Logo
Logo
×

আন্তর্জাতিক

ফতোয়া থেকে কৌশল

ইরান কেন পারমাণবিক বোমা বানাচ্ছে না?

আশরাফুর রহমান, তেহরান থেকে

আশরাফুর রহমান, তেহরান থেকে

প্রকাশ: ১৩ জুলাই ২০২৫, ০৯:৫৬ পিএম

ইরান কেন পারমাণবিক বোমা বানাচ্ছে না?

বিশ্ব রাজনীতিতে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি একটি বহুল আলোচিত এবং বিতর্কিত ইস্যু। পশ্চিমা শক্তিগুলো, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল, বহু বছর ধরে অভিযোগ করে আসছে—ইরান নাকি গোপনে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে চাচ্ছে। কিন্তু জাতিসংঘের পরমাণু পর্যবেক্ষক সংস্থা (আইএইএ) বা যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আজও পর্যন্ত এমন কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেনি যা এ দাবিকে প্রতিষ্ঠিত করে। অপরদিকে, ইরান শুরু থেকেই বলে আসছে যে, তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি সম্পূর্ণরূপে শান্তিপূর্ণ ও বেসামরিক উদ্দেশ্যে পরিচালিত।

প্রশ্ন হলো, যদি ইরান সত্যিই পারমাণবিক অস্ত্র বানাতে চাইত, তাহলে গত দুই দশকে তা তৈরি করেনি কেন? আর যদি তা না-ই চায়, তাহলে উচ্চমাত্রায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ চালিয়ে যাচ্ছে কেন? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর পেতে হলে ইরানের ধর্মীয় অবস্থান, কৌশলগত চিন্তা, রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির দ্বিচারিতা একত্রে বিশ্লেষণ করতে হবে।

ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা ও নৈতিক অবস্থান

২০০৩ সালে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি একটি ঐতিহাসিক ফতোয়া জারি করেন। সেখানে স্পষ্টভাবে বলা হয় : ‘পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি, মজুদ কিংবা ব্যবহার ইসলামি শরিয়তের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ হারাম।’ এই ধর্মীয় সিদ্ধান্তটি শুধুই ধর্মীয় নয়, বরং একটি নৈতিক অবস্থানও, যেখানে নিরীহ মানুষের হত্যাকে ইসলাম কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছে।

পারমাণবিক বোমা শুধু সামরিক লক্ষ্যবস্তু ধ্বংস করে না, বরং শহর, জনপদ ও লাখ লাখ নিরীহ মানুষের প্রাণ হরণ করে। ইসলামি যুদ্ধনীতিতে বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। কুরআনে বলা হয়েছে : ‘যে ব্যক্তি একজন নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করল, সে যেন পুরো মানবজাতিকে হত্যা করল।’ (সূরা আল-মায়িদা ৫:৩২)

ইরান মনে করে, পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার শুধু মানবতার বিরুদ্ধে নয়, পরিবেশ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বিরুদ্ধে চরম অন্যায়। হিরোশিমা-নাগাসাকির দৃষ্টান্ত এ বিষয়ে যথেষ্ট প্রমাণ দেয়।

কৌশলগত ও সামরিক বাস্তবতা

অনেকের ধারণা, পারমাণবিক অস্ত্র থাকলেই একটি দেশ নিরাপদ থাকে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। পাকিস্তান ১৯৯৮ সালে পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করলেও ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের চাপের মুখে আফগানিস্তানে মার্কিন অভিযানে অংশ নিতে বাধ্য হয়। উত্তর কোরিয়া পারমাণবিক অস্ত্রধারী হওয়া সত্ত্বেও আন্তর্জাতিকভাবে একঘরে। এমনকি রাশিয়া, যাদের বিশ্বের সর্বোচ্চ পারমাণবিক অস্ত্র মজুদ রয়েছে, ইউক্রেন যুদ্ধে ন্যাটোর সঙ্গে কৌশলগতভাবে চাপে পড়েছে।

ইসরাইলও, অঘোষিত পারমাণবিক অস্ত্রধারী হওয়া সত্ত্বেও ইরানের ‘অপারেশন ট্রু প্রমিজ’-এ বড় ধরনের সামরিক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে। এই বাস্তবতা ইরানকে বুঝিয়ে দিয়েছে—পারমাণবিক অস্ত্র নয়, কার্যকর প্রতিরোধ ক্ষমতা ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতিই নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে। তাই তারা শক্তিশালী ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র, চালকবিহীন বিমান বা ড্রোন এবং কৌশলগত অস্ত্র নির্মাণে জোর দিয়েছে।


রাজনৈতিক ঝুঁকি ও আন্তর্জাতিক চাপ

একথা সত্য যে, পরমাণু অস্ত্র বানানোর প্রয়োজনীয় ইউরেনিয়াম ইরানের রয়েছে। যদিও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং তার মন্ত্রিসভার সদস্যরা শুরু থেকেই দাবি করে আসছেন, যুক্তরাষ্ট্রের হামলায় ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনাই ‘পুরোপুরি ধ্বংস’ হয়ে গেছে।

ইসরাইলি এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাও সম্প্রতি নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেছেন, ইরানের পারমাণবিক কেন্দ্রে থাকা ১৮ হাজার সেন্ট্রিফিউজের বেশিরভাগই ধ্বংস হয়ে গেছে। তবে ৬০ শতাংশ মাত্রায় সমৃদ্ধ সব ইউরেনিয়াম নষ্ট হয়নি। কিছু ইউরেনিয়াম বিশেষ পাত্রে আলাদা করে সংরক্ষণ করা ছিল, যা এখনো ইরানি বিজ্ঞানীরা ব্যবহার করতে পারেন।

আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (আইএইএ) মহাসচিব রাফায়েল গ্রোসি বলেন, হামলার আগেই ইরান তাদের অনেক ইউরেনিয়াম মজুত সরিয়ে ফেলেছিল।

মার্কিন-ইসরাইলি হামলার পরও ইরানের কাছে ৬০ মাত্রার ইউরেনিয়াম আছে—বিষয়টি ইরানি কর্মকর্তারাও স্বীকার করেছেন। কিন্তু তারপরও পরমাণু অস্ত্রের দিকে যাচ্ছে না ইরান। কারণ ইরান যদি পারমাণবিক বোমা তৈরি করতে যায়, তাহলে অন্তত তিনটি বড় ঝুঁকি সামনে চলে আসবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। এগুলো হলো—

  • কঠোর নিষেধাজ্ঞা : ১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লবের পর থেকে ইরানের বিরুদ্ধে নানা নিষেধাজ্ঞা দিতে থাকে যুক্তরাষ্ট্র। ২০০৫ সালের পর থেকে ইরান সম্পর্কিত ১,৫০০+ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। নতুন করে মার্কিন কিংবা জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা আরোপ হলে জনগণের ওপর চাপ আরও বাড়বে।
  • মিত্রদের সমর্থন হারানো : রাশিয়া ও চীনের মতো মিত্র দেশগুলোর পক্ষেও তখন ইরানকে প্রকাশ্য সমর্থন দেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। এনপিটি’র সদস্য হিসেবে তারা চাইবে না—নতুন কেউ পারমাণবিক শক্তিধর হোক।
  • ইসরাইলি ও মার্কিন হামলা : গত ১৩ ও ২২ জুন ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্র যৌথভাবে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালায়। তাদের অভিযোগ ছিল ইরান পরমাণু অস্ত্র বানানোর কাছাকাছি রয়েছে। আর যদি বোমা বানায়, তাহলে তারা সম্মিলিতভাবে হামলা চালাবে—এতে সন্দেহ নেই।


আন্তর্জাতিক চুক্তি ও দ্বিমুখিতা

ইরান ১৯৬৮ সালের পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি (এনপিটি)-এর সদস্য। সেই অনুযায়ী, তারা শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে পারমাণবিক শক্তি ব্যবহারের অধিকার রাখে। ২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত ‘জয়েন্ট কমপ্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন’ (জেসিপিওএ) অনুযায়ী, ইরান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ সীমিত রাখে এবং আইএইএ’র পরিদর্শনে সম্মতি দেয়। কিন্তু ২০১৮ সালে ট্রাম্প প্রশাসন একতরফাভাবে চুক্তি থেকে বেরিয়ে যায়, ফলে ইরানও কিছু সীমাবদ্ধতা শিথিল করে। তারা জেসিপিওএ-এর অধীনে সর্বোচ্চ ৩.৬৭% মাত্রায় সমৃদ্ধ করতে পারত। কিন্তু বর্তমানে ৬০ মাত্রার ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করছে। পরমাণু অস্ত্র তৈরি করতে ৯০ মাত্রায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করতে হয়।

ইরান পরমাণু বোমা বানানোর জন্য প্রয়োজনীয় মাত্রায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করছে না—জানা সত্ত্বেও ইসরাইল ও আমেরিকা জুন মাসে ইরানের পরমাণু স্থাপনায় হামলা চালায়। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ইরান আইএইএ’র নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে এবং সংস্থাটির সঙ্গে সম্পর্ক স্থগিত করে। সংস্থার প্রধান রাফায়েল গ্রোসির সফরের অনুরোধও প্রত্যাখ্যান করে।

ইরান কেন উচ্চমাত্রায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করছে?

যদিও ইরান সরকার পরমাণু অস্ত্র তৈরির বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছে এবং সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি একটি ধর্মীয় ফতোয়া জারি করে একে ‘হারাম’ ঘোষণা করেছেন, তথাপি দেশটি ৬০ শতাংশ পর্যন্ত ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ চালিয়ে যাচ্ছে। বিশ্লেষকরা একে চাপ প্রয়োগের কৌশল হিসেবে দেখছেন।

এই সমৃদ্ধকরণ ইরানের জন্য কয়েকটি কৌশলগত সুবিধা আনে। যেমন—আলোচনায় প্রভাব বাড়ানো, বিশেষ করে জেসিপিওএ চুক্তি পুনরুজ্জীবনের জন্য; প্রয়োজনে অল্প সময়ের মধ্যে অস্ত্র-মানের ইউরেনিয়াম তৈরির সক্ষমতা অর্জন; আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সমতা আনা, যেমন—ইসরাইলের পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডার ও সৌদি পারমাণবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার প্রেক্ষাপটে এবং জাতীয় মর্যাদা ও প্রতিরোধের প্রতীক হিসেবে পারমাণবিক প্রযুক্তি রক্ষা।

সুতরাং, বোমা বানানোর ঘোষণা না দিলেও, ইরান এমন একটি অবস্থান গ্রহণ করেছে যাতে প্রয়োজনে পারমাণবিক সক্ষমতা অর্জন করা যায় এবং এর মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজেদের অবস্থানকে শক্তিশালী করা সম্ভব হয়।

যুক্তরাষ্ট্র-ইসরাইলের দ্বিচারিতা

যুক্তরাষ্ট্র ইরানের পরমাণু কর্মসূচির বিরুদ্ধাচরণ করলেও ১৯৭৯ সালের বিপ্লবের আগে ওয়াশিংটন নিজেই তেহরানকে পারমাণবিক প্রযুক্তি সরবরাহ করেছিল। কিন্তু বিপ্লবের পর সেই ইরানকেই হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

অপরদিকে, ইসরাইল কখনোই এনপিটিতে স্বাক্ষর করেনি, কিন্তু ধারণা করা হয় তারা ৮০ থেকে ৪০০টি পারমাণবিক বোমার মালিক। কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থাই তাদের জবাবদিহির আওতায় আনে না। অথচ যুক্তরাষ্ট্র তেল আবিবকে সব ধরনের সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। এই দ্বিচারিতাকে বিশ্লেষক নোয়াম চমস্কি অভিহিত করেছেন : ‘যে অস্ত্র ইসরাইলের হাতে নিরাপত্তা, সেটি ইরানের হাতে হুমকি—এটাই বিশ্ব রাজনীতির ভণ্ডামি।’

শক্তি নয়, নীতি

ইরান জানে যে, পারমাণবিক বোমা কেবল নৈতিকভাবে নয়, কৌশলগতভাবেও আত্মঘাতী। তাই তারা অস্ত্রের নয়, নীতির পথ বেছে নিয়েছে। শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক প্রযুক্তির অধিকার আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এবং সেই অধিকার রক্ষাই ইরানের লক্ষ্য।

আন্তর্জাতিক সমাজের উচিত—এই অবস্থানকে সম্মান জানিয়ে কূটনৈতিক সমাধানে এগিয়ে আসা। চাপ নয়, সংলাপই পারে উত্তেজনার পথ থেকে বিশ্বকে ফিরিয়ে আনতে। একটি ন্যায্য ও নিরাপদ বিশ্ব গড়তে হলে দ্বিচারিতা নয়, চাই আন্তরিকতা ও সম্মানভিত্তিক অংশগ্রহণ।

লেখক পরিচিতি : সিনিয়র সাংবাদিক ও বিশ্লেষক, তেহরান রেডিও, ইরান

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম