|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ফেসবুকে কেউ লিখেছেন—'বিদ্যুৎ বিল তিন গুণ, রাস্তায় গ্যাস লিক, চাকরির পরীক্ষার ফল অনিশ্চিত... দেখেন আপনারা যা ভালো মনে করেন।' কমেন্টে কেউ বলেছেন, ‘ভাই, এই দেশে আর টিকাই যাচ্ছে না।' আরেকজন যোগ করেছেন, ‘স্যার, আপনার পোস্টটি শতভাগ সত্য।’ এই কথাগুলোর মধ্যে লুকিয়ে আছে এক ধরনের ক্লান্তি—যেখানে কেউ সরাসরি কিছু বলছেন না, আবার একরকম নীরব প্রতিবাদ ঠিকই জানিয়ে দিচ্ছেন।
সম্প্রতি ‘দেখেন, আপনারা যা ভালো মনে করেন’ এই বাক্যটা সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘন ঘন চোখে পড়ছে। একটা সাধারণ বাক্য হলেও এর ভেতরে যেন জমে আছে হতাশা, বিদ্রূপ আর নিরুপায় এক মানসিকতা। এটি একধরনের আত্মরক্ষামূলক ভাষা—যা মানুষ ব্যবহার করছে নিজের হতাশা কিংবা ক্ষোভ প্রকাশ করতে গিয়ে, আবার সে ক্ষোভের দায় না নিতে চেয়ে।
এটি একসঙ্গে তিনটি কাজ করে। প্রথমত, লেখাকে সমালোচনার হাত থেকে বাঁচায়—কথাটি বললেও দায়িত্ব এড়ানো যায়। দ্বিতীয়ত, পাঠককে ইঙ্গিত দেওয়া হয়, ‘আমি যা বললাম, মানুন বা না মানুন, আমার অবস্থান নিরপেক্ষ।’ তৃতীয়ত, এতে লুকিয়ে থাকে এক ধরনের বিদ্রূপ—যেন বলা হচ্ছে, ‘পরিস্থিতি এতটাই অদ্ভুত যে কিছু বলারই মানে হয় না।’
এই বাক্যটা হয়তো একসময় অনিশ্চয়তা বা বিনয় প্রকাশের জন্য ব্যবহার হতো। কিন্তু এখন এটা হয়ে উঠেছে ডিজিটাল যুগের ক্লান্ত মানুষের একধরনের ভাষা। যখন কোনো সমস্যার সমাধান মানুষের নাগালে থাকে না, তখন সে বলে ওঠে—'দেখেন আপনারা যা ভালো মনে করেন।’ এটা এক ধরনের প্যাসিভ প্রতিবাদ। মুখে না বললেও, মনের গভীরে জমে থাকা ক্ষোভ ঠিকই প্রকাশ পাচ্ছে।
অনেকেই বিতর্কিত বিষয়ে নিজের মতামত দিতে চান না। তারা এই বাক্য ব্যবহার করে নিজের অবস্থান ‘অন্যের বিবেচনায়’ ফেলে দেন—যাতে নিজে কোনো বিতর্কে জড়াতে না হয়। আবার কেউ কেউ ইচ্ছা করেই এই লাইন ব্যবহার করেন বিদ্রূপ করতে—যখন তারা এমন কিছু বলছেন যা সমালোচনা করতে চান, কিন্তু সরাসরি বলছেন না।
এই বাক্য আজ কেবল কথার অভিব্যক্তি নয়, এটি হয়ে উঠেছে আমাদের সময়ের মানসিক অবস্থার প্রতিচ্ছবি। কনটেন্ট ক্রিয়েটররা এটিকে ব্যবহার করেন ‘নিরপেক্ষ’ থাকার কৌশল হিসেবে। পাঠকদের বলেন, ‘আপনারাই বুঝে নিন আমি কী বোঝাতে চাইলাম।’ আবার মিম বা ভিডিওতে এটি ব্যবহার হয় হাস্যরস বা অতিরঞ্জনের জন্য—যা ট্রেন্ড হয়ে উঠেছে।
মজার ব্যাপার হলো, এই ছোট্ট বাক্যেই ধরা পড়ে আমাদের সমাজের অনেক বড় সত্য। কেউ এটা দিয়ে মজা করেন, কেউ জীবনের বাস্তবতাকে তুলে ধরেন। এ বাক্যটায় লুকিয়ে আছে আমাদের সময়ের এক অদ্ভুত দ্বিধা। আমরা কথা বলতে চাই, কিন্তু দায় নিতে চাই না। প্রতিবাদ জানাতে চাই, কিন্তু ঝামেলায় জড়াতে চাই না। আমরা হাসি, অথচ সেই হাসির আড়ালে থাকে গোপন কষ্ট।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী

