এক রাসূলপ্রেমিকের কালজয়ী প্রেমগাথা: কাসিদায়ে বুরদা
সৈয়দ এ. এফ. এম. মঞ্জুর-এ-খোদা
প্রকাশ: ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
মহান আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ বন্ধু হজরত মুহাম্মাদ মুস্তফা (সা.)-এর প্রশংসায় আরবি ভাষায় রচিত যুগশ্রেষ্ঠ এক দীর্ঘ কবিতার নাম হলো ‘কাসিদায়ে বুরদা’। আজও এর প্রতিটি শব্দ রাসূলপ্রেমিকদের প্রেমাবেগে আপ্লুত করে তোলে, দুচোখকে করে অশ্রুসিক্ত। কাসিদায়ে বুরদা নামটি শোনার সঙ্গে সঙ্গেই তাদের মনে নিজের অজান্তেই যেন বেজে ওঠে হৃদয়ে কম্পন সৃষ্টিকারী সেই মধুর ধ্বনি-‘মাওলা ইয়া সাল্লি ওয়া সাল্লিম দায়িমান আবাদান; আলা হাবিবিকা খায়রাল খালকি কুল্লিহিমিন!’ (হে আমার প্রভু! আপনার প্রিয় বন্ধুর ওপর যুগ থেকে যুগান্তরে দরুদ ও সালাম বর্ষণ করুন, যিনি সব সৃষ্টির সেরা!)
রচয়িতার পরিচয়
কাসিদায়ে বুরদার রচয়িতা ইমাম বুসিরি (রহ.)-এর পূর্ণ নাম শেখ আবদুল্লাহ্ শরফুদ্দিন মুহাম্মাদ ইবনে সাইদ ইবনে হাম্মাদ ইবনে আবদুল্লাহ্ বুসিরি। তিনি ১২১২ খ্রিষ্টাব্দে মিশরের ‘দালাস’ নামক গ্রামে (বর্তমান মিশরের বনি সুয়েফ প্রদেশের অন্তর্গত) জন্মগ্রহণ করেন। পরবর্তী সময়ে তার পৈতৃক নিবাস মিশরের ‘বুসির’-এর নামানুসারে তিনি ‘ইমাম বুসিরি’ নামে খ্যাতি লাভ করেন। তিনি ছিলেন একাধারে একজন সুফি সাধক, শিক্ষক, বহু ভাষায় সুপণ্ডিত, সাহিত্যিক ও স্বনামধন্য কবি।
কাসিদায়ে বুরদা রচনার ইতিহাস
ইমাম বুসিরি (রহ.) প্রাথমিক জীবনে তৎকালীন মিশরের বাদশাহর গুণগান বর্ণনাপূর্বক কাব্য রচনা করে ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তার কবিতার ছন্দ-মাধুর্য ও সাহিত্যমান এতটাই উৎকৃষ্ট ছিল যে, অল্প সময়ের মধ্যেই তার কাব্যসাহিত্যের সুনাম-সুখ্যাতি সমগ্র মুসলিম জাহানে ছড়িয়ে পড়েছিল। এভাবেই আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তার মাঝে বেশ সুখে-শান্তিতেই তার দিন কাটতে থাকে। কিন্তু হায়! তার সেই সুখ বেশি দিন স্থায়ী হলো না। হঠাৎ করেই তিনি এমন এক কঠিন রোগে আক্রান্ত হলেন যে, তার শরীরের একপাশের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে আসতে লাগল। বিভিন্ন ঐতিহাসিক সূত্র থেকে জানা যায়, ইমাম বুসিরি হেমিপ্লেজিয়া (Hemiplegia) বা অর্ধাঙ্গ পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়েছিলেন, যাকে আরবিতে ‘ফালিজ’ বলা হয়। এর ফলে তার শরীরের একপাশ সম্পূর্ণরূপে পক্ষাঘাতগ্রস্ত (Paralyzed) হয়ে যায় এবং তিনি শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। তৎকালীন মিশরের রাজদরবারের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকবর্গসহ বহু খ্যাতিমান হেকিম-কবিরাজ নানাভাবে ইমাম বুসিরির চিকিৎসা করার চেষ্টা করতে লাগলেন। কিন্তু কিছুতেই তার অবস্থার কোনো উন্নতি হলো না। একপর্যায়ে চিকিৎসকরা তার সুস্থ হওয়ার আশা ছেড়ে দিয়ে জানিয়ে দিলেন-দুনিয়ার কোনো ঔষধপথ্য দ্বারা এ দুরারোগ্য রোগের চিকিৎসা করা সম্ভব নয়! অসুস্থতার কারণে দীর্ঘদিন রাজদরবারে যাতায়াত বন্ধ, ভক্ত-অনুরাগী, ছাত্র-শিষ্য এবং বন্ধুবান্ধব থেকে দূরে-এভাবে একাকী ও অসহায় অবস্থায় তিনি যখন মৃত্যুর প্রহর গুনছিলেন, ঠিক সেসময় তার অন্তরে এক গভীর উপলব্ধির সৃষ্টি হলো-
‘আমি তো সারা জীবন দুনিয়ার রাজা-বাদশাহ্দের প্রশংসা করে অনেক কবিতা লিখেছি, কিন্তু কই, আমি তো দোজাহানের বাদশাহ্ হজরত রাসূল (সা.)-এর শানে কিছুই লিখলাম না!’
অতঃপর ইমাম বুসিরি মনস্থ করলেন-‘যদি এই অসুখেই আমার মৃত্যু হয়, তাহলে মৃত্যুর আগে আমি দয়াল রাসূল (সা.)-এর প্রশংসায় একটি কাসিদা (প্রশংসামূলক দীর্ঘ কবিতা) রচনা করে যেতে চাই। আর আল্লাহ যদি কখনো সুযোগ দেন, তাহলে দয়াল রাসূল (সা.)-এর রওজা শরিফে গিয়ে তাকে কাসিদাটি পাঠ করে শুনাব!’ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তিনি অর্ধেক অবশ শরীর নিয়েও বহু কষ্টে বিছানার এক পাশে শুয়ে হজরত রাসূল (সা.)-এর প্রেমাবেগে উজ্জীবিত হয়ে কাসিদা রচনার কাজ শুরু করলেন। এভাবে দীর্ঘদিন অক্লান্ত পরিশ্রমের পর ১৬৫ লাইনবিশিষ্ট দীর্ঘ কাসিদাটি লেখার কাজ সমাপ্ত হলো। ইমাম বুসিরি কাসিদাটির নাম দিলেন ‘আল কাওয়াকিবুদ দুরবিয়াহ ফি মাদহি খায়রিল বারিয়াহ’ (সৃষ্টির সর্বশ্রেষ্ঠ সত্তার প্রশংসায় উজ্জ্বল নক্ষত্ররাজি)।
কাসিদা রচনা শেষ হওয়ার পর ইমাম বুসিরি এক শুক্রবার রাতে গভীর ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার সঙ্গে কাসিদাটি আবৃত্তি করতে লাগলেন। একপর্যায়ে তার চোখে তন্দ্রাভাব এসে পড়ল এবং তিনি মৃদুস্বরে কাসিদাটি পাঠ করতে করতেই ঘুমিয়ে পড়লেন। আর তখনই তিনি স্বপ্নে দেখলেন-দোজাহানের বাদশাহ্, কুলকায়েনাতের রহমত দয়াল রাসূল (সা.) দয়া করে তার ঘরে তশরিফ গ্রহণ করেছেন। আল্লাহর রাসূল (সা.)-এর নুরানি চেহারা মুবারকের উজ্জ্বল আলোকচ্ছটায় তার পুরো ঘর উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে! যেন পূর্ণিমার চাঁদ আকাশ থেকে নেমে এসেছে তার ঘরে! পরমপ্রিয় মাশুককে নিজের কাছে পেয়ে ইমাম বুসিরি আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়লেন। তিনি দয়াল রাসূল (সা.)-এর অনুমতি নিয়ে পরম ভক্তি ও শ্রদ্ধার সঙ্গে নিজের লেখা কাসিদাটি আবৃত্তি করতে লাগলেন। আল্লাহর রাসূল (সা.)-ও এক স্নেহমাখা মুগ্ধ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে কাসিদাটি শুনতে থাকলেন। পাঠ করতে করতে যখন ইমাম বুসিরি (রহ.) কাসিদার শেষের দিকের এই লাইনে পৌঁছলেন- ‘কাম আবরাআত আসিবান’ অর্থাৎ, ‘কত মুমূর্ষু রোগীকে সুস্থ করেছেন প্রিয়নবি (সা.) তাঁর পবিত্র হাতের স্পর্শে!’
তখন তিনি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না, নিজের অসুস্থতার কথা স্মরণ করে প্রাণপ্রিয় মাশুক হজরত রাসূল (সা.)-এর চেহারা মুবারকের দিকে তাকিয়ে তিনি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন। আশেকের কান্না দেখে দয়াল রাসূল (সা.) এগিয়ে এলেন এবং গভীর মমতায় স্বীয় পবিত্র হাত মুবারক দ্বারা ইমাম বুসিরির দেহের অবশ হয়ে যাওয়া অংশগুলোতে স্পর্শ করলেন ও তার চেহারায় পরম আদরে হাত বুলিয়ে দিলেন। তারপর হজরত রাসূল (সা.) নিজের নকশাদার ইয়েমেনি চাদর (বুরদা) মুবারকটি ইমাম বুসিরি (রহ.)-এর গায়ে জড়িয়ে দিলেন। এমন সময় ইমাম বুসিরির ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম থেকে উঠে তিনি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে দেখতে পেলেন-স্বপ্নে দয়াল রাসূল (সা.) যে বরকতময় চাদরটি তার গায়ে জড়িয়ে দিয়েছিলেন, তা সত্যি সত্যিই তার শরীরে জড়ানো রয়েছে। এই বিস্ময়ের রেশ কাটতে না কাটতেই তিনি লক্ষ্য করলেন, তার শরীরে আগের মতো জড়তা নেই, দুর্বলতা নেই এবং তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষের মতো হাত-পা নাড়াচাড়া করতে পারছেন। কুলকায়েনাতের রহমত হজরত রাসূল (সা.)-এর বরকতে দীর্ঘদিনের দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে অলৌকিকভাবে আরোগ্য লাভ করে ইমাম বুসিরি অশ্রুসিক্ত নয়নে বারবার মহান আল্লাহ ও তাঁর প্রিয় হাবিব (সা.)-এর শুকরিয়া আদায় করতে লাগলেন। ভোর হলে ইমাম বুসিরি দীর্ঘদিন পর বাড়ি থেকে বের হলেন। মৃত্যুপথযাত্রী বুসিরিকে সম্পূর্ণ সুস্থ-সবল অবস্থায় হেঁটে বেড়াতে দেখে এলাকাবাসী হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল। এভাবে কিছুটা পথ অতিক্রম করার পর পথিমধ্যে এক সুফি দরবেশ ইমাম বুসিরির সামনে এসে সালাম দিয়ে বললেন-‘হে বুসিরি! আমাকে দয়া করে সেই কাসিদাটি শোনান, যা আপনি গত রাতে দয়াল রাসূল (সা.)-কে শুনিয়েছেন!’ দরবেশের এ কথা শুনে ইমাম বুসিরি (রহ.) অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে বললেন-‘আপনি কীভাবে এ কাসিদা সম্পর্কে জানলেন! মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা.) ছাড়া ত্রিভুবনের আর কারও তো এ কাসিদা সম্পর্কে জানার কথা নয়! কেননা, আমি তো এ কাসিদা দয়াল রাসূল (সা.)কে স্বপ্নে শুনিয়েছি!’
তখন দরবেশ বললেন-‘হে বুসিরি! গত রাতে আমি রুহানিতে হজরত রাসূল (সা.), সাহাবায়ে কেরাম এবং আউলিয়ায়ে কেরামের এক পবিত্র মজলিসে উপস্থিত ছিলাম। হঠাৎ করে সেই মজলিসে আপনার কণ্ঠে সুমধুর কাসিদার ধ্বনি ভেসে আসতে লাগল। আর সেই কাসিদা শুনেই আল্লাহর রাসূল (সা.) অস্থির হয়ে আমাদের আসর ছেড়ে আপনাকে দেখতে রওয়ানা হন। আর তাই আমিও এখন আপনার কাছে ছুটে এলাম আপনার জবান থেকে ওই অমিয় কাসিদাটি শোনার জন্য!’
দরবেশের এ কথা শুনে সীমাহীন আনন্দ ও কৃতজ্ঞতায় ইমাম বুসিরি (রহ.)-এর মন-প্রাণ ভরে উঠল। তিনি তৎক্ষণাৎ দরবেশকে কাসিদাটি পাঠ করে শুনালেন। পরবর্তী সময়ে ইমাম বুসিরি (রহ.)-এর এই কাসিদা এবং হজরত রাসূল (সা.) কর্তৃক তাকে নকশাদার ইয়েমেনি চাদর (বুরদা) উপহার দেওয়ার ঘটনাটি এক কান-দু কান হয়ে মানুষের মুখে মুখে সমগ্র মুসলিম জাহানে ছড়িয়ে পড়ে। যার ফলে কাসিদাটি এর মূল নামের পরিবর্তে ‘কাসিদায়ে বুরদা’ নামেই ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে। আরবি ‘বুরদাতুন’ শব্দের অর্থ নকশাদার চাদর। আর ‘কাসিদা’ শব্দের অর্থ প্রশংসামূলক দীর্ঘ কবিতা। এ ঘটনার বহুদিন পর ১২৯৪ খ্রিষ্টাব্দে ৮৭ বছর বয়সে এই মহান সুফি কবি ওফাত লাভ করেন। তার পবিত্র মাজার শরিফ মিশরের আলেকজান্দ্রিয়াতে অবস্থিত।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, দি পিপলস ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ
