত্তা, অথবা অন্য কোথাও যাওয়ার জায়গা না থাকায় যাই হোক না কেন। হাস্যরস আমাদের মোকাবিলার কৌশল হয়ে উঠল। আমরা হেসে ফেলতাম, মিম শেয়ার করতাম, আমাদের জীবনের অযৌক্তিকতা নিয়ে রসিকতা করতাম। ভয় কমানোর জন্য যে কোনো কিছু করতাম। আমাদের মধ্যে কারও কারও প্যানিক অ্যাটাক হয়েছিল, কিন্তু আমরা সবাই একসঙ্গে ছিলাম বলে, আমরা একে অপরের সহায়তায় পরিণত হয়েছিলাম। আমাদের মধ্যে কয়েকজন খুব ধীর ছিল। আমি নিজেও সব সময় ঠান্ডা ছিলাম। টানা ৪ দিন আমি এভাবেই ছিলাম। তারপর বার্তা এলো। আমাদের এলাকায় বোমা হামলা হতে চলেছে। আমাদের এলাকা তেহরানের ভানাক এলাকা। খুবই সেনসিটিভ। আমাদের তাৎক্ষণিকভাবে চলে যেতে বলা হয়েছিল। পাকিস্তান দূতাবাস জানায় যে আমাদের কয়েক মিনিটের মধ্যেই সরে যেতে হবে। আমাদেরকে (পাকিস্তানি যারা ছিলাম) সরকারিভাবে বিনামূল্যে বাসে করে পাকিস্তান বর্ডার নিয়ে যাওয়া হবে। ভাবার সময় ছিল না। আমরা তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে পড়লাম। যা সামনে পেয়েছি ছোট ব্যাগে নিয়ে জাস্ট বেরিয়ে পড়েছিলাম। বাড়ি ফিরতে আমার পাঁচ-ছয় দিন লেগেছিল। দিনগুলো বিশৃঙ্খলা, ভ্রমণ, অনিশ্চয়তায় ভরা। ভয়ে ছিল না। কিন্তু ভয়ের ঘোরটা ছিল সবার চোখেই। যা হয়তো বুঝে গিয়েছিল আমাদের সবার পরিবারও। কিন্তু প্রকাশ করেনি। ঠিক আমার পাপা-আম্মির মতোই! 

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম