Logo
Logo
×

আন্তর্জাতিক

জাতিসংঘ মহাসচিব হওয়ার দৌড়ে কেন ‘বিপজ্জনক’ প্রার্থী গ্রোসি

নাজমুশ শাহাদাৎ

নাজমুশ শাহাদাৎ

প্রকাশ: ০৪ জুলাই ২০২৫, ১১:৫৬ এএম

জাতিসংঘ মহাসচিব হওয়ার দৌড়ে কেন ‘বিপজ্জনক’ প্রার্থী গ্রোসি

জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের সঙ্গে রাফায়েল গ্রোসি।ছবি: মেহের নিউজ

আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) মহাপরিচালক রাফায়েল গ্রোসি যখন জাতিসংঘ মহাসচিব হওয়ার চেষ্টা করছেন। ঠিক তখনই তার পক্ষপাতদুষ্ট ভূমিকাই তাকে একধরনের প্রশ্নবিদ্ধ এবং কিছুক্ষেত্রে ‘বিপজ্জনক প্রার্থী’ হিসেবে চিহ্নিত করছে। বিশেষ করে ইরানের শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে তার অবস্থানের কারণে।

গত কয়েক মাস ধরে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক মহলে রাফায়েল গ্রোসির নাম জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের উত্তরসূরি হিসেবে ক্রমশ উচ্চারিত হচ্ছে।

অনেক প্রার্থীর ক্ষেত্রেই এটি কেবল গুজব ও মিডিয়া-ভিত্তিক বিশ্লেষণের ফল হলেও, গ্রোসি নিজে একাধিকবার সরাসরি ও স্পষ্টভাবে জাতিসংঘের সর্বোচ্চ পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্ভাবনা বিবেচনার কথা বলেছেন। যা তার রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার স্পষ্ট প্রমাণ।

এর প্রথম আভাস পাওয়া যায় ব্রিটিশ পত্রিকা দ্য টেলিগ্রাফ-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে। যেখানে তিনি বলেন, জাতিসংঘ মহাসচিব হওয়ার জন্য তার নাম আলোচনায় এসেছে, যা তাকে চিন্তায় ফেলেছে। যদিও তখন তিনি বলেন, তার মনোযোগ এখনো আইএইএ-র দায়িত্বে নিবদ্ধ। কিন্তু আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা একে ভবিষ্যতের প্রতিক্রিয়া যাচাইয়ের সূক্ষ্ম ইঙ্গিত হিসেবেই দেখেন।

পরে ওয়াশিংটনে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি আরও স্পষ্টভাবে জানান, তিনি ‘খুব, খুব গুরুত্ব সহকারে’ এই সম্ভাবনা নিয়ে ভাবছেন। 

এরপর রুশ সংবাদ সংস্থা তাস-কে দেওয়া এক বক্তব্যে তিনি জাতিসংঘের গঠনগত দুর্বলতার প্রতি পরোক্ষ সমালোচনা করে বলেন, ‘আমার কাজই আমার সর্বোত্তম প্রচার’।যা স্পষ্ট করে যে তিনি তার বর্তমান কূটনৈতিক কর্মকাণ্ডকে ভবিষ্যৎ উচ্চমর্যাদার ভিত্তি হিসেবে দেখছেন।

ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি: গ্রোসির কূটনৈতিক দুর্বলতা

তবে গত কয়েক বছর ধরে গ্রোসি বারবার এমন অবস্থান নিয়েছেন, যা আইএইএ-র নিরপেক্ষ প্রযুক্তিগত ভূমিকার সঙ্গে সাংঘর্ষিক, বরং রাজনৈতিক অভিমুখের ইঙ্গিতবাহী। 

সংস্থাটির কাজ নিরপেক্ষ ও যথাযথ প্রযুক্তিগত প্রতিবেদন দেওয়া হলেও, তিনি বোর্ড অব গভর্নরস-এর বৈঠক কিংবা গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক আলোচনার ঠিক আগে নানা সময়োপযোগী রিপোর্ট প্রকাশ করে ইরানের ওপর রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করেছেন।

উদাহরণস্বরূপ, ২০২৩ ও ২০২৪ সালে ‘উচ্চমাত্রার সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম কণার’ কথিত সন্ধান নিয়ে রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়। যা ইরান তাৎক্ষণিকভাবে প্রত্যাখ্যান করে এবং যার বৈজ্ঞানিক যাচাই তখনো সম্পন্ন হয়নি। 

কিন্তু ওই রিপোর্টগুলো এমন সময় প্রকাশিত হয়, যখন বোর্ডে ইরানবিরোধী প্রস্তাব পেশের প্রস্তুতি চলছিল। ফলে এই রিপোর্টগুলোকে পশ্চিমা চাপে সমর্থন দেওয়ার হাতিয়ার হিসেবেও দেখা হয়েছে।

গ্রোসির রিপোর্টই পশ্চিমা হামলার রাজনৈতিক বৈধতা 

এমন পক্ষপাতদুষ্ট রিপোর্ট প্রকাশের ফলে একাধিক ক্ষেত্রে সরাসরি রাজনৈতিক ও সামরিক পদক্ষেপ নিতে দেখা গেছে। যেমন, সম্প্রতি গ্রোসি যখন দাবি করেন- ইরান আইএইএ-র সঙ্গে সহযোগিতা কমিয়ে দিয়েছে। এর ঠিক এক সপ্তাহের মধ্যেই ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্র যৌথভাবে ইরানের কিছু পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনায় হামলা চালায়।

এ ঘটনার পর আইএইএ এবং গ্রোসির প্রতি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। মিডল ইস্ট আই এবং দ্য কার্ডলের মতো স্বাধীন সংবাদমাধ্যম তাকে ন্যাটোর ‘গুপ্তচর বাহিনীর’ মতো আচরণ করার অভিযোগ তোলে। ল্যাটিন আমেরিকা ও আফ্রিকার বহু নিরপেক্ষ রাষ্ট্র মনে করে, গ্রোসি তার নিরপেক্ষ অবস্থান বিসর্জন দিয়ে পশ্চিমা রাজনৈতিক কৌশলের অংশ হয়ে উঠেছেন।

এ পরিস্থিতিতে ইরান সরকারও কড়া পদক্ষেপ নিয়েছে। ২ জুলাই প্রেসিডেন্ট মাসউদ পেজেশকিয়ান ইরানের সংবিধানের ১২৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ‘আইএইএ-র সঙ্গে সহযোগিতা স্থগিতের আইন’ বাস্তবায়নের নির্দেশ দেন। যা দেশটির সংসদে গত ২৫ জুন পাস হয়ে গার্ডিয়ান কাউন্সিলের অনুমোদন পায়।

পশ্চিমাদের ‘নিরাপত্তার রক্ষক’ নাকি রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্টতা?

ইরানসহ বহু উন্নয়নশীল দেশের এই আস্থার ঘাটতি এবং একদিকে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের পক্ষ থেকে পাওয়া ক্রমাগত সমর্থন গ্রোসি-কে বিশ্বমঞ্চে একটি বিভক্ত চিত্রে পরিণত করেছে। পশ্চিমারা তাকে ‘পারমাণবিক স্বচ্ছতার প্রতিনিধি’ হিসেবে উপস্থাপন করতে চায়। কিন্তু বহু দেশ তাকে পশ্চিমের রাজনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবেই দেখে।

এই প্রেক্ষাপটে চীন, রাশিয়া, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ‘গ্রুপ ৭৭’-এর অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্রের সমর্থন পাওয়াই তার জন্য কঠিন হয়ে উঠছে। যা জাতিসংঘ মহাসচিব নির্বাচনে চূড়ান্তভাবে ক্ষতিকর হতে পারে।

জাতিসংঘের জন্য প্রয়োজন নৈতিক নেতৃত্ব 

প্রথম দৃষ্টিতে আইএইএ-র নেতৃত্বে থাকায় গ্রোসি জাতিসংঘের জন্য একজন অভিজ্ঞ কূটনীতিক হিসেবে বিবেচিত হতে পারেন। কিন্তু জাতিসংঘ মহাসচিব পদ শুধু কৌশলগত দক্ষতা নয়, বরং নৈতিক নেতৃত্ব, বিশ্বজনীনতা এবং নিরপেক্ষতার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত।

বর্তমান মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস—যিনি পর্তুগালের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং UNHCR-র প্রধান ছিলেন।তিনি দীর্ঘদিন ধরে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবিক সংকটে সাহসী ভূমিকা রেখেছেন। অভিবাসন, জলবায়ু পরিবর্তন, মানবাধিকার এবং বহুপাক্ষিকতা রক্ষায় নিরপেক্ষতা বজায় রেখেছেন।

সে তুলনায় গ্রোসির পারমাণবিক কূটনীতির বাইরেই কোনো জাতীয় বা মানবিক সংস্থার নেতৃত্বের অভিজ্ঞতা নেই। ইরান, উত্তর কোরিয়া, ইউক্রেন ইত্যাদি ইস্যুতে তার ভূমিকা পক্ষপাতের ইঙ্গিত দেয়।

অন্যদিকে, জাতিসংঘ মহাসচিব নির্বাচনের কাঠামোতেও তার জন্য বিপদ রয়েছে। এ পদে নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যদের সম্মতি এবং সাধারণ পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থন প্রয়োজন। পশ্চিমা দেশগুলোর সমর্থন পেলেও গ্রোসি উন্নয়নশীল ও নিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলোর আস্থাভাজন নন।

উচ্চাকাঙ্ক্ষা রয়েছে, কিন্তু গ্রহণযোগ্যতা নেই

রাফায়েল গ্রোসি আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার সঙ্গে পরিচিত এবং পশ্চিমা স্বার্থের বিশ্বস্ত কর্মী হলেও এখনো তিনি জাতিসংঘের নৈতিক ও নিরপেক্ষ নেতৃত্বের উচ্চতায় পৌঁছাতে পারেননি। জাতিসংঘের নেতৃত্বে প্রয়োজন এমন একজন, যিনি সামরিক উত্তেজনা না বাড়িয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করবেন, মানবাধিকার ও উন্নয়ন নিশ্চিত করবেন, আর সদস্য রাষ্ট্রগুলোর আস্থা অর্জন করবেন।

যদিও গ্রোসির উচ্চাকাঙ্ক্ষা এখন দৃশ্যমান। তবে তা বাস্তবতার চেয়ে বেশি স্বাপ্নিক বলেই মনে হচ্ছে। এ মুহূর্তে তিনি জাতিসংঘের নেতৃত্বের জন্য নয়, বরং একটি বিভাজনমূলক চরিত্র হিসেবেই বেশি পরিচিত। তথ্যসূত্র: মেহের নিউজ

ঘটনাপ্রবাহ: ইরান-ইসরাইল সংঘাত


আরও পড়ুন

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম