Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

সাক্ষাৎকার: ড. জাহিদ হোসেন

উচ্চাভিলাষী নয় অর্থায়নযোগ্য বাজেট প্রয়োজন

বাজেট ভাবনা ২০২৫-২৬

হামিদ-উজ-জামান

হামিদ-উজ-জামান

প্রকাশ: ০৭ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

উচ্চাভিলাষী নয় অর্থায়নযোগ্য বাজেট প্রয়োজন

ছবি: সংগৃহীত

অন্য সময়ের মতো উচ্চাভিলাষী না হয়ে অর্থায়নযোগ্য বাজেট করা প্রয়োজন। জনগণকে দেখানোর মতো না করে বাস্তবতার সঙ্গে মিল রাখতে হবে। আয়, ব্যয়, ভর্তুকি সব ক্ষেত্রেই পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব মিলিয়েই আগামী অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার বাজেট করা হলে সেটি কার্যকর হবে বলে মনে করছেন বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ও শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির সদস্য ড. জাহিদ হোসেন। সম্প্রতি যুগান্তরের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন। এই মুহূর্তে দেশের বিশেষ প্রেক্ষাপটে আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট কেমন হওয়া উচিত, বাস্তবায়নে কী কী চ্যালেঞ্জ আছে এবং তা মোকাবিলায় করণীয়সহ সংশ্লিষ্ট নানা বিষয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন এই অর্থনীতিবিদ। তিনি আরও বলেন, বাজেটের সঠিক আকার নির্ধারণ করাটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। সেই সঙ্গে রাজস্ব আদায় বাড়ানো, অপচয় রোধ করে খরচের ক্ষেত্রে সতর্ক হওয়াটা জরুরি। সীমিত অভিলাষের বাজেট করতে হবে। সেই সঙ্গে ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন, রাজস্ব ফাঁকি রোধ এবং ব্যয়ের পুনর্বিবেচনায় গুরুত্ব দরকার। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সিনিয়র রিপোর্টার হামিদ-উজ-জামান।

যুগান্তর : দেশের বিশেষ প্রেক্ষাপটে আগামী অর্থবছরের বাজেট কেমন হওয়া উচিত।

জাহিদ হোসেন : সাধারণত সব সময় উচ্চাভিলাসী বাজেট ধরা হয়ে থাকে। কিন্তু সেটা ঠিক নয়। বাজেট অর্থায়নযোগ্য হওয়াটা হিসাব-নিকাশের ব্যাপার। মাথায় রাখতে হবে প্রথমত, বাজেট ঘাটতি অর্থায়নযোগ্য হবে কিনা। দ্বিতীয়ত, রাজস্ব লক্ষ্য অর্জন হবে কিনা। ওরকম একটি লক্ষ্য নির্ধারণ করে বাজেটের আকার ধরা দরকার। ঘাটতির সঙ্গে আয়ের হিসাব মিলিয়ে বাজেট করা উচিত।

যুগান্তর : বাজেটের আকার কেমন হলে ভালো হয়।

জাহিদ হোসেন : দেশের অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি হওয়া ঠিক হবে না। কেননা বেশি ধরা হলে ব্যক্তি খাতে ঋণের ক্ষেত্রে প্রভাব পড়বে। সেই সঙ্গে মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রেও একটা প্রভাব তৈরি করবে। এছাড়া বৈদেশিক সহায়তা থেকে ১ লাখ কোটি টাকা ধরা যেতে পারে। এতে ২ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি অর্থায়ন হবে। এর সঙ্গে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ধরা যেতে পারে ৫ লাখ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে আগামী বাজেট ৭ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা ধরা যেতে পারে।

যুগান্তর : আগামী অর্থবছরের বাজেটের চ্যালেঞ্জ কী হতে পারে।

জাহিদ হোসেন : সবার আগে বলতে হয় লক্ষ্য নির্ধারণ করাটাই একটি চ্যালেঞ্জ। কেননা বাজেটটি হতে হবে অর্জনযোগ্য। অতীতে বড় অঙ্কের বাজেট ধরে দেখানোর একটা প্রবণতা ছিল। ফলে লক্ষ্য অর্জন কখনো সম্ভব হয়নি। আগামী অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা ধরা হলে সেটিও হয়তো খুবই উচ্চাভিলাষী হবে। এটা অর্জনযোগ্য নাও হতে পারে। কিন্তু সেটি আগের বাজেটের মতো অতি উচ্চাভিলাষী হবে না। এজন্য শুরুর চ্যালেঞ্জ হলো সঠিক লক্ষ্যটা নির্ধারণ করা।

যুগান্তর : আরও কী চ্যালেঞ্জ আছে?

