Logo
Logo
×

আন্তর্জাতিক

অপারেশন বিয়ে: রাজীব গান্ধী হত্যার মাস্টারমাইন্ড একচোখা শিভারাসান

খালিদ হাসান

খালিদ হাসান

প্রকাশ: ০৬ জুলাই ২০২৫, ০৬:২১ পিএম

অপারেশন বিয়ে: রাজীব গান্ধী হত্যার মাস্টারমাইন্ড একচোখা শিভারাসান

ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী। ছবি: সংগৃহীত

১৯৯১ সালের ২১ মে ভারতের তামিলনাড়ুর একটি ছোট শহর শ্রীপেরুমবুদুর। রাত ১০টা ২০ মিনিট। জনসমুদ্রের মাঝখানে পা রাখলেন ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী। প্রদেশটির বিভিন্ন এলাকায় সারাদিন নির্বাচনী সভা সেরে ক্লান্ত এ নেতা। তার দিকে এগিয়ে এলেন এক তরুণী— নাম ধানু। সবুজ-কমলা সালওয়ার কামিজ পরা, হাতে ছিল একটি মালা। তিনি রাজীব গান্ধীকে মালা পরালেন এবং পা ছোঁয়ার ভান করলেন। মুহূর্তেই বিকট শব্দ, আগুন, ধোঁয়া আর চিৎকার। রাজনীতির আঙিনায় নেমে এল রক্তের স্রোত।

রাজীব গান্ধীর মৃত্যু শুধু একজন রাজনৈতিক নেতার মৃত্যুই ছিল না—এটি ছিল ভারতীয় রাজনীতির মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া একটি হত্যাকাণ্ড। আর এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে ছিলেন এক রহস্যময়, একচোখো ঘাতক—শিভারাসান। যার পরিচিতি ছিল ‘ওয়ান-আইড জ্যাক’ নামে। 

কীভাবে হলো এই একচোখো সান্ত্রাসীর উত্থান

শিভারাসানের আসল নাম ছিল চন্দ্রশেখরাম্পিল্লাই পক্কিয়াচন্দ্রন। শ্রীলঙ্কার জাফনার উপকণ্ঠ উদুপিড়ি শহরে জন্ম নেওয়া এই তরুণ ছোটবেলা থেকেই সশস্ত্র সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৮৭ সালে শ্রীলঙ্কান সেনার সঙ্গে সংঘর্ষে একটি চোখ হারানোর পর তিনি ‘ওত্তারাইক্কান্নান’ বা একচোখো নাম ধারণ করেন। ভারতীয় মিডিয়া পরে তাকে ‘ওয়ান-আইড জ্যাক’ নামে চিহ্নিত করে।

তামিল, তেলেগু, মালয়ালম ও হিন্দি ভাষাতে দক্ষ শিভারাসান ভারতীয় ভূপ্রকৃতি সম্পর্কে ছিলেন অভিজ্ঞ। তামিল জাতিগোষ্ঠীর স্বশস্ত্র সংগঠন ‘লিবারেশন টাইগার্স তামিল এলাম’ (এলটিটিই)-এর ভেতরে তার প্রবল প্রভাব তৈরি হয় এবং সংগঠনটির শীর্ষ নেতা প্রভাকরণ ও পট্টু আম্মানের সরাসরি আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন তিনি।

রাজীব গান্ধী যে কারণে এলটিটিইর টার্গেট হলেন

১৯৮৭ সালে রাজীব গান্ধী ভারতের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট জেআর জয়বর্ধনের সঙ্গে ইন্দো-শ্রীলঙ্কা চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তির মাধ্যমে এলটিটিই-কে অস্ত্র পরিত্যাগ করতে বলা হয় এবং ভারত থেকে শান্তিরক্ষী বাহিনী (আইপিকেএফ) পাঠানো হয় শ্রীলঙ্কায়। এলটিটিই এই চুক্তিকে বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে দেখে এবং ১৯৮৭ সালের অক্টোবর থেকে আইপিকেএফের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।

মা ইন্ধিরা গান্ধীর সঙ্গে রাজীব গান্ধী। ছবি: সংগৃহীত

১৯৯০ সালের মধ্যে আইপিকেএফ শ্রীলঙ্কা ছেড়ে চলে গেলে এলটিটিই পুনরায় শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এই সময়ে প্রভাকরণ ভারত ও রাজীব গান্ধীর বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কারণ কংগ্রেসের নির্বাচনী ইশতেহারে ১৯৮৭ সালের চুক্তির প্রতি সমর্থনের কথা উল্লেখ করা হয়েছিল।

অপারেশন ‘বিয়ে’র মাধ্যমে হত্যা করা হয় রাজীব গান্ধীকে

রাজীব গান্ধী হত্যার পরিকল্পনার কোডনেম ছিল ‘বিয়ে’। অপারেশন বাস্তবায়নের জন্য এলটিটিই ভারতে পাচার করে ৫ কেজি সোনা, এটি বিক্রি করে সংগ্রহ করা হয় ১৯ লাখ ৩৬ হাজার রুপি। এই অর্থে গঠিত হয় ‘হিট স্কোয়াড’, যার নেতৃত্বে ছিল শিভারাসান।

এই দলের মুখ্য ছিলেন দুই নারী। ধানু- যিনি আত্মঘাতী বোমা হিসেবে নিজেকে উৎসর্গ করেন এবং শুভা- যিনি ছিলেন বিকল্প হামলাকারী। শিভারাসান ছদ্মবেশে সাংবাদিক সেজে রাজীব গান্ধীর সভাস্থলে প্রবেশ করেন। নিরাপত্তার বলয় ছিল অত্যন্ত দুর্বল—না ছিল স্ক্যানার, না ছিল দেহতল্লাশি।

ধানু রাজীবকে মালা পরিয়ে পা ছোঁয়ার ভঙ্গিতে নিচু হতেই বিস্ফোরণ। একটি সুইসাইড ভেস্টে থাকা আধা কেজি বিস্ফোরক মুহূর্তেই প্রাণ কেড়ে নেয় ১৮ জনের।

একটি ক্যামেরা ছিল তদন্তের একমাত্র উৎস

এই হত্যাকাণ্ডের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ হয়ে দাঁড়ায় একটি চিনন ব্র্যান্ডের ক্যামেরা। এটি ছিল হরিবাবু নামে এক ফটোগ্রাফারের, যাকে শিভারাসান ভাড়া করেছিলেন হত্যার মুহূর্ত ধারণ করার জন্য। হরিবাবুও বিস্ফোরণে নিহত হন, কিন্তু তার ক্যামেরায় ধরা পড়ে পুরো দলটির ছবি।

এটি তদন্তের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। তদন্তকারী দলের প্রধান ডিআর কার্তিকেয়নের নেতৃত্বে দ্রুত তদন্ত এগোতে থাকে। দুই মাসের মধ্যে অধিকাংশ ঘাতককে আটক করা হয়, তবে শিভারাসান তখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে।

শিভারাসানের পরিণতি 

শিভারাসান তখন এক স্থান থেকে অন্য স্থানে লুকিয়ে বেড়াচ্ছেন। নিজের মতো দেখতে ১১ জন এলটিটিই সদস্যকে বিভিন্ন ছদ্মবেশে ছড়িয়ে দেন—কেউ হিন্দু পুরোহিত, কেউ শিখ, কেউ মুসলিম মাওলানা।

চেন্নাই থেকে বেঙ্গালুরু পর্যন্ত ৩৫০ কিলোমিটার জার্নি করেন একটি পানির ট্যাংকারে। শেষ আশ্রয় ছিল কর্নাটকের কনানাকুন্টে এলাকার একটি বাড়ি। এরইমধ্যে ভারত সরকার তার মাথার দাম ঘোষণা করে ১৫ লাখ রুপি।

১৯ আগস্ট, ১৯৯১ পুলিশ গোপন সংবাদের ভিত্তিতে শিভারাসান যে বাড়িটিতে লুকিয়ে ছিলেন তা ঘিরে ফেলে। তবে তিনি আত্মসমর্পণ করেননি। ৩৬ ঘণ্টা অপেক্ষা করে একটি ৯ এমএম পিস্তল দিয়ে নিজের কপালে গুলি করেন। তার সঙ্গে থাকা ছয় এলটিটিই সদস্য সায়ানাইড ক্যাপসুল খেয়ে আত্মহত্যা করেন। মহিলারা একে অপরকে জড়িয়ে ছিলেন, পুরুষরা একে অপরের পিঠে হাত রেখে মৃত্যুবরণ করেন।

এরপর চেন্নাইয়ের এক সেফহাউসে টাইলস খনন করে নিচ থেকে উদ্ধার হয় একটি ডিকশনারি, নকল চোখ, পকেট ডায়েরি ও পিস্তল। ডায়েরিতে ছিল ফোন নম্বর, কোড, ঠিকানা, লেনদেন ও অপারেশনের প্রতিদিনের বিবরণ।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম