‘সৃষ্টিশীল সাহিত্যে নিগূঢ়ভাবে মননশীলতা বিরাজ করে’
জুননু রাইন
প্রকাশ: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০৬:৫৩ পিএম
ছবি: যুগান্তর
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
শাহাজাদা বসুনিয়া জন্ম ৪ মে ১৯৬৫ সালে কুড়িগ্রাম জেলার রাজারহাট থানাধীন নাজিম খাঁ ইউনিয়নের মনারকুটি গ্রামে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে এমএ।
কর্মজীবনে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ১০ বছর শিক্ষকতা পেশায় জড়িত ছিলেন। পরে ব্যাংকিং পেশায়।
তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হলো : A secret of A War Baby, Top Ten Ghosts, Love in Teary Eyes, A Credit Card, An Expatriate, A Cruel Father ইংরেজি ভাষায় লেখা উপন্যাস।
কাব্য: দর্পণে তুমি, জলতরঙ্গের ছোঁয়া, সাতকাহন, অশরীরী আত্মার ক্ষোভ-বিক্ষোভ।
উপন্যাস: জাগিয়া উঠিল প্রাণ, চন্দ্রা-মণি; প্রবন্ধ : দেশে দেশে জাতীয় কবি। অনুবাদ : চীনা সাহিত্য।
তিনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টির দেদীপ্যমানতায় সাহিত্যচর্চা করেন। মানুষের দুঃখ-সুখ, সামাজিক বৈষম্যতা, চির-চলিষ্ণু জগতের কথা তার গ্রন্থে তুলে ধরেছেন। সাহিত্য রচনা তার পেশা নয়, বরং নেশার জন্য তার লেখালেখি। সাহিত্যিক হায়দার বসুনিয়া তার পিতা এবং মাতা সায়মা বেগম।
তার সাহিত্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য উপযুক্ত শব্দ চয়ন, শব্দ ও বাক্যের সাবলীলতা। শাশ্বত সত্যকে পাঠকের সামনে তুলে ধরার লক্ষ্যে তিনি সাহিত্যচর্চা অব্যাহত রেখেছেন।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন: জুননু রাইন
যুগান্তর: স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলা সাহিত্যে বিশেষ কী ধরনের পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছেন?
শাহাজাদা বসুনিয়া: স্বাধীনতার আগের বাংলা সাহিত্যে আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট অধিকভাবে পরিলক্ষিত। মানুষের অভাব-অনটন, বাল্যবিবাহ, সংঘর্ষ সংঘাত, মারামারি-কাটাকাটি, নদীভাঙন, খরা-বন্যাই সাহিত্যের মূল উপজীব্য বিষয় ছিল।
স্বাধীনতা পরবর্তীতে বাংলা সাহিত্যের উপজীব্য বিষয় অনেকটাই পরিবর্তিত হয়েছে। ধীরে ধীরে বাংলা সাহিত্যের প্রেক্ষাপট শহরকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে। ক্ষুধা-দারিদ্র্যের প্রকোপ কমে আধুনিক বিষয়বস্তুই ফুটে উঠেছে। ক্ষুধাপতিত কাহিনির পরিবর্তে আধুনিক শহরভিত্তিক কাহিনিতে প্রেম-বিরহ-জালিয়াতির ধরন ও কৌশলের চিত্রে আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। গ্রাম বাংলার চিত্র স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলা সাহিত্যে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে।
যুগান্তর: আপনার বিবেচনায় স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলা সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য কোনো সাহিত্য আন্দোলন হয়েছে। আর যদি না হয়ে থাকে, এমন কোনো আন্দোলন গড়ে ওঠা দরকার আছে কি?
শাহাজাদা বসুনিয়া: আমার জানামতে স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলা সাহিত্যে কোনো ধরনের আন্দোলন তৈরি হয়নি। দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা ক্রমান্বয়ে ভালো হওয়ায় সাহিত্যে কোনো ধরনের ধারালো বিষয়বস্তুর অবতারণা করার প্রয়োজন পড়েনি।
সমাজ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্যে বাদ-প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। রবিঠাকুর-নজরুল সাহিত্যে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের চিত্র জোরালোভাবে ঝংকৃত হয়েছিল। কিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলা সাহিত্যে সব প্রেক্ষাপট ভালো ও স্বাভাবিক হওয়ায় সাহিত্যে কোনো ধরনের প্রভাব নেই।
আমি মনে করি কোনো আন্দোলনের দরকার নেই, তবে বিশ্বসাহিত্যে টিকে থাকতে হলে প্রতিযোগিতামূলক সাহিত্য উপকরণ প্রয়োগ করা জরুরি।
যুগান্তর: সাহিত্যের দশক বিভাজনকে কীভাবে দেখেন?
শাহাজাদা বসুনিয়া: সাহিত্যের দশক বিভাজন একটি পরিলক্ষিত বিষয়। দশক বিভাজনে সাহিত্যের বিষয়বস্তু, প্রকরণ এবং ধরন-পরিবর্তন বিশেষভাবে লক্ষণীয়।
সামাজিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্যচর্চার পরিবর্তন অনিবার্য হয়ে ওঠে। সাহিত্যে বিষয়বস্তুর বহিঃপ্রকাশ হলো সমাজ ও রাষ্ট্র। দশক বিভাজনে সাহিত্য অধিকভাবে পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করে।
যুগান্তর: করোনা পরিস্থিতিতে অথবা করোনা পরবর্তী সাহিত্যের বিষয়বস্তুতে কোন ধরনের পরিবর্তন আসতে পারে?
শাহাজাদা বসুনিয়া: কাল-পাত্রের প্রভাব সাহিত্যে পড়ে নিঃসন্দেহে। করোনাকালে পুরো বিশ্বই আতঙ্কগ্রস্ত। করোনা মোকাবিলায় মেডিকেল সায়েন্সের তেমন প্রস্তুতি চোখে পড়েনি।
করোনাভাইরাস মোকাবিলা করার প্রস্তুতি চলছিল মাত্র। বিশ্বের মানুষ ভীতিগ্রস্ত হয়ে সৃষ্টিকর্তার রহমত কামনায় প্রার্থনারত। বিধাতার রহমত এবং তার ক্ষমতা দারুণভাবে প্রতিফলিত হয়েছে করোনাকালে।
এখনো বিশ্ববাসী করোনাভাইরাস মোকাবিলায় আল্লাহর রহমত কামনা করছেন। সাহিত্যচর্চায় এখন মানুষের অসহায়ত্ব ফুটে উঠছে। সাহিত্যের বিষয়বস্তু এখন খোদা আশ্রিত মেডিকেল সায়েন্স অর্থাৎ করোনার প্রভাব সাহিত্যে ঝংকৃত।
যুগান্তর: আমাদের সামাজিক ইতহাসের নিরিখে (৭১ পরবর্তী) মননশীলতার উন্নতি বা অবনতি সম্পর্কে ২০২০ সালে এসে কী বলবেন?
শাহাজাদা বসুনিয়া: ২০২০ সাল পুরোটাই দেশ ও জাতির জন্য আতঙ্ককাল-ক্রান্তিকাল। ৭১ পরবর্তী কিছু সময় সাহিত্য মননশীলতার আধিক্য বিশেষভাবে পরিলক্ষিত। সামাজিক মূল্যবোধ সাহিত্যে পরিস্ফুটিত হয়েছে। নিঃসন্দেহে সাহিত্য জীবন দপর্ণ।
এখন মূল্যবোধের পরিবর্তে আধুনিকতার করাল গ্রাসে সাহিত্য পতিত। এখন সাহিত্যচর্চা কিছুটা হলেও মননশীলতার দিক থেকে প্রশ্নবিদ্ধ।
যুগান্তর: বাংলাভাষায় কোন ধরনের গ্রন্থগুলো অন্য ভাষায় অনুবাদ হওয়া দরকার মনে করেন?
শাহাজাদা বসুনিয়া: আমাদের দেশের স্বাধীনতার মূল প্রেক্ষাপট ছিল রাষ্ট্রভাষা ও স্বাধীনতা। ১৯৪৭ পরবর্তী সময়ে পূর্ব পাকিস্তান ছিল সুযোগবঞ্চিত ভূখণ্ড। পূর্ব বাংলার মানুষ তার মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে পাওয়ার জন্য আত্মাহুতি দিয়েছেন।
দেশের স্বাধীনতার জন্য প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ইতিহাস সমৃদ্ধ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা জনগণের আত্মত্যাগবিষয়ক গ্রন্থাবলি বিদেশি ভাষায় অনূদিত হলে বিশ্ববাসী আরও বেশি করে বাঙালিদের সাহসিকতা, বীরত্বপণা, ত্যাগ-তিতিক্ষা ও বাংলাদেশের মুক্তির করুণ ইতিহাস জানতে পারবেন।
যুগান্তর: অনুবাদ করতে গিয়ে ইংরেজির সঙ্গে বাংলার কী কী পার্থক্য অনুভব করেছেন? এ ক্ষেত্রে বাংলার সীমাবদ্ধতা ব্যাপকতা বা ইতিবাচক গুণ সম্পর্কে আপনার অভিজ্ঞতা জানতে চাই
শাহাজাদা বসুনিয়া: ভাষান্তর একটি কঠিন কাজ। অনুবাদের ক্ষেত্রে স্থান-কাল-পাত্র বিশেষ ভূমিকা পালন করে। ইংরেজি ভাষা আন্তর্জাতিক ভাষা হিসাবে স্বীকৃত। অন্যদিকে বাংলাভাষা শহর ও আঞ্চলিক মিশ্রিত। একক কাঠামে নির্মিত নয়।
ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদের সময় স্থান-কাল-পাত্রের বিষয়টি মাথায় আনতে হয়। ফলে মাঝে মধ্যে বিভ্রম হলেও পঠনোপযোগী করে অনুবাদের বিষয়টি ভাবতে হয়। বাংলা মাতৃভাষা-অনুবাদের ক্ষেত্রে স্বকীয়তা বিদ্যমান অর্থাৎ লেখাশৈলী নিজের ধাঁচে তৈরি করা যায়।
অন্যদিকে ইংরেজি-বিদেশি ভাষা- তাই বুঝতে কিছুটা অসুবিধা হলেও আন্তর্জাতিক চর্চার মাধ্যমে অনুবাদ অর্থবোধক করা সম্ভব বলে আমার কাছে প্রতীয়মান।
যুগান্তর: বর্তমানে বাংলা সাহিত্যে ভালো লেখকের অভাব নাকি ভালো মানের পাঠকের অভাব?
শাহাজাদা বসুনিয়া : লেখক ও পাঠক, একে অন্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ। লেখক ও পাঠকের মধ্যে সমন্বয়হীনতা নির্ভর করে বিষয়বস্তুর ওপর।
সংযোগ তৈরির ক্ষেত্রে উভয়কেই সচেতন হতে হয়। পাঠকপ্রিয়তার জন্য লেখককে অবশ্যই সচেতন হয়ে পাঠকের চাহিদা মেটাতে হবে। অন্যদিকে, পাঠককেও বিষয়বস্তু অনুধাবনের সক্ষমতা অর্জন করা জরুরি। সমন্বয়হীনতার কারণে উভয়ের মধ্যে অভাব অনুভূত হয়।
যুগান্তর: অনুবাদের ক্ষেত্রে ফরেনাইজেশন বলে যে কথাটি আছে- আপনার অভিজ্ঞতার আলোকে এর ব্যাখ্যা জানতে চাই, এ বিষয়টি কি মানা হয়, বিশেষ করে আমাদের দেশে যারা অনুবাদ করেন তারা কি মানেন?
শাহাজাদা বসুনিয়া: বিশ্ব এখন গ্লোবাল ভিলেজ। তথ্য-তত্ত্ব আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক নিয়ম-রীতি (Code of condact) লিখিত ও নির্ধারিত আছে। অনুমোদন বিশেষভাবে পালনীয় বিষয়। ফরেনাইজেশন শুধু নয় বরং ডোমেসটিকেশনের ক্ষেত্রেও নির্ধারিত আইন অমান্য করা গুরুতর অপরাধ।
অনুবাদের ক্ষেত্রেও প্লেজিয়ারিজম (Plagiarism) অথবা সাইট্রেশন (Citation) কঠোরভাবে অনুসরণ করতে হবে। নিয়মবহির্ভূত কাজ হচ্ছে একটি আইনগত অপরাধ। ব্যক্তিগতভাবে অনুবাদের ক্ষেত্রে ফরেনাইজেশন হচ্ছে কিনা- আমার জানা নেই।
আমাদের দেশের অনুবাদকরা মানেন কি মানেন না আমার জানা নেই, তবে অনেক অনুবাদক সমালোচিত এবং বিতর্কিত নিঃসন্দেহে।
যুগান্তর: এখানে গুরুত্বপূর্ণ লেখকরা কি কম আলোচিত? যদি সেটি হয়, তাহলে কী কী কারণে হচ্ছে? এমন তিনটি সমস্যার কথা উল্লেখ করুন।
শাহাজাদা বসুনিয়া: কারণ-
১. গুরুত্বপূর্ণ লেখকরা কাহিনি নির্মাণে সচেতন থাকেন অর্থাৎ বিষয়বস্তু শাশ্বত ও সার্বজনীন।
২. গুরুত্বপূর্ণ লেখকরা প্রচারবিমুখ অর্থাৎ প্রচারের ক্ষেত্রে লাফালাফি করেন না।
৩. গুরুত্বপূর্ণ লেখকরা বিতর্কিত বিষয় উপস্থাপন করেন না আর করলেও অনেক পাঠকই নামেরভাবে সমালোচনা করতে ভীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েন।
যুগান্তর: ঠিক সময়ে যথার্থ অনুবাদ বিশ্বসাহিত্যে তুলে ধরতে পারলে প্রভাব বিস্তার করতে পারত, বাংলাদেশে এমন লেখক ছিল বা আছে? এবং কেন তারা ঠিকঠাক অনূদিত হচ্ছেন না, সেই অন্তরায়গুলো এবং এখান থেকে উত্তরণের উপায়গুলো বলুন।
শাহাজাদা বসুনিয়া: বাংলাদেশে অসংখ্য লেখক রয়েছেন যারা অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বসাহিত্যে প্রভাব ফেলতে পারবেন নিঃসন্দেহে। অন্তরায়গুলো হচ্ছে ব্যক্তিগত উদ্যোগের অভাব এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাব। দু’য়ের সমন্বয়ে এগিয়ে এলে অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বসাহিত্যে বাংলা সাহিত্যের অবস্থান আরও দৃঢ় করা সম্ভব।
যুগান্তর: অনেকেই বলেন, বাংলাদেশে মননশীল সাহিত্যের চর্চা কম হয়ে থাকে, অথবা যা হচ্ছে তার মানের দিক থেকে যথাযথ নয়। আমরা কী সৃষ্টিশীল সাহিত্যের তুলনায় মননশীলতায় পিছিয়ে আছি?
শাহাজাদা বসুনিয়া: বাংলাদেশে মননশীল সাহিত্যচর্চা কম হয়ে থাকে- এ কথাটি সঠিক নয় বরং মননশীল সাহিত্য মূল্যায়নের ঘাটতি হয়েছে। লেখকের সংখ্যা বেশি হওয়ায় অনেক মননশীল লেখা পর্যালোচনা করা হচ্ছে না।
রাজনীতি অথবা সময় অথবা আন্তরিকতার অভাবে মননশীল লেখা খুঁজে বের করা হচ্ছে না। মননশীল সাহিত্যই সৃষ্টিশীল- সৃষ্টিশীল সাহিত্যে নিগূঢ়ভাবে মননশীলতা বিরাজ করে।
যুগান্তর: আপনার প্রিয় দুটি বই, যা পাঠককে পড়তে বলবেন।
শাহাজাদা বসুনিয়া: দুটি বইয়ের নাম বলা দুরূহ ব্যাপার। বাংলাদেশে অনেক ভালো ভালো সাহিত্যিক রয়েছেন তাদের বই পড়া আমাদের উচিত। আমরা শুধুই পরিচিত লেখকদের বই পড়ি। কিন্তু অপরিচিত লেখকের বই পড়া থেকে বিরত থাকি।
তাই হাস্যকর হলেও আমি দুটি বইয়ের নাম বলব- একটি হচ্ছে, এএএম জাকারিয়া মিলনের জীবনী সাহিত্য ‘মিল-অমিলের এই সংসার’, অন্যটি হায়দার বসুনীয়ার উপন্যাস ‘মেথর সমাচার’।