জাহিদ হোসেন : রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য অর্জনের একটি বড় চ্যালেঞ্জ থাকবে আগামী অর্থবছরের বাজেটে। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হলে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে রাজস্ব ফাঁকি বন্ধের দিকে। সিপিডি কয়েকদিন আগে বলেছিল, ২০২৩ সালে ২ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ এই টাকা করদাতাদের দেওয়ার কথা ছিল, কিন্তু সরকার পায়নি। কেন পায়নি? এই ফাঁকি দিতে গিয়ে কিছু নেগোসিয়েট করতে হয়েছে। এর মানে যিনি কর আদায় করেন তার সঙ্গে যিনি কর দেন তার একটি ডিল করতে হয়েছে। উদাহরণস্বরুপ বলা যেতে পারে হয়তো ২ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার মধ্যে ১ লাখ ১০ হাজার কোটি ঘুস হিসেবে ওই কর আদায়কারীদের দিতে হয়েছে। বাকি ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা করদাতা সুবিধা নিয়েছেন। এই নেগোসিয়েশন বন্ধ করা গেলে অন্তত ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা তো সরকারের কোষাগারে জমা হতো। এক্ষেত্রে এত বিশাল অঙ্কের টাকা সরকার রাজস্ব পেতে পারে শুধু ফাঁকি বন্ধের মাধ্যমে। সেই সঙ্গে করদাতারাও খুশি হতে পারেন। এজন্য বলছি নেগোসিয়েশনের সুযোগ যত কম থাকবে ততই কর ফাঁকি বন্ধ করা সম্ভব হবে।

যুগান্তর : কর বাড়ানোর আর কী পন্থা হতে পারে?

জাহিদ হোসেন : বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার উপদেষ্টা কাউন্সিলে একটি অর্ডিনেন্স জারি করতে পারে। এক্ষেত্রে কর ব্যবস্থাপনা ও কর নির্ধারণ এই দুটো বিভাগ আলাদা করতে হবে। পাশাপাশি করের হারের ক্ষেত্রে যত বেশি ভিন্নতা থাকবে ততই নেগোসিয়েশনের সুযোগ সৃষ্টি হবে। ভ্যাট, ট্যাক্স, আয়করে ভিন্ন ভিন্ন হার থাকলে করদাতারা বলবেন আমাকে কম হারের ঘরে ফেলেন। এতে করদাতারা কর দিলেও ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। এজন্য একীভূত করহার করতে হবে। এছাড়া কর অব্যাহতি কমিয়ে ফেলতে হবে। শুধু ভ্যাটের ক্ষেত্রে নয়, কাস্টমসের ক্ষেত্রেও ছাড় দেওয়া কমানো দরকার। মনে রাখতে হবে দুর্নীতি ও নেগোসিয়েশন না হলে কর ফাঁকি দেওয়া কঠিন হবে। আয়করের ক্ষেত্রেও নানা ধরনের রেইট আছে। যেমন মৎস্য চাষ করলে করহার কম। করপোরেট করও সরলীকরণ করা দরকার। রেটের ক্ষেত্রেও ভিন্নতা কমানো দরকার।

যুগান্তর : বাজেট ব্যয়ের ক্ষেত্রে কী ধরনের সতর্কতা প্রয়োজন।

জাহিদ হোসেন : বাজেট ব্যয়ের ক্ষেত্রে কাঠামোগত পুনর্বিন্যাস প্রয়োজন। আমার যেটি মনে হয় আগামী অর্থবছরের বাজেটটিই এই সরকারের একমাত্র বাজেট হতে পারে। দ্বিতীয় বাজেট দেওয়া সম্ভব নাও হতে পারে। এবার এমন একটা সময় বাজেট দেওয়া হচ্ছে যখন অর্থনীতি কিছুটা ঘুরে দাঁড়ালেও সাধারণ মানুষের অবস্থা ভালো নয়। বিশ্বব্যাংক বলেছে, চলতি বছর দারিদ্র্য বাড়বে। খাদ্য মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রে লাল তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে সামাজিক এবং সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। দুর্যোগকালীন সহায়তা, মহিলা ও শিশুদের সহায়তা, শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রাইমারিসহ সব শিক্ষার ক্ষেত্রে বৃত্তি ও উপবৃত্তির অঙ্ক বাড়ানো প্রয়োজন। এছাড়া শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের যেসব দরিদ্রবান্ধব কর্মসূচি রয়েছে সেগুলোর আওতা ও ভাতা বাড়াতে হবে। কেননা শিক্ষার ক্ষেত্রে বরাদ্দ বাড়ানো গেলে সরাসরি শিক্ষা ও দারিদ্র্য নিরসনে ভূমিকা রাখবে। এক্ষেত্রে নগদ টাকা পেলে দরিদ্র পরিবারগুলোর শিক্ষা ব্যয় কমবে। ফলে অন্য খাতে চাহিদা মেটাতে পারবে। স্বাস্থ্য খাতে পুষ্টির জন্য মা ও শিশুদের জন্য কর্মসূচি আছে। এগুলোয় অর্থায়ন বাড়ানো গেলে সরাসরি উপকার পাওয়া যাবে। তবে সব ক্ষেত্রেই অর্থায়ন ও ব্যবস্থাপনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

যুগান্তর : বাজেটে বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি নিয়ে কিছু বলুন।

জাহিদ হোসেন : আমাদের ভর্তুকি প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা। আর বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) হলো ২ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা। কৃষি, জ্বালানি, রপ্তানি, রেমিট্যান্সে বড় ধরনের ভর্তুকি আছে। এছাড়া কৃষি যান্ত্রিকীকরণ কর্মসূচি নিয়ে ব্যাপক দুর্নীতি আছে। প্রকৃত কৃষকরা ভর্তুকি পাচ্ছেন না। মধ্যস্বত্বভোগীরা ভর্তুকির সুবিধা নিয়ে যাচ্ছে। সেখানে ভর্তুকি কাটছাঁট করা যেতে পারে। পাশাপাশি জ্বালানি খাতে ক্যাপাসিটি চার্জ কমানো যেতে পারে। এই চার্জের বিষয়ে রি-নেগোসিয়েট করা যেতে পারে। এছাড়া কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতের দাম পুনর্মূল্যায়ন করা যেতে পারে। প্রতি ইউনিটে ১-২ টাকা কমানো গেলে অনেক বড় অঙ্কের ভর্তুকি কমবে। রেমিট্যান্সে যে ভর্তুকি আছে সেটিও তুলে দেওয়া যেতে পারে। কেননা এখন তো যারা রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন তারা ডলারের দাম বাড়ায় এমনিতেই প্রায় ৪০ টাকার মতো বেশি সুবিধা পাচ্ছেন। তাই এক্ষেত্রে প্রণোদনা পুরো আড়াই শতাংশ পুনর্বিবেচনা করা যেতে পারে। তবে সরকারের যেটি করা দরকার সেটি হলো বিদেশ যাওয়ার খরচ কমানো। ভিসা বাণিজ্যে পরিবর্তন আনতে না পারলে খরচ কমানো যাবে না। প্রবাসীদের বিদেশ যাওয়ার খরচ কমানো গেলে রেমিট্যান্সে ভর্তুকি বাতিল করলেও তাদের গায়ে লাগবে না। রপ্তানিতে যে ভর্তুকি রয়েছে সেখানেও কমানোর সুযোগ আছে। কেননা রপ্তানি বহুমুখীকরণে ভর্তুকি দিয়েও কোনো কাজ হচ্ছে না। সেটি তো প্রমাণিত।

যুগান্তর : বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) নিয়ে কিছু বলুন।

জাহিদ হোসেন : এডিপিতে অন্তর্ভুক্ত সব প্রকল্পই পুনর্বিবেচনা করতে হবে। কোন প্রকল্প থাকবে আর কোন প্রকল্প থাকবে না সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার। যে প্রকল্পগুলো চলমান থাকবে সেগুলো পর্যাপ্ত বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে। এভাবে যাচাই-বাছাইয়ে যেসব প্রকল্প বাদ যাবে সেগুলো থেকে অর্থ সাশ্রয় হবে। নতুন প্রকল্প গ্রহণে খুবই সতর্ক থাকতে হবে। সরকারি বা বৈদেশিক অর্থায়ন যাই হোক না কেন, সব প্রকল্প বাস্তবায়নেই সমান গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। একটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে, প্রকল্প বাস্তবায়নের শতভাগ প্রস্তুতি না থাকলে সেই প্রকল্প এডিপিতে যুক্ত করা যাবে না। কেননা এসব অসম্পূর্ণ প্রকল্প প্রস্তাব পরে বাস্তবায়ন পর্যায়ে গিয়ে নানা সমস্যার সৃষ্টি করে।

বাজেট জাহিদ হোসেন ব্যাংক

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম