সাক্ষাৎকার
গ্রাহকমূল্য ও আস্থাকে অগ্রাধিকার দেয় যমুনা ব্যাংক
মির্জা ইলিয়াস উদ্দীন আহম্মদ, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও যমুনা ব্যাংক পিএলসি
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ৩১ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
মির্জা ইলিয়াস উদ্দীন আহম্মদ, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও যমুনা ব্যাংক পিএলসি
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
যমুনা ব্যাংক পিএলসি সুদের হারে প্রতিযোগিতা না করে পূর্ণাঙ্গ গ্রাহকমূল্য ও আস্থাকে অগ্রাধিকার দেয়। সে লক্ষ্যে চালু করেছে নতুন ও উদ্ভাবনী পণ্য। ব্যাংকটি বিশ্বাস করে, আস্থা রাতারাতি তৈরি হয় না, এটি সময়, ধারাবাহিকতা ও দায়বদ্ধতার মাধ্যমে গড়ে ওঠে। গ্রাহক ব্যাংকটিকে বিশ্বাস করেন। এই আস্থা ও রেপুটেশনই আমানত সংগ্রহে সবচেয়ে বড় পুঁজি। আমানত সংগ্রহসহ ব্যাংকিং কার্যক্রমের নানা দিক নিয়ে যুগান্তরের সঙ্গে কথা বলেছেন যমুনা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মির্জা ইলিয়াস উদ্দীন আহম্মদ।
যুগান্তর : আমানত বাড়ানোর জন্য আপনারা কী ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছেন?
মির্জা ইলিয়াস উদ্দীন আহম্মদ : বর্তমান ব্যাংকিং খাতে আমানত সংগ্রহ একটি প্রতিযোগিতামূলক ও গ্রাহককেন্দ্রিক চ্যালেঞ্জে পরিণত হয়েছে। সুদের হারই এখন একমাত্র নির্ধারক নয়, বরং গ্রাহক এখন নিরাপত্তা, স্বচ্ছতা, ডিজিটাল সক্ষমতা ও সেবার অভিজ্ঞতাকে গুরুত্ব দেন। যমুনা ব্যাংক এই পরিবর্তনশীল বাস্তবতা গভীরভাবে অনুধাবন করে।
আমরা সুদের হারে প্রতিযোগিতা না করে পূর্ণাঙ্গ গ্রাহকমূল্য ও আস্থাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছি। সেই লক্ষ্যে আমরা চালু করেছি নতুন ও উদ্ভাবনী পণ্য, যার মধ্যে অন্যতম হলো ‘যমুনা শর্ট নোট’ একটি স্বল্পমেয়াদি উচ্চ রিটার্নভিত্তিক ডিপোজিট পণ্য, যা দ্রুত মূলধন ঘোরাতে আগ্রহী গ্রাহকদের জন্য আকর্ষণীয় সমাধান।
আমরা কাস্টমাইজড স্কিমের পাশাপাশি অটো-রিনিউয়াল, ট্যাক্স-স্মার্ট অপশন ও বিভিন্ন মেয়াদে উচ্চ রিটার্ন সুবিধার মতো সুবিধা সংযুক্ত করছি, যা গ্রাহকের চাহিদার সঙ্গে সম্পূর্ণরূপে মানানসই।
কৌশলগতভাবে আমরা জোর দিচ্ছি সম্পর্কভিত্তিক ব্যাংকিংয়ের ওপর। আমাদের শাখাগুলোয় ট্রেইন্ড রিলেশনশিপ ম্যানেজাররা শুধু ব্যাংকিং সেবা প্রদান করেন না, বরং প্রতিটি গ্রাহকের আর্থিক লক্ষ্য ও প্রোফাইল বোঝার চেষ্টা করেন। এই মানবিক সংযোগই আমানত সংগ্রহে দীর্ঘস্থায়ী ফল দিচ্ছে।
পাশাপাশি আমরা ডিজিটাল ব্যাংকিং চ্যানেলগুলো- ইন্টারনেট ব্যাংকিং, মোবাইল অ্যাপ, ই-স্টেটমেন্ট, রিয়েল-টাইম অ্যালার্ট ব্যাপকভাবে উন্নয়ন করেছি, যাতে গ্রাহক যে কোনো সময় তার টাকার ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারেন।
সবশেষে টেকসই ব্যাংকিং ও সুনাম হচ্ছে আমাদের মূল শক্তি। বাংলাদেশ ব্যাংকের টেকসই রেটিং, সিএসআর কার্যক্রম এবং কম এনপিএল, শক্তিশালী ক্যাপিটাল বেস ইত্যাদি কারণে গ্রাহক আমাদের বিশ্বাস করেন। এ আস্থা ও রেপুটেশনই আমাদের আমানত সংগ্রহে সবচেয়ে বড় পুঁজি।
যমুনা ব্যাংক বিশ্বাস করে, আস্থা রাতারাতি তৈরি হয় না, এটি সময়, ধারাবাহিকতা ও দায়বদ্ধতার মাধ্যমে গড়ে ওঠে। আর যমুনা ব্যাংক ঠিক সেই মূল্যবোধেই বিশ্বাস করে।
যুগান্তর : দুর্বল ব্যাংকগুলো ১২ শতাংশ সুদেও আমানত নিচ্ছে, এতে বাজারে কী অস্থিরতা দেখা দিতে পারে?
মির্জা ইলিয়াস উদ্দীন আহম্মদ : যমুনা ব্যাংক সব সময় টেকসই প্রবৃদ্ধি, নিয়ন্ত্রিত ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ও গ্রাহক আস্থাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়। শুধু উচ্চ সুদের প্রলোভনে আমানত সংগ্রহ আমাদের নীতিগত অবস্থানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, কারণ:
› অস্বাভাবিক সুদের হার একটি অস্থিতিশীল প্রতিযোগিতা তৈরি করে, যা ব্যাংকিং খাতের দীর্ঘমেয়াদে টেকসইতা ও আস্থার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনেও দেখা গেছে, কিছু ব্যাংকের অস্বাভাবিক হারে আমানত সংগ্রহ ভবিষ্যতে তারল্য সংকট তৈরি করতে পারে।
› উচ্চ সুদ মানেই উচ্চঝুঁকি, বাজার থেকে আমানত টানতে গিয়ে অনেক প্রতিষ্ঠান পরবর্তী সময়ে ওই উচ্চ সুদের দায়ভার বহনে হিমশিম খায়, ফলে তারা খেলাপি ঋণ বা অন্য অনিয়মে জড়িয়ে পড়তে পারে।
› যমুনা ব্যাংক বরাবরই আস্থাভাজন সম্পর্ক গড়ে তোলায় বিশ্বাসী। আমরা গ্রাহকদের স্বচ্ছতা, নিয়মিত সেবা ও দীর্ঘমেয়াদি আর্থিক পরিকল্পনার মাধ্যমে টিকিয়ে রাখি। অতিরিক্ত সুদ নয়, স্থিতিশীলতার ওপর ভিত্তি করেই আমানতের আস্থা অর্জন করাই আমাদের লক্ষ্য।
› বাজারে অস্থিরতা রোধে আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা ও নীতিমালার প্রতি সম্পূর্ণ প্রতিশ্র“তিবদ্ধ।
যুগান্তর : আমানতকারীদের অর্থের নিরাপত্তায় আপনারা কী ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছেন?
মির্জা ইলিয়াস উদ্দীন আহম্মদ : অর্থের নিরাপত্তা এখন আর কেবল একটি প্রযুক্তিগত বা আইনি প্রশ্ন নয়, এটি একধরনের নৈতিক দায়িত্ব, যা ব্যাংকের ভেতরের সংস্কৃতি, নেতৃত্ব ও দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যমুনা ব্যাংক শুরু থেকেই বিশ্বাস করে, গ্রাহকের টাকা শুধু একটি অঙ্ক নয়; এটি তার আস্থা, সঞ্চয় এবং ভবিষ্যতের প্রতীক। আর এই আস্থার সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হলে আমাদের নিরাপত্তা কাঠামোকেও হতে হয় সমান আধুনিক, গতিশীল ও বিশ্বাসযোগ্য।
আমরা আজকের দিনে শুধু সফটওয়্যার আপডেট করেই নিশ্চিন্ত থাকি না। বরং আমাদের প্রতিদিনের কাজের ধারায় ঝুঁকি মূল্যায়ন, সন্দেহজনক কার্যক্রম শনাক্তকরণ এবং সময়োপযোগী প্রতিক্রিয়া একান্তভাবে অন্তর্ভুক্ত। প্রতিটি লেনদেন আমরা দেখি প্রেক্ষাপট বিবেচনায়, গ্রাহক কে, তার লেনদেনের ধরন কী, আচরণগত প্যাটার্নে কোনো অস্বাভাবিকতা আছে কি না, এই বিশ্লেষণগুলো আমাদের নিজস্ব প্রযুক্তি ও অভিজ্ঞ মানবসম্পদ যৌথভাবে প্রতিদিন করে।
যুগান্তর : বাজারে অনেক ব্যাংক আছে, এর মধ্যে গ্রাহকের আপনার ব্যাংকে কেন আস্থা রাখা উচিত? অন্য ব্যাংক থেকে আপনার ব্যাংককে কী কারণে আলাদাভাবে বিবেচনা করবেন গ্রাহকরা?
মির্জা ইলিয়াস উদ্দীন আহম্মদ : এ প্রশ্নটি খুবই যৌক্তিক এবং প্রতিদিনই গ্রাহকদের মনে এমন প্রশ্ন জাগে। কারণ, একজন গ্রাহক যখন তার সঞ্চয় বা ব্যবসায়িক অর্থ কোনো একটি প্রতিষ্ঠানে রাখেন, তখন তিনি শুধু আর্থিক লেনদেন করছেন না, তিনি তার ভবিষ্যৎ, পরিবার এবং স্বপ্নকে একটি প্রতিষ্ঠানের ওপর বিশ্বাস করে তুলে দিচ্ছেন।
যমুনা ব্যাংকের প্রতি সেই আস্থার ভিত্তি তৈরি হয়েছে দীর্ঘ সময় ধরে ধারাবাহিকতা, নির্ভরযোগ্যতা এবং সেবার মান দিয়ে।
আমরা বলি না যে আমরা সবচেয়ে বেশি শাখা খুলেছি বা সবচেয়ে উচ্চ সুদ দিচ্ছি। আমরা বলি, আমরা সবচেয়ে বেশি সম্পর্ক তৈরি করেছি।
এই ব্যাংক শুধু লেনদেন করে না, প্রতিটি গ্রাহককে বোঝে-তার প্রয়োজন, সম্ভাবনা এবং সীমাবদ্ধতাকে শ্রদ্ধা করে। যমুনা ব্যাংকের প্রতিটি শাখায় আপনি পাবেন এমন একটি আচরণগত পরিবেশ, যেখানে আপনার সময়, জিজ্ঞাসা এবং প্রাপ্তি-সবকিছুকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়।
আরেকটি বিষয়, যেটি আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি-যমুনা ব্যাংক কখনোই বাজারে ‘শর্টকাট’ পথ খোঁজে না। আমরা কখনো অস্বাভাবিক উচ্চ সুদ দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ আমানত গ্রহণে প্রতিযোগিতা করি না, বরং স্বচ্ছতা, নিয়ম ও দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে গ্রাহক টানি। কারণ আমরা জানি, আজকের লোভী প্রতিশ্র“তি কালকের বিপদের উৎস হতে পারে।
যুগান্তর : অনেক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান আমানত ফেরত দিতে পারছে না। এতে মানুষের মধ্যে ভীতি ছড়িয়ে পড়েছে। এই ভীতি কাটাতে আপনারা কী উদ্যোগ নেবেন?
মির্জা ইলিয়াস উদ্দীন আহম্মদ : বাজারে কিছু অনিয়ম বা দুর্বল ব্যাংকিং পরিচালনার কারণে সাময়িক কিছু প্রতিষ্ঠান আমানত ফেরত দিতে ব্যর্থ হচ্ছে-এটি সত্য এবং আমরা বিষয়টি অস্বীকার করি না। তবে এই বিচ্ছিন্ন ঘটনা পুরো ব্যাংকিং সেক্টর বা সব ব্যাংক সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব তৈরির সুযোগ দেওয়া ঠিক হবে না।
এই প্রেক্ষাপটে যমুনা ব্যাংকের দায়িত্ব আরও বেড়ে গেছে-আমরা শুধু নিজেদের গ্রাহকদের জন্য নয়, বরং সামগ্রিকভাবে জনগণের আস্থার জায়গা ধরে রাখার জন্য কাজ করছি।
আমরা প্রথমে যেটা করছি, তা হলো স্বচ্ছতা ও নিয়মতান্ত্রিকতা বজায় রাখা।
দ্বিতীয়ত, আমরা আমাদের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম, গ্রাহক সার্ভিস ও তথ্য প্রাপ্যতা আরও উন্নত করছি, যাতে গ্রাহক নিজেই যে কোনো সময়ে তার অ্যাকাউন্ট, স্থিতি, লেনদেন ও নিরাপত্তা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারেন। মানুষ ভয় পায় তখনই, যখন তথ্য অপ্রতুল হয়। যমুনা ব্যাংক সেই তথ্যের ঘাটতি দূর করছে।
তৃতীয়ত, আমরা গ্রাহক সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালু করেছি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, গ্রাহক সভা, ফিন্যান্সিয়াল লিটারেসি প্রোগ্রামÑএসবের মাধ্যমে আমরা গ্রাহকদের বোঝাচ্ছি, কোন ব্যাংকে কেমন ঝুঁকি থাকে, কী দেখে একজন গ্রাহককে ব্যাংক নির্বাচন করতে হয় এবং আমানতের নিরাপত্তা বুঝে নেওয়া কীভাবে সম্ভব।
সর্বশেষে বলব, ব্যাংকিং শুধু ব্যবসা নয়, এটি একটি নৈতিক দায়িত্ব। গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে না পারা মানে শুধু আর্থিক ব্যর্থতা নয়-এটি বিশ্বাস ভঙ্গ। আমরা এই বিশ্বাসের জায়গায় কখনোই আপস করি না।
যুগান্তর : ব্যাংক একীভূতকরণের উদ্যোগে অনেকে টাকা তুলে নিচ্ছেন, এটাকে কীভাবে দেখছেন?
মির্জা ইলিয়াস উদ্দীন আহম্মদ : একীভূতকরণ বা মার্জারের বিষয়টি বর্তমানে একটি নীতিনির্ধারক পর্যায়ে আলোচনার অংশ এবং এটি কোনো আতঙ্ক বা অস্থিরতার বিষয় নয়। বিশ্বের অনেক উন্নত অর্থনীতিতেই সময়মতো ব্যাংক একীভূতকরণ করা হয় দুর্বল ব্যাংককে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানের আওতায় এনে তাদের পরিচালন দক্ষতা ও নিরাপত্তা বৃদ্ধির জন্য। বাংলাদেশও এখন সেই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু একধরনের অপূর্ণ বা ভ্রান্ত তথ্যের কারণে কিছু মানুষ মনে করছেন, একীভূতকরণ মানেই সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো অনিরাপদ বা তাদের অর্থ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এটা সত্য নয়। বাংলাদেশ ব্যাংক অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে জানিয়েছে-একীভূতকরণ একটি প্রশাসনিক ও কৌশলগত সিদ্ধান্ত, যার ফলে গ্রাহকের টাকা পুরোপুরি সুরক্ষিত থাকবে।
একীভূতকরণ একটি অর্থনৈতিক নীতিগত পদক্ষেপ। এটি দুর্বল ব্যাংকের সমস্যা সমাধানের জন্য, শক্তিশালী ব্যাংকের নয়। যমুনা ব্যাংক যেমন ছিল, তেমনই থাকবে নির্ভরযোগ্য, শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়ানো এবং গ্রাহকস্বার্থে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
