Logo
Logo
×

আন্তর্জাতিক

ইসরাইলের কৌশল পরিবর্তন: ‘ঘাস কাটা’ থেকে ‘চূড়ান্ত বিজয়’

Icon

মোহাম্মদরেজা মোরাদি

প্রকাশ: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১০:৫৩ পিএম

ইসরাইলের কৌশল পরিবর্তন: ‘ঘাস কাটা’ থেকে ‘চূড়ান্ত বিজয়’

মোহাম্মদরেজা মোরাদি। ছবি: মেহের নিউজ এজেন্সি

মধ্যপ্রাচ্যে একটি আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে জায়নবাদী শাসন বহু দশক ধরে নিরাপত্তা হুমকি মোকাবিলা ও নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখার জন্য বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেছে। এর মধ্যে একটি কৌশল ছিল ‘মোয়িং দ্য গ্রাস’ বা ‘ঘাস কাটা” মডেল। এই পদ্ধতির মাধ্যমে তারা সীমিত ও পর্যায়ক্রমিক সামরিক অভিযান চালিয়ে প্রতিপক্ষকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করত। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের ‘আল-আকসা ফ্লাড’ অভিযানের আগে পর্যন্ত এই কৌশল কার্যকর ছিল। এর উদ্দেশ্য ছিল আল-কুদস শাসনের স্বার্থ রক্ষার জন্য বর্তমান অবস্থা বজায় রাখা। তবে ওই তারিখের পরবর্তী ঘটনাবলি ইঙ্গিত করছে যে জায়নবাদী শাসনের পররাষ্ট্রনীতিতে একটি মৌলিক পরিবর্তন এসেছে—‘সংযম’ কৌশল থেকে সরে গিয়ে তারা ‘সম্পূর্ণ বিজয়’ নীতি গ্রহণ করেছে এবং আঞ্চলিক কাঠামো নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করছে।

‘ঘাস কাটা’ মডেল কী

‘ঘাস কাটা’ মডেলটি জায়নবাদী সামরিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মধ্যে জনপ্রিয় ছিল। এর মূল কথা হলো—হামাস ও হিজবুল্লাহর মতো প্রতিরোধ সংগঠনের বিরুদ্ধে সীমিত ও নিয়মিত হামলা চালানো, যাতে হুমকির ‘লম্বা ঘাস’ কিছুটা ছাঁটা যায়, তবে আঞ্চলিক কাঠামোতে মৌলিক পরিবর্তন আনা না হয়। এই কৌশলটি সম্পর্কেওয়াশিংটন পোস্ট-এর অ্যাডাম টেলর লিখেছিলেন, গাজা উপত্যকার ফিলিস্তিনি যোদ্ধারা ও তাদের তৈরি অস্থায়ী অস্ত্রশস্ত্র হলো আগাছার মতো, যেগুলো নিয়মিত ছেঁটে ফেলা দরকার। ২০১৮ সালে ইসরাইলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেট বলেছিলেন, যে ঘাস কাটে না, ঘাসই তাকে গ্রাস করে।

অক্টোবর ২০২৩-এর আগে পর্যন্ত এই নীতি কার্যকর ছিল। এটি মূলত বিমান হামলা, লক্ষ্যভিত্তিক হত্যাকাণ্ড এবং সীমিত স্থল অভিযানের মাধ্যমে পরিচালিত হতো, যাতে বড় আকারের সংঘাত না ছড়িয়ে পড়ে। উদাহরণস্বরূপ, ২০০৮, ২০১২ ও ২০১৪ সালে গাজায় ইসরাইলের হামলা এই কৌশলেরই নমুনা। এসব অভিযানের লক্ষ্য ছিল হামাসের সামরিক সক্ষমতা দুর্বল করা এবং ভয় দেখিয়ে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। দখলদার বাহিনীর বিশ্বাস ছিল—এই পদ্ধতিই তাদের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ। তবে এটি কেবল সাময়িক স্থিতিশীলতা আনতে পেরেছিল। এর ব্যর্থতা প্রমাণিত হয় ২০২৩ সালের অক্টোবরে, যখন হামাস অভূতপূর্ব আক্রমণ চালিয়ে বিপুলসংখ্যক জায়নবাদীকে হত্যা বা আটক করে।

এই কৌশল থেকে ইসরাইলের সরে আসার কারণ

৭ অক্টোবরের পর থেকে দেখা যাচ্ছে, ‘ঘাস কাটা’ কৌশল থেকে সরে গিয়ে ইসরাইল ‘চূড়ান্ত বিজয়’ নীতি গ্রহণ করেছে। ‘আল-আকসা ফ্লাড’ ছিল এক মোড় পরিবর্তনকারী ঘটনা, যা পুরোনো কৌশলকে অকার্যকর প্রমাণ করে এবং নেতানিয়াহুকে নতুন নীতি গ্রহণে বাধ্য করে। এই নতুন কৌশলের লক্ষ্য হলো—শত্রুদের সম্পূর্ণ ধ্বংস করা এবং আঞ্চলিক শৃঙ্খলাকে জায়নবাদী স্বার্থে পুনর্গঠন করা। এর আওতায় গাজায় হামাস, লেবাননে হিজবুল্লাহ, ইয়েমেনে আনসারুল্লাহ, ইরান ও সিরিয়ায় একযোগে সামরিক অভিযান চালানো হয়েছে। সিরিয়ার দক্ষিণাঞ্চলের দখল, লেবাননে পুনঃপুন আক্রমণ ও ইরানে হামলা এই নীতিরই অংশ। নেতানিয়াহুর মতে, জায়নবাদী স্বার্থে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা সৃষ্টি করাই এই নীতির প্রধান লক্ষ্য। তিনি এমনকি ‘গ্রেটার ইসরাইল’-এর মতো বড় স্বপ্নের কথাও বলেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিরিয়া দূত থমাস ব্যারাক সম্প্রতি বলেছেন, ৭ অক্টোবরের পর থেকে ইসরাইল সীমান্ত নিয়ে নতুন ধারণা পোষণ করছে এবং সাইকস-পিকো চুক্তির সীমানাকে ‘অর্থহীন’ মনে করছে। এক পডকাস্ট সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, ইসরাইলিরা এখন বিশ্বাস করে, নিজেদের রক্ষা করতে হলে যেখানে প্রয়োজন, তারা সেখানেই যাবে।

তবে এই নতুন কৌশলের ফল হয়েছে আঞ্চলিক বিশৃঙ্খলা। লেবানন, ইয়েমেন ও সিরিয়ায় উত্তেজনা বেড়েছে। নেতানিয়াহুর এই নীতি স্থিতিশীলতা নয় বরং ধ্বংস ও দখলদারিত্বকে উসকে দিয়েছে। গাজায় দখলদার বাহিনীর হামলায় এখন পর্যন্ত ৬৩ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। লেবাননে হামলার ফলে হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে হিজবুল্লাহ মহাসচিব সাইয়্যেদ হাসান নাসরাল্লাহর হত্যাকাণ্ডও রয়েছে।

নতুন কৌশলে ইসরাইল কতটুকু সফল

যদিও কিছু কৌশলগত সাফল্য এসেছে, তবে এই নীতি কৌশলগতভাবে ব্যর্থ হয়েছে। আব্রাহাম চুক্তির মাধ্যমে যারা আগে ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণে এগোচ্ছিল, সেই আরব দেশগুলো এখন এটিকে বড় কৌশলগত ঝুঁকি মনে করছে। বিশেষত সৌদি আরব, যা ২০২৩ সালের অক্টোবরের আগে স্বাভাবিকীকরণের দ্বারপ্রান্তে ছিল, গাজা যুদ্ধ ও ব্যাপক জনমতের চাপে অবস্থান পরিবর্তন করেছে এবং ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকে শর্ত করেছে। ওয়াশিংটন পোস্ট-এর রিপোর্টে বলা হয়েছে, ১২ দিনের যুদ্ধ ও ইরানে হামলার পর এসব দেশ একতরফা জায়নবাদী কর্মকাণ্ড থেকে দূরে সরে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার ওপর জোর দিচ্ছে।

উল্লেখযোগ্য হলো—ইসরাইলের ব্যাপক হামলার পরও ইরান, হিজবুল্লাহ, আনসারুল্লাহ ও হামাসের মতো শক্তিরা এখনো টিকে আছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আন্তর্জাতিক চাপ—ইউরোপীয় দেশগুলোর ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার উদ্যোগ এবং ইসরাইলের আন্তর্জাতিক বৈধতার সংকট। এসবই নেতানিয়াহুর পরিকল্পনাকে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে।

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশিষ্ট তাত্ত্বিক স্টিফেন ওয়াল্ট নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ বিশ্লেষণে লিখেছেন—মধ্যপ্রাচ্যে সবকিছু বদলালেও আসলে কিছুই বদলায়নি। তার মতে, ইসরাইল শত্রুদের দুর্বল করতে পেরেছে বটে, কিন্তু আঞ্চলিক শৃঙ্খলা এখনো পুরোনো দ্বন্দ্ব এবং অমীমাংসিত ফিলিস্তিন প্রশ্নের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। আসাদের পতন, প্রতিরোধ অক্ষের দুর্বলতা এবং ইরানে হামলা সত্ত্বেও কোনো স্থিতিশীল আঞ্চলিক ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। ওয়াল্ট জোর দিয়ে বলেন—ফিলিস্তিন প্রশ্নের রাজনৈতিক সমাধান ছাড়া নেতানিয়াহুর নতুন আঞ্চলিক শৃঙ্খলার স্বপ্ন কখনোই বাস্তবায়িত হবে না।

সবশেষে বলা যায়, নেতানিয়াহুর নেতৃত্বে ‘ঘাস কাটা’ কৌশল থেকে ‘চূড়ান্ত বিজয়’ কৌশলে ইসরাইলের এই পরিবর্তন মধ্যপ্রাচ্যকে পুনর্গঠনের উচ্চাকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে। তবে এই নীতি আঞ্চলিক বিশৃঙ্খলা, কূটনৈতিক বিচ্ছিন্নতা ও শত্রুদের টিকে থাকার কারণে কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। আরব দেশগুলো এখন স্বাভাবিকীকরণকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করছে। স্টিফেন ওয়াল্টের বিশ্লেষণও নিশ্চিত করছে যে ফিলিস্তিন প্রশ্নে মৌলিক পরিবর্তন না এলে নতুন কোনো মধ্যপ্রাচ্য শৃঙ্খলা আসবে না। বরং নেতানিয়াহুর এই সংশোধিত নীতি বিজয়ের পথ তৈরি না করে বরং আঞ্চলিক সংকটকে আরও গভীর করেছে।

লেখক: মোহাম্মদরেজা মোরাদি, মহাপরিচালক, আন্তর্জাতিক ও বৈদেশিক সংবাদ বিভাগ, মেহর নিউজ এজেন্সি

অনুবাদ: খালিদ হাসান

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম