ইরানি ঐক্যের দেয়ালে ধাক্কা খেল পশ্চিমা-ইসরাইলি ষড়যন্ত্র
প্রকাশ: ১৭ আগস্ট ২০২৫, ০৬:৫১ পিএম
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
যুক্তরাষ্ট্র,ইসরাইল ও ইউরোপ ত্রয়ী বহু বছর ধরে ইরানে ইসলামি সরকারব্যবস্থা পরিবর্তনের চেষ্টা চালিয়ে আসছে। কিন্তু এই প্রকল্পে ইরানি জনগণের উল্লেখযোগ্য কোনো সমর্থন মেলেনি।
গত জুনে সংঘটিত ১২ দিনের যুদ্ধে পরাজয়ের পর ইসরাইল ও তার পশ্চিমা মিত্ররা যখন মনস্তাত্ত্বিক প্রচারণা চালিয়ে ইরানকে দুর্বল করার চেষ্টা করছে, তখন একজন সাবেক ইসরাইলি কর্মকর্তা গুরুত্বপূর্ণ একটি স্বীকারোক্তি দিয়েছেন।
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাবেক গবেষক ইহুদ এয়লাম সম্প্রতি বিবিসি ফার্সিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেছেন, “ইসরাইল ইরানে পরিবর্তন চাইছে, কিন্তু তা ঘটানোর সামর্থ্য আমাদের নেই।” তার এই বক্তব্য সরকারবিরোধী প্রকল্পগুলোর ব্যর্থতায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বিশেষত গত কয়েক দিনে, ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ইরানি জনগণকে রাস্তায় নেমে আসার আহ্বান জানিয়েছেন এবং দেশের ভেতরে সামাজিক বিভাজন উসকে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।
পানি চলমান সংকটকে পুঁজি করে গত ১২ আগস্ট এক ভিডিওবার্তায় ইরানিদের উদ্দেশে নেতানিয়াহু বলেছেন, আপনাদের দেশ মুক্ত হলেই ইসরাইলি পানি বিশেষজ্ঞরা প্রতিটি ইরানি শহরে আসবে এবং আপনাদের পানি সমস্যা সমাধান করবে।
নেতানিয়াহুর এমন উস্কানিমূলক বক্তব্য সম্পর্কে ইহুদি এয়লাম বিবিসি ফার্সিকে বলেছেন,ইরানে শাসন পরিবর্তনে ইসরাইলের কৌশল শুধু অকার্যকরই নয়, বরং অবাস্তবায়নযোগ্যও বটে। তার স্বীকারোক্তি: “আমরা সরকার পরিবর্তন চাই, কিন্তু ইরানে বিপ্লব ঘটানোর জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান আমাদের নেই।”
এর আগে নিউইয়র্ক টাইমস লিখেছিল: “ইসরায়েল সাইবার টুলস ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে ইরানে বেসামরিক অসন্তোষ বাড়ানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু এর বাস্তব প্রভাব সীমিত।”
একইভাবে আল-মনিটর জানিয়েছিল: “নেতানিয়াহুর আহ্বানগুলো মাঠ পর্যায়ে কার্যকরী প্রভাবের চেয়ে বেশি প্রচারণা ও মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের অংশ।”
এয়লাম আরও বলেন, “ইরানে বিরোধীদলগুলোর অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। এমন কোনো নেতা বা প্রতিষ্ঠান নেই যা জনগণকে সংগঠিত করতে পারে, যদিও ইসরায়েল এসব দলের সঙ্গে যোগাযোগ ও সহযোগিতা রাখে।”
এই মন্তব্য বিদেশভিত্তিক ইরানি বিরোধীদের নাজুক অবস্থার বাস্তব চিত্র তুলে ধরে। কিছুদিন আগে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল লিখেছিল: “ইরানে বিরোধীগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে গভীর বিভাজন তাদের জনগণের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করার ক্ষমতাকে মারাত্মকভাবে সীমিত করেছে। এমন কোনো সর্বজনগ্রাহ্য ও ক্যারিশম্যাটিক নেতা নেই, যিনি ইরানি জনগণকে ঐক্যবদ্ধভাবে সরকারের বিরুদ্ধে সংগঠিত করতে পারবেন।”
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, এই সাবেক ইসরায়েলি গবেষক প্রকাশ্যে বলেছেন যে, ইসরায়েল বিরোধীদলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ ও সহযোগিতা করছে।
এর আগে রয়টার্স ও টাইমস অব ইসরায়েল–এর প্রতিবেদনেও এমন তথ্য ওঠে এসেছে। কিন্তু আসল বিষয় হলো,এই সহযোগিতার প্রকৃতি—যেখানে ইসরায়েল এমন গোষ্ঠীগুলোর ওপর নির্ভর করছে যারা নিজেরাই দুর্বলতা, দেশে যাদের কোনো সমর্থন নেই।
গত কয়েক মাসে টাইমস অব ইসরায়েল লিখেছে: “ইসরায়েল গোপনে বিদেশভিত্তিক বিরোধী দলের কিছু শাখার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে, যাতে বিক্ষোভের ঢেউ তোলা যায়; কিন্তু এর বাস্তব ফলাফল খুবই সীমিত।”
রয়টার্সও লিখেছিল: “কিছু ইরানবিরোধী ব্যক্তির সঙ্গে ইসরায়েলের যোগাযোগ ছিল মূলত গোয়েন্দা তথ্য বিনিময় পর্যন্ত সীমাবদ্ধ, মাঠপর্যায়ে বিক্ষোভ পরিচালনার মতো কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল না।”
ইরানের বাইরে থেকে সরকার পরিবর্তনের নীতি সবসময় গভীর চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। সাম্প্রতিক দশকের অভিজ্ঞতা প্রমাণ করেছে—সামাজিক ভিত্তির অভাব, দুর্বল সংগঠন, মতাদর্শগত বিভেদ এবং ইরানি সরকারের দ্রুত ও কৌশলী প্রতিক্রিয়া—সব মিলিয়ে এসব প্রকল্পকে ব্যর্থ করেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল ও বিরোধী গোষ্ঠীগুলোর সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো—ইরানি সমাজের বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা। পশ্চিমা-ইসরায়েলি দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তবসম্মত নয়, কারণ মাঠপর্যায়ের বাস্তবতা পশ্চিমা গণমাধ্যমে আঁকা চিত্র থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।

ইরানে ইসরাইলি হামলায় শহীদদের ছবি হাতে বিক্ষোভে অংশ নেন সর্বস্তরের জনতা
সম্প্রতি ইসরাইলি জাতীয় নিরাপত্তা গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইএনএসএস) জানিয়েছে, “ইরানের পরিস্থিতি জটিল ও বহুমাত্রিক; জনগণকে উসকানি দেওয়ার ক্ষেত্রে ইসরায়েলের ভূমিকা অত্যন্ত দুর্বল।”
যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল ও ইউরোপ ত্রয়ী বহু বছর ধরে ইরানে সরকার পরিবর্তনের চেষ্টা চালিয়ে গেলেও, এই প্রকল্পের ইরানি সমাজে কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই।
বাস্তবতা হলো—ইরানি জাতীয়তাবাদ ও ইসলামি চেতনার মিশ্রণে জনগণের মধ্যে প্রতিরোধ, স্বাধীনতা ও ঔপনিবেশিকবিরোধী মনোভাব গভীরভাবে প্রোথিত হয়েছে। যেকোনো সুর বা উসকানি যা এই ধারা বিরোধী, তা জনগণের তীব্র সমালোচনা ও প্রতিক্রিয়ার মুখে পড়ে।
এবারের যুদ্ধেও, ইসরাইলি আগ্রাসনের মাত্র কয়েক ঘন্টা পর, ৩০ লাখ ইরানি রাস্তায় নেমে জাতীয় ঐক্য ও সংহতি প্রকাশ করে। যুদ্ধ শুরুর ১১ দিন পর যখন মার্কিন বিমানবাহিনী ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোকে লক্ষ্য করে আক্রমণ করে, তখন হাজার হাজার ইরানি সমগ্র ইরানজুড়ে রাস্তায় নেমে এসে তাদের সরকারের প্রতি সমর্থন ঘোষণা করে।
ইরানিদের জাতীয় পরিচয় কেবল ভৌগোলিক বা জাতীয়তার উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত নয়, বরং হাজার হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সভ্যতার মধ্যে প্রোথিত। ইরানিরা অনেক প্রাচীন সভ্যতার অধিকারী হওয়ায় বিষয়টি বর্তমান প্রজন্মকেও ঐতিহাসিক ইরানের প্রতি গর্ব এবং দায়িত্ববোধের অনুভূতি জাগায়।

