Logo
Logo
×

আন্তর্জাতিক

ভারতে বাংলাভাষীদের হেনস্তা নিয়ে এবার সোচ্চার গণমাধ্যম

Icon

কলকাতা প্রতিনিধি

প্রকাশ: ১১ আগস্ট ২০২৫, ১২:১৯ এএম

ভারতে বাংলাভাষীদের হেনস্তা নিয়ে এবার সোচ্চার গণমাধ্যম

ভারতের আহমেদাবাদে ২০২৫ সালের ২৬ এপ্রিল অভিযানের সময় গ্রেফতারের পর কথিত অনথিভুক্ত বাংলাদেশি নাগরিকদের আটক করছে পুলিশ সদস্যরা। © ২০২৫ অমিত দাভে/রয়টার্স

বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি ভোটার তালিকার বিশেষ শুদ্ধীকরণ প্রক্রিয়া শুরু করেছে ভারতের জাতীয় নির্বাচন কমিশন। সরকারিভাবে ‘স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিশন’ নামে পরিচিত এ উদ্যোগের উদ্দেশ্য ভোটার তালিকা থেকে ভুয়া নাম বাদ দেওয়া এবং অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের শনাক্ত করা। কিন্তু বিভিন্ন রাজ্যে বাংলায় কথা বলা পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দাদের আটক করে বাংলাদেশি সন্দেহে হয়রানি করায় এ উদ্যোগ তীব্র বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। রাজস্থান, দিল্লি­, উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা, ওড়িশাসহ একাধিক রাজ্য থেকে এমন অভিযোগ উঠেছে। অনেক ক্ষেত্রে বৈধ আধার, ভোটার আইডি, রেশন কার্ড থাকা সত্ত্বেও শুধু ভাষার ভিত্তিতে লোকজনকে সন্দেহ করা হচ্ছে।

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ পরিস্থিতিকে সাংবিধানিক অধিকার ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের ওপর আঘাত বলে উলে­খ করেছেন। কলকাতা থেকে শুরু করে শিলিগুড়ি পর্যন্ত তিনি একাধিক ভাষা রক্ষা মিছিলের নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং সম্প্রতি বলেছেন, ‘বাংলা ভাষা আমাদের পরিচয়ের মেরুদণ্ড। বাংলায় কথা বললেই যদি বাংলাদেশি তকমা দেওয়া হয়, তবে তা দেশের ঐক্যের জন্য বিপজ্জনক।’ 

তিনি ইতোমধ্যে দোকান ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে বাংলা সাইনবোর্ড বাধ্যতামূলক করেছেন, তৃণমূল সংসদ-সদস্যদের নিয়ে সংসদের ভেতর ও বাইরে প্রতিবাদ করেছেন এবং বিরোধী জোট ‘ইনডিয়া’র বৈঠকে এ ইস্যু উত্থাপন করেছেন। তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় সতর্ক করে বলেছেন, ‘বাংলা ভাষাভাষী মানেই বাংলাদেশি এমন প্রচার মানুষের মধ্যে বিভেদ তৈরি করছে।’

এই বিতর্কে জাতীয় সংবাদমাধ্যমও সরব হয়েছে। এনডিটিভির বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অবৈধ অনুপ্রবেশ রোধের নামে বৈধ নাগরিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। দ্য হিন্দু তাদের বিশ্লেষণে উলে­খ করেছে, ভাষার ভিত্তিতে নাগরিকত্ব যাচাই সাংবিধানিক নীতির পরিপন্থি। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস ও হিন্দুস্তান টাইমসও একাধিক ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দাদের আটক হওয়ার ঘটনা তুলে ধরেছে। পিটিআই-এর রিপোর্ট বলছে, গত তিন মাসে উত্তরপ্রদেশ, দিল্লি­ ও রাজস্থানে অন্তত ৪৭ জন বাংলাভাষী শ্রমিককে আটক করে বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছে, যাদের মধ্যে ১৯ জনের পশ্চিমবঙ্গের বৈধ নথি ছিল। এএনআই-এর মাঠপর্যায়ের রিপোর্টে উঠে এসেছে দিলি­তে কাজ করা হুগলির এক তরুণের কাহিনি বাংলাদেশি সন্দেহে ১০ দিন আটক থাকার পর প্রমাণিত হয় তিনি পশ্চিমবঙ্গের নাগরিক।

বিষয়টি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমেও আলোচনায় এসেছে। বিবিসি জানিয়েছে, ভারতে বাংলাভাষীদের আটক বিরোধীদের অভিযোগ অনুযায়ী সাংস্কৃতিক বৈষম্যের পরিচয়। আলজাজিরা মমতা ব্যানার্জির বক্তব্য উদ্ধৃত করে বলেছে, এটি সাংস্কৃতিক দমননীতি। দ্য গার্ডিয়ান লিখেছে, ভারতের কিছু রাজ্যে ভাষার ভিত্তিতে পরিচয় যাচাই দেশের বহুত্ববাদী চিত্রের জন্য ক্ষতিকর। ডয়চে ভেলে সতর্ক করেছে, দক্ষিণ এশিয়ায় ভাষা ও পরিচয় সংবেদনশীল বিষয়, এ প্রবণতা নতুন উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে। নিউইয়র্ক টাইমস বাংলা ভাষাকে বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধ ভাষা বলে উলে­খ করে প্রশ্ন তুলেছে, কেন তার বক্তাদের নিয়ে সন্দেহের দৃষ্টিভঙ্গি বাড়ছে।

বিরোধী জোট ‘ইনডিয়া’ এ ঘটনাকে সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘন বলে অভিযুক্ত করছে। কংগ্রেস, ডিএমকে, সমাজবাদী পার্টিসহ একাধিক দল বিজেপিকে উদ্দেশ্যমূলক বিভাজনমূলক রাজনীতির অভিযোগে অভিযুক্ত করেছে। বিজেপি অবশ্য দাবি করছে, তাদের অভিযান কেবল অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে, ভাষার সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে স্পষ্ট হয়ে উঠছে বাংলায় কথা বলার কারণে অনেক বৈধ নাগরিক অযথা ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন।

এই প্রেক্ষাপটে বাংলা ভাষা রক্ষার আন্দোলন এখন শুধু পশ্চিমবঙ্গের নয়, ভারতের বহুত্ববাদ, সাংবিধানিক অধিকার ও গণতন্ত্রের ভবিষ্যতের প্রশ্নে পরিণত হয়েছে। আন্তর্জাতিক ও জাতীয় গণমাধ্যমের নজরে এসেছে এই বিতর্ক; ফলে স্পষ্ট যে এ লড়াই আঞ্চলিক সীমানা পেরিয়ে এক সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রতিরোধের রূপ নিচ্ছে, যেখানে প্রশ্ন একটাই বাংলা ভাষাভাষী মানেই কি বাংলাদেশি? নাকি এ কেবল এক বিভাজনের রাজনীতি?

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম