Logo
Logo
×

আন্তর্জাতিক

আমরা মরছি বোমায় ক্ষুধায় আর অবহেলায়

Icon

ফিরাস আলসাদোনি

প্রকাশ: ২৫ জুলাই ২০২৫, ১০:২০ পিএম

আমরা মরছি বোমায় ক্ষুধায় আর অবহেলায়

ফিরাস আলসাদোনি

আমি ফিরাস আলসাদোনি। বয়স ২৮। আমার ছোট দুটি সন্তান আছে-লানা ও আমির। গাজার খান ইউনুস শহরের আল-মাওয়াসি শরণার্থী শিবির থেকে দুঃখে ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে আপনাদের কাছে লিখছি। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর যখন এই যুদ্ধ শুরু হয় তখন থেকেই আমার জীবন সম্পূর্ণভাবে ভেঙে পড়েছে। আমি আমার পরিবারের (পিতৃকূল) ১৮ জনকে হারিয়েছি। যাদের মধ্যে আমার বাবাও ছিলেন। তিনি ছিলেন আমার সবকিছু। বর্বর  ইসরাইল আমার জীবনের সব সুখ-শান্তি কেড়ে নিয়েছে। আমি ছিলাম ট্যাক্সিচালক। যুদ্ধের আগে খান ইউনিস থেকে শুরু করে সারাদিন গাজার শহরে শহরে ঘুরতাম যাত্রী নিয়ে। আমার সুন্দর গাড়িটাই ছিল সারাদিনের সঙ্গী। দিন শেষে বাড়ির দিকে ছুটতাম ঘরে ফেরার টানে। সেই আমিই এখন শরণার্থী শিবিরে! রন্ধনশালার রাধুনি (স্বেচ্ছাশ্রম)! ত্রাণসংস্থার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি-কখন জুটবে একবেলার খাবার!

খুব বেশি দরিদ্র ছিলাম না আমরা। খান ইউনুসে আমাদের সাজানো তিনটি বাড়ি ছিল। যুদ্ধের প্রথম মাসেই আমাদের একটি বাড়ি ধ্বংস হয়ে যায়। এরপর ইসরাইলি বাহিনী আমাদের এলাকা ছেড়ে যেতে বাধ্য করে। সেসময়েই বিমান হামলা চালিয়ে আমাদের বাকি দুটি বাড়ি ও আমার গাড়িটিও ধ্বংস করে। ওই গাড়িটিই ছিল আমার আয়ের একমাত্র উৎস। বাড়িঘর হারানোর পর আমরা বাধ্য হয়ে একটি তাঁবুতে থাকতে শুরু করি। যেটা শীতকালে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা আর গ্রীষ্মকালে অসহনীয় গরম। দুর্ভাগ্যবশত, কিছুদিন আগে, আমি আমার বাবাকে হারিয়েছি। তিনি মাত্র ৫৫ বছর বয়সে চিকিৎসার অভাবে মারা গেলেন। সেদিন থেকে জীবনে যেন আরও অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। আমি পরিবারের বড় ছেলে হওয়ায় এখন সব দায়িত্ব এসে পড়েছে আমার কাঁধে। আমার মেয়ে লানা, মাত্র তিন বছর বয়সি। সে ন্যূনতম খাদ্য কিংবা প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রটুকুও পাচ্ছে না। টাকার অভাবে আমি ওকে কিছু কিনে দিতে পারি না। সেটা বলতেও আমার লজ্জা লাগে। কিছুদিন আগে আমার ছেলের জন্ম হয়েছে। একটি নবজাতকের প্রয়োজনীয় যত্ন, খাবার এবং অন্যান্য জিনিসের কোনো কিছুই আমি জোগাড় করতে পারি না। কারণ এখন সবকিছুই দুষ্প্রাপ্য। যা পাওয়া যায় তার দামও ধরাছোঁয়ার বাইরে।

সেই আমিই এখন শরণার্থী শিবিরে! রন্ধনশালার রাধুনি! ত্রাণসংস্থার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি-কখন জুটবে একবেলার খাবার! 

আমার চারজন ভাইবোন আছে। আমার বোন ২৭ বছর বয়সি। যুদ্ধের সময় বিয়ে হয়েছে এবং কিছুদিন আগে তার প্রথম সন্তানের জন্ম হয়েছে। কিন্তু সে তার সন্তানের যত্ন নিতে পারছে না। কারণ কিছুই তার হাতের নাগালে নেই। আমার ভাই মোহাম্মদ আলসাদোনি, বাংলাদেশের ফরিদপুর মেডিকেল কলেজে চিকিৎসাশাস্ত্রে পড়াশোনা শেষ করেছে। এখন ইন্টার্নশিপ করছে। রাফাহ সীমান্ত বন্ধ থাকায় সে গাজায় ফিরে আসতে পারছে না। ইন্টারনেট ও ফোন লাইনের দুরবস্থার কারণে আমরা তার সঙ্গে যোগাযোগও করতে পারি না ঠিকমতো। আমার আরেক ভাই আলী। বয়স ২৪। তার বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া শেষ করতে পারেনি। এই যুদ্ধের কারণে গত দুই বছর সে কোনো ক্লাসে যেতে পারেনি। প্রতিদিন সে দুঃস্বপ্ন দেখে, হয়তো তার ভবিষ্যৎ এবং স্বপ্ন সব শেষ হয়ে যাবে।

ফিরাস আলসাদোনি

সবার ছোট ভাই আহমাদ। যার বয়স ১৯। ছোট থেকেই ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখত। কিন্তু যুদ্ধের কারণে এখনও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষাটিও দিতে পারেনি সে। গাজার জীবন নিয়ে নতুন করে আর বলার কিছু নেই। কারণ এখন তো সারা দুনিয়াই জানে গাজার ভয়াবহ বাস্তবতা। আমরা আমাদের প্রিয় মানুষদের হারিয়েছি, আমাদের তিনটি বাড়ি হারিয়েছি, আমাদের স্বপ্ন, আমাদের সুখের স্মৃতিও হারিয়েছি। প্রতিদিনই আমরা কিছু না কিছু হারাচ্ছি।

দুর্ভাগ্যবশত, কিছুদিন আগে, আমি আমার বাবাকে হারিয়েছি। মাত্র ৫৫ বছর বয়সে চিকিৎসার অভাবে মারা গেলেন। সেদিন থেকে জীবনে যেন আরও অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। আমি পরিবারের বড় ছেলে হওয়ায় এখন সব দায়িত্ব এসে পড়েছে আমার কাঁধে। অথচ টাকার অভাবে আমি ছোট্ট মেয়েটিকেও কিছু কিনে দিতে পারি না! সেটা বলতেও আমার লজ্জা লাগে!

গত কয়েক মাস ধরে গাজায় কোনো সহায়তা প্রবেশ করতে পারছে না। আমরা অনাহারে দিন কাটাচ্ছি। যুদ্ধের এ সময়ে কোনো কাজ নেই, কোনো আয় নেই। প্রতিটি জিনিসের দাম আকাশচুম্বী। আমার পরিবারকে ক্ষুধার্ত দেখতে দেখতে আমিও একেবারে অসহায় হয়ে পড়েছি। আমি যখন বাজারে যাই, হয় সবকিছু খালি পাই, অথবা অল্প কিছু জিনিস পাওয়া যায় যেগুলোর দাম এতটাই বেশি যা চিন্তাও করা যায় না। যুদ্ধের আগে এক বস্তা ময়দা (২৫ কেজি) ছিল ৫০ শেকেল (১৫ ডলার), এখন তার দাম ৪৫০০ শেকেল (১৫০০ ডলার)। ১ কেজি চিনি যুদ্ধের আগে ছিল মাত্র ৩ শেকেল (১ ডলার), এখন সেটা ২৫০ শেকেল (৮০ ডলার)। আর বাকি জিনিসগুলোর কথা তো বলাই বাহুল্য। বাবাকে হারানোর পর থেকে পুরো পরিবারের দায়িত্ব আমার কাঁধে। প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা হেঁটে পানি জোগাড় করি। তারপর নতুন করে খাবারের খোঁজে শুরু হয় আমার যাত্রা। আমরা প্রতিদিনই মরছি বোমাবর্ষণ, ক্ষুধা আর অবহেলোয়।

লেখক: ট্যাক্সিচালক, আল-মাওয়াসি শরণার্থী শিবির, খান ইউনিস, গাজা

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম